×

মুক্তচিন্তা

ফিলিস্তিন আন্দোলন বিশ্ব মুক্তির আন্দোলন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২১, ১২:১৩ এএম

গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়েছে। তবে তা সাময়িক হতে বাধ্য। এই যুদ্ধবিরতি কেবল তাদের জন্য প্রশান্তির যারা সাম্প্রতিক ইসরায়েলি আক্রমণে প্রিয়জনের জীবন, ঘরবাড়ি বা সম্পদ হারাননি। আর এ যুদ্ধ প্রথমও নয়, শেষও নয়, চলমান। সম্প্রতি ইসরায়েল কর্তৃক অমানবিক আক্রমণ, ফিলিস্তিনি নাগরিকদের নির্বিচারে গণহত্যা এবং তাদের আটক ও পদপিষ্ট রাখার মুখে ফিলিস্তিনের বর্তমান আন্দোলনটি অতীতের আন্দোলন থেকে বেশকিছু দিক থেকে ভিন্ন। এখন এটা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি স্পষ্ট যে ফিলিস্তিন-ইসরায়েলি বিবাদ মোটেও দুই শক্তির যুদ্ধ নয়, এ হচ্ছে একটি বন্দি জনগোষ্ঠীর ওপর নির্বিচারে বোমাবর্ষণ ও তাদের হত্যা। যার একমাত্র উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্রের মদদপ্রাপ্ত উচ্চ সামরিক ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ ইসরায়েল কর্তৃক একটি জাতিকে চিরতরে নির্মূল করা। এবার এটি কীভাবে শুরু হলো? ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ও দ্য এথনিক ক্লিনজিং ও ফিলিস্তিন, দ্য বিগেস্ট প্রিজন অন আর্থ : এ হিস্টরি অব দ্য অকুপাইড টেরিটরিজ, টেন মিথস অ্যাবাউট ইসরায়েল, গাজা ইন ক্রাইসিস : রিফ্লেকশনস অন ইসরায়েলস ওয়ার এগেইনস্ট প্যালেস্টিনিয়ানস ইত্যাদি গ্রন্থের লেখক ইলাল পাপে এ ব্যাপারে কিছু কথা বলেছেন। গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিসের সঙ্গে এক আলোচনায় তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলের দুর্নীতিবাজ প্রধানমন্ত্রী জেলে ঢোকার সম্ভাবনা থেকে বাঁচার জন্য বিশে^র মুসলিমদের তৃতীয় পবিত্রতম ও ফিলিস্তিনে মুসলমানদের পবিত্রতম স্থানে এই উসকানিমূলক আক্রমণ করে, যাতে যুদ্ধ বাধিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়। এ উদ্দেশ্যে তিনি ইসরায়েলের ডানপন্থার শক্তির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন, যারা বর্তমানে ইসরায়েলি রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। যাদের এজেন্ডা হচ্ছে আরেকটি বিপর্যয় বা ‘নাকবা’র মাধ্যমে পুরো জেরুজালেমের ও পশ্চিম তীরের ইহুদিকরণ। ২০১৮ সালে ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস টুইটে বলেছিলেন, ‘পুরো জনগোষ্ঠীর কথা বাদই দিলাম, একজন ব্যক্তিও শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকলে কেউ মুক্ত নয়। ইহুদি ও আরব, ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান, এশিয়ান ও আফ্রিকান সবার স্বার্থে গাজার অবরোধ ও এর জনগণের ওপর সংঘবদ্ধ নির্যাতনের এখনই অবসান হওয়া প্রয়োজন।’ এ বছর ১৩ মে তিনি পুনরায় টুইটারে বলেন, ‘যদি শনিবার আপনি লন্ডনে থাকেন, ফিলিস্তিনের জনগণের জন্য শান্তি ও ন্যায়বিচারের দাবিতে তথা ইসরায়েলের বর্ণবাদী রাষ্ট্রনীতি ও আদর্শের বিরুদ্ধে আয়োজিত মিছিলে যোগ দেয়ার কথা মাথা রাখুন। ইসরায়েলি বর্ণবাদের বিলোপ কেবল এই নির্যাতন বন্ধ করতে পারে।’ দুঃখজনকভাবে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা অভিযান বন্ধের লক্ষ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রায় কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করলেন না। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী তিনি বরং নেতানিয়াহু সরকারকে পুতুপুতু করে বললেন, ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষা’র জন্য তার ‘সর্বাত্মক’ সমর্থন অব্যাহত থাকবে। তিনি বরং ইসরায়েলের ওপর রকেট আক্রমণের ‘নিন্দা’ জানান। ‘ইসরায়েলি সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ ও প্রভাব প্রয়োগের’ জন্য তাকে ব্রিটিশ সংসদের সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা জেরিমি করবিনের অনুরোধ এভাবে জলে গেল। তদুপরি বাইডেন সাহেব এ মাসেই ইসরায়েলের কাছে ৭৩৫ মিলিয়ন ডলার অস্ত্র বিক্রি অনুমোদন করলেন। মার্কিন সিনেটর বার্নি সিনেটর কিন্তু পূর্ব জেরুজালেমে ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন। একইভাবে নিন্দা করেছেন ট্রাম্পের আতঙ্ক ‘স্কোয়াডে’র সদস্যরাÑ কংগ্রেস সদস্য আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিয়ো-কোর্তেজ, ইলহান ওমর ও রশিদা তালিব। বিশেষত ১৩ মে কংগ্রেসে রশিদা তালিবের বক্তব্যটি ছিল যেমন যুক্তিপূর্ণ ও জোরাল তেমনি অবেগময় ও দৃষ্টি উন্মোচনকারী। তিনি ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূত প্রথম নারী যিনি কংগ্রেসে নির্বাচিত হয়েছেন। বক্তৃতাকালে তিনি কয়েকবার আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ও একসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। যারা তার বক্তৃতা শুনেছেন তাদের কেউই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে আলোড়িত না হয়ে পারেন না। তালিব শুরু করেন এভাবে : ‘দুনিয়াতে যে ফিলিস্তিনিরা আছে সহকর্মীদের কাছে আমি তার স্মারক, আমরাও মানুষ, আমাদেরও স্বপ্ন দেখার অধিকার আছে। আমরাও মাতা, কন্যা ও প্রপৌত্রী। আমরা ন্যায়বিচারপ্রার্থী ও যে কোনো রকম নির্যাতনের ঘোরতর বিরোধী।’ তিনি মনে করিয়ে দেন যে, ইসরায়েলের সবচেয়ে বিখ্যাত মানবাধিকার সংগঠন বেৎসেলেম ইসরায়েলকে একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচও সম্প্রতি একই কথা বলেছে। তিনি ইসরায়েলের দিকে ও ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর পক্ষপাতিত্ব উল্লেখ করেন তাদের প্রতিবেদনের জন্য শব্দ চয়নের মধ্য দিয়ে। বলেন, “এই ভয়ঙ্কর নৃশংসতার খবর আমরা কীভাবে দেই তার মধ্যে রয়েছে চরম অমানবিকীকরণ। নিউইয়র্ক পোস্ট ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুকে ইসরায়েলের দুর্ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করে। এবিসি বলে ইসরায়েলিরা ‘খুন’ হয়েছে আর ফিলিস্তিনিরা ‘মারা গেছে’ যেন কোনো জাদুবলে, যেন তারা মানুষই ছিল না।” তিনি গাজা থেকে তার কাছে পাঠানো এমান নামের এক মায়ের চিঠি থেকে কিছু অংশ পড়ে শোনান যেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘আজ রাতে আমি বাচ্চাগুলোকে এক বিছানায় ঘুম পাড়ালাম যাতে আমরা একসঙ্গে মরতে পারি আর কাউকে কারো জন্য শোক বহন করতে না হয়।’ তালিব কংগ্রেসে তার সহকর্মীদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন এই বলে যে, তারা ইসরায়েলিদের মতো ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষেও দাঁড়াতে প্রস্তুত কি না। বলেন, ‘আমাদের সবারই স্বাধীনতা, মুক্তি, শান্তি ও ন্যায়বিচারের অধিকার আছে যা আমাদের ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ের কারণে কখনো অগ্রাহ্য করা যাবে না। ইসরায়েলি বা ফিলিস্তিনি যেই হোক, কোনো শিশুকেই যেন সন্ত্রস্ত থাকতে না হয় কখন আকাশ থেকে মৃত্যু নেমে আসবে।’ তিনি উল্লেখ করেন তার দেশ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইসরায়েলি সৈন্যবাহিনীকে পাঠানো সামরিক সাহায্যের কথা যাতে একটি পুরো জনগোষ্ঠীকে দাবিয়ে রাখা যায়। তিনি ইসরায়েলের এই বর্ণবাদী ব্যবস্থার অবসান দাবি করেন। এই কুৎসিত সামরিক মৈত্রী সম্পর্কে দাফনা থের ও সুমায়য়া আওয়াদ জ্যাকোবিন সাময়িকীতে (ডযু ণড়ঁ ঝযড়ঁষফ ঝঁঢ়ঢ়ড়ৎঃ ইড়ুপড়ঃঃ, উরাবংঃসবহঃ, ধহফ ঝধহপঃরড়হং অমধরহংঃ ওংৎধবষ, ৫ মে ২০২১) লিখেছেন, ‘নিরাপত্তা প্রযুক্তির উন্নয়নে ইসরায়েল বিশে^ নেতৃত্বদানকারী এবং মাথাপিছু অস্ত্র সরবরাহে বিশে^ সর্ববৃহৎ, আর রপ্তানির আগে তারা প্রথমে তা ফিলিস্তিনিদের ওপর পরীক্ষা করে দেখে।’ আর ‘তাদের যৌথ অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং সামরিক ও অস্ত্র খাতে বিনিয়োগের ভিত্তিতে ঠিক হয় দখলদারদের জন্য মার্কিন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীতে ৩.৮ বিলিয়ন ডলার মার্কিন বিনিয়োগ হয় এই চুক্তিতে যে এর একাংশ মার্কিন-প্রস্তুতকৃত অস্ত্র ক্রয়ে ব্যবহার করা হবে।’ ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা লাখ লাখ ফিলিস্তিনবাসীর উচ্ছেদ হয়ে পালিয়ে তীরবর্তী গাজা এলাকায় আশ্রয় গ্রহণের মতো নৃশংস ঘটনার মধ্য দিয়ে যা সৃষ্টি করেছে ‘বিশে^র বৃহত্তম শরণার্থী শিবির।’ জ্যাকোবিন সাময়িকীতে (ওংৎধবষ ঈৎবধঃবফ ঃযব জবভঁমববং রহ এধুধ ঞযধঃ ঞযবু’ৎব ঘড়ি ইড়সনরহম, ১৮ মে ২০২১) সেরাজ আশি লিখেছেন, ‘ইসরায়েলের সঙ্গে গাজা কোনো যুদ্ধে লিপ্ত রাষ্ট্র নয়। ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে নৃশংস দখলদারিত্বের শিকার গাজাকে বলা হয় পৃথিবীর বৃহত্তম শরণার্থী শিবির ও পৃথিবীর বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার।’ ফিলিস্তিনবাসীর সাম্প্রতিক ঐক্যবদ্ধ উত্থান ইসরায়েলের ভেতর ও বাইরে থেকে তরুণ ফিলিস্তিনিদের মাধ্যমে ঘটেছে যারা মূলধারার রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করেনি এবং বিশে^র মুসলিম ও অমুসলিম উভয়ের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছে। এই সংঘর্ষ জিইয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার তদন্ত হচ্ছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো ও দেশটির রাজনৈতিক নেতা কর্তৃক। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দরিদ্র, অসহায় ও আশ্রয়হীন জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে বর্ণবাদী ইসরায়েল পরিচালিত সুসংঠিত গণহত্যা অভিযানের বিরুদ্ধে রশিদা তালিব সঠিকভাবেই বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সারা বিশে^র সব নিপীড়নবিরোধী সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।’ আলমগীর খান : সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App