×

সাময়িকী

কবি গোলাম হোসেনের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২১, ১২:১০ এএম

কবি গোলাম হোসেনের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে
মুরাদ হোসেন ‘সংসারের কোলাহল মাঝে যেই জন, পারে ধর্মে দিতে মতি সাধুপথে সদাগতি, তার ঠাঁই উচ্চ অতি, ধর্ম মহাবীর, সংসার তরঙ্গ মাঝে হন না অধীর’। বাংলা সাহিত্যের এক প্রতিভা কবি গোলাম হোসেন রচিত ‘জীবন ও তার ব্রত’ শীর্ষক কবিতার অংশ বিশেষ। কবির চতুর্থ প্রকাশিত ২শ পৃষ্ঠার গ্রন্থ ‘নীতি প্রবন্ধ মুকুল’ প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালে এবং দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯২১ সালে। এটি ছাত্রবৃত্তি বিদ্যালয়ের ৫ম ও ৬ষ্ঠ মানের ছাত্রছাত্রীদের জন্য লিখিত হয়েছিল। এটা একটা পাঠ্যপুস্তক সংকলন হলেও লেখকের মৌলিক প্রবন্ধ ও কবিতা এতে স্থান পায়। আর এই কবিতাটিই উক্ত পুস্তকে সন্নিবেশিত হয়েছিল। বিংশ শতকের শুরুর দিকে যে ক’জন মুসলমান বাঙালি সাহিত্য সাধনায় অতিনিবেশ করে যোগ্যতার পরিচয় রেখে গেছেন, তাদের মধ্যে কবি গোলাম হোসেন অন্যতম। শিক্ষাদীক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অন্ধকারে থাকা সামান্য কয়েকজন সুশিক্ষিত মুসলমান সাহিত্যিকদের মধ্যে সে সময়ের প্রেক্ষাপটে কবি গোলাম হোসেনের নাম অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, বিস্মৃতপ্রবণ আমাদের এই সমাজে অতীতের গৌরব গাথা ও কৃতী ব্যক্তিদের মূল্যায়ন অনুপস্থিত বলেই আজকের সাহিত্য অঙ্গনে যেমন কবি গোলাম হোসেনের নামটি অনুপস্থিত, তেমনভাবেই অনুপস্থিত তার জন্ম ও কর্মক্ষেত্র মাগুরা জেলাসহ বৃহত্তর যশোর অঞ্চলেও। কবি গোলাম হোসেন ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ ১২৮০ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনে মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার জোকা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মুন্সি আব্দুর রহমান। পৈতৃক নিবাস মাগুরা জেলা সদরের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে হলেও কবির শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা এবং জীবনের অর্ধেক সময় কেটেছে মামা বাড়িতে। তাই তিনি মহম্মদপুরের সন্তান হিসেবেই বেশি পরিচিত। পরে পৈতৃক নিবাস বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে বাড়ি করে পরিবার নিয়ে সেখানেই স্থায়ী হন। তৎকালীন যুগে কবির পিতা মুন্সি আব্দুর রহমান একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে নড়াইলের একটি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক এবং সভাপতির দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু এই মানুষটি বিত্তহীন হলেও শিক্ষার কদর ভালোভাবেই বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই সংসারে অভাব-অনটন থাকা সত্ত্বেও তার প্রথম সন্তান গোলাম হোসেনকে উচ্চ শিক্ষায় গড়ে তোলার লক্ষ্যে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। আর তখনই বৈজ্ঞানিক স্যার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, বাংলা বিভাগীয় অধ্যক্ষ রায় বাহাদুর খগেন্দ্র মিত্র ও জগদীশ চন্দ্র বসুকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন কবি গোলাম হোসেন। তবে শৈশবে গোলাম হোসেনের লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়েছিল তার জন্মস্থান জোকা গ্রামের পাঠশালাতেই। প্রাথমিক পাঠ শেষ করার পর গ্রামে ভালো কোনো সুযোগ না থাকায় মাত্র ৯ বছর বয়সে মায়ের স্নেহের আঁচল ছেড়ে চলে যেতে হয় বাবার কর্মস্থল নড়াইলে। সেখানে একটি স্কুলে তাকে ভর্তি করা হয়। ১৮৯১ সালে ওই স্কুল থেকে মধ্য ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং মাসিক ৫ টাকা বৃত্তি লাভের মাধ্যমে তার আর্থিক কিছুটা সহায়তা হয়। এই অর্থকষ্টের মধ্যে কবির পিতা ২শ টাকা পণ্য দিয়ে মাত্র ৩ বছর বয়সের এক বালিকার সঙ্গে কবিকে বিবাহ দেন। তখন কবির বয়স ১৫ থেকে ১৬ বছর। বাল্যবিবাহ গোলাম হোসেনের মোটেই মনঃপূত ছিল না, এই বাল্যবিবাহ কবির জীবনে পরবর্তীকালে এক দারুণ মনোকষ্টের কারণ ঘটে। যা কবির আত্মজীবনীতে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত করে লিখেছেনÑ ‘বাল্যবিবাহের কুফল আমি যাহা বুঝিয়াছি, অনেকেই হয়তো তাহা পারেন নাই। আমার মতো হতভাগা বুঝি জগতে আর দ্বিতীয় নাই’। ১৮৯৫ সালে প্রবেশিকা পাস করেন গোলাম হোসেন। এরপর তিনি কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসা কলেজে ভর্তি হন। আলিয়া মাদ্রাসাটি তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কারণ মাদ্রাসার আলাদা স্টাফ ছিল না। তাই প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষকরাই ক্লাস নিতেন। আর এই সুবাদে গোলাম হোসেন মেলামেশার সুযোগ পান বৈজ্ঞানিক স্যার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, বাংলা বিভাগীয় অধ্যক্ষ রায় বাহাদুর খগেন্দ্র মিত্র এবং জগদীশ চন্দ্র বসুর সঙ্গে। দুই বছর পর এফএ পাস করে কলকাতার সিটি কলেজে বিএতে ভর্তি হন। বিএ পড়াকালীন ১৮৯৯ সালে পিতা মুন্সি আব্দুর রহমান মারা যান। পরে তিনি বিএ পাস করেন। কবি গোলাম হোসেন বরাবরই প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। নিজ বাসভূমির প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণে তিনি সুদূর কলকাতা ছেড়ে চলে আসেন। এসে কবি মহম্মদপুর থানার সাব-রেজিস্ট্রারের (কবির মামা শ^শুর) ছেলেদের গৃহশিক্ষকতা শুরু করেন। পরে সরকারি শিক্ষা বিভাগে স্কুল সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে প্রথমে যশোর পরে বরিশাল শিক্ষা অফিসে যোগদান করেন। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে প্রকৃতিপ্রেমী কবি হাঁপিয়ে ওঠেন। আর তাই কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে দেন এবং শৈলকূপা বেনীপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপরে কবি পর্যায়ক্রমে বিনোদপুর বি কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়, রামনগর হাই স্কুল ও মাগুরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। কবি গোলাম হোসেনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বঙ্গবীরাঙ্গনা কাব্য’ প্রকাশিত হয় ১৯০৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বঙ্গদেশীয় হিন্দু মুসলমান এটি প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে। স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গদ্যে রচিত গ্রন্থখানিতে সমকালীন বাংলাদেশ, বাঙালি এবং হিন্দু মুসলমান সমস্যা সম্পর্কে ব্যাপক অসাম্প্রদায়িক আলোচনা স্থান পেয়েছে। তাই এই গ্রন্থটি সে সময়ে যথেষ্ট সমাদর লাভ করে এবং সমকালীন হিতবাদী পত্রিকায় এটি উচ্চ প্রশংসিতও হয়েছিল। কবির আত্মজীবনী, দিল্লির আগ্রা ভ্রমণ, কাব্য যুথিকা, নীতি প্রবন্ধ মুকুল এবং পয়গামে মোহাম্মাদী নামে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও কবি তিন শতাধিক পৃষ্ঠার একটি উর্দু গ্রন্থের অনুবাদও করেছিলেন। এটি কবির পঞ্চম প্রকাশিত অনুবাদ সাহিত্যকর্ম। এই বইয়ের একটি কপি ভারতের জাতীয় জাদুঘরে রয়েছে। তবে কবি সাহেবের সর্বশেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘কাব্য যুথিকা’। দীর্ঘ চার দশকের নীরবতার পর ‘কাব্য যুথিকা’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। ৮৩ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে ১৩টি কবিতা স্থান পেয়েছে। কবির সাবলীল কাব্যভঙ্গি, ইতিহাস সচেতনতা, তীক্ষè পর্যাবেক্ষণ ও সত্যাগ্রহী ভক্তিপ্রবণ রসিক চিত্তের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে এবং সমসাময়িক মুসলিম সাহিত্যের ক্ষেত্রে কবিকে মীর মোশাররফ, মোজাম্মেল হক ও সৈয়দ এমদাদ আলীর স্বগোত্রীয় মনে করা যেতে পারে বলে ড. কাজী মোতাহার হোসেন এই কাব্যগ্রন্থের সমালোচনায় লিখেছেন। কবি গোলাম হোসেনকে লিখাপত্রে ড. কাজী মোতাহার হোসেন বলেন, আপনার কবিতায় যে সহজ স্বচ্ছন্দ গতি লক্ষ করলাম, তা আমাদের বর্তমান যুগে একেবারেই দুষ্পাপ্য হয়ে উঠেছে। এখন আমরা পদ্যে কবিতা লিখতে শুরু করেছি। আর যেন পদ্যও সুপাঠ্য নয়। অভিধান ঘেঁটে মানে বুঝতে হয়। ক্ষুদ্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র এই কাব্যগ্রন্থখানি পাঠকালে এক হৃয়দবান, সাধক, ভাবুক, ধর্মপ্রাণ, সৌন্দর্যপিয়াসী, সমাজ সচেতন, বেদনাবিধুর কবি মানসের সন্ধান মেলে, যার নির্জনবাস, কোলাহলবর্জিত সোঁদা মাটির গন্ধে ভরা জীবন-যাপনে হৃদয়কে ব্যথিত করে তোলে।  কবির অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের ১৮টি পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া গেছে। ১৯৬২ সালের ১০ জুন লন্ডন থেকে ড. হাসান জামানের দেয়া একটা পত্রের মাধ্যমে জানা যায় কবি গোলাম হোসেনের প্রকাশিত সমস্ত কাব্যগ্রন্থ লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউস নামক লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কবির জন্মভূমিতে বা নিজ জেলা ও উপজেলার কোনো গ্রন্থাগারে এমনকি পরিবারের কাছেও কবির প্রকাশিত সব কাব্যগ্রন্থ এখন আর সংরক্ষিত নেই। পল্লীর শিকড়ে বাঁধা, মাটি কামড়ে পল্লীর নিভৃত প্রান্তরে পড়ে থাকা আত্মপ্রচার বিমূখ, চার মেয়ে ও তিন ছেলের জনক প্রতিভাধর কবি গোলাম হোসেন ১৯৬৪ সালের ৫ এপ্রিল ৯১ বছর বয়সে নিজ বাস ভবনে ইন্তেকাল করেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App