×

জাতীয়

আওয়ামী লীগের বড় চ্যালেঞ্জ সাইবার যুদ্ধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২১, ০৮:২৩ এএম

বিরোধীরা গুজব রটানোর কাজে ব্যস্ত মোকাবিলায় প্রস্তুতি ক্ষমতাসীনদের

এখন আর মিছিল-মিটিংয়ে লোক হবে না। কারণ, দেশ মধ্যম আয়ের হয়ে গেছে। সবার হাতে একটা করে মোবাইল আছে। তার মানে কিছু টাকা আছে এবং সব ছেলেমেয়ে স্কুলে যায় বলে সবার একটা ভবিষ্যৎ স্বপ্ন আছে। এখন আন্দোলন হবে অনলাইনে।

১০ বছর আগে এমনই আভাস দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তার সেই পূর্বাভাস এখন অনেকাংশেই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভার্চুয়াল মাধ্যম পরিচালিত হচ্ছে। ইন্টারনেটের সর্বব্যাপী প্রভাব যেভাবে মানুষের জীবনযাপন ও কর্মধারা বদলে দিচ্ছে, তেমনি রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক নিরাপত্তার জন্যও বড় ধরনের হুমকি তৈরি হচ্ছে। এখন প্রত্যেক রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এই সাইবার যুদ্ধ বা অনলাইন আন্দোলন। বাংলাদেশের জন্যও তা চ্যালেঞ্জ।

এই সাইবার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটুকু সক্ষম ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার? বিশেষ করে নিজের রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সাইবার লড়াইয়ে কতটুকু প্রস্তুতি আছে দলটি? যে দলটি এক যুগ পূর্বে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনী যাত্রা শুরু করে। আর সেই ঘোষণায় আপামর জনসাধারণ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন করে। পরপর তিন মেয়াদে দলটি রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছে। এর মধ্যে বাংলাদেশও ডিজিটালি অনেক এগিয়ে গেছে। রাষ্ট্রের সব কর্মকাণ্ড এখন ভার্চুয়ালি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডিজিটাল কর্মকাণ্ডে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তাদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সাইবার লড়াইয়ে অনেক এগিয়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারবিরোধী নেতিবাচক প্রচারণায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে তারা। যা সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় দৃশ্যমান হয়েছে।

এরপর থেকেই অনলাইন আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছে আওয়ামী লীগ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সারাদেশে সামাজিক মাধ্যমে নেতিবাচক প্রচারণার জবাবের পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন ও ইতিবাচক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয় দলটি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিজ দলের কর্মীদের অনলাইন প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করে। দলের নেতাকর্মীদের ফেসবুকে সোচ্চার হওয়ার কড়া নির্দেশ ছিল হাইকমান্ডের। সারাদেশে তা ছড়িয়েও দেয়া হয়েছিল।

সে সময় যশোরের একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম (এখন তিনি প্রয়াত) দলের নেতাকর্মীদের বলেছিলেন, আসছে নির্বাচনে সাইবার যুদ্ধ হবে। কাজেই আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি সক্রিয় হতে হবে। আমাদের প্রতিপক্ষ গ্রুপ ফেসবুকে যদি মিথ্যা একটি লেখে, আপনারা ১০টি জবাব লিখুন। আমরা কেন পিছিয়ে থাকব। সাইবার যুদ্ধে জয়ী হতে সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। এরপর থেকেই আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে অনলাইনে অধিকতর সক্রিয় হয়ে উঠে। যা তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা নেয় দলটি।

কিন্তু তাতেও কী তারা পেরে উঠতে পারেনি প্রতিপক্ষের সঙ্গে। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মামুদ স্বপন বলেন, রাজনীতির মাঠে পরাজিত জামায়াত, বিএনপি ও হেফাজতি চক্র রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী অপপ্রচার ও গভীর ষড়যন্ত্রে সব সময় লিপ্ত থাকে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রবাসে বসবাসরত কিছু সংখ্যক ব্যক্তি। সরকার এদের চিহ্নিত করছে। আওয়ামী লীগ অসত্য ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে সাইবার লড়াই করতে নেতাকর্মীদেরও সম্পূর্ণ প্রস্তুত করছে।

সাইবার যুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলটির পক্ষে কাজ করছেন আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক প্রকৌশলী আব্দুস সবুর। তার নেতৃত্বে দেশের তথ্য ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে দলটির একটি সম্পাদকীয় উপকমিটি রয়েছে। আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সিআরআইর সহযোগিতায় এই কমিটি সারাদেশে দলের নেতাকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এরই মধ্যে ৫০ ভাগ প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে।

এ বিষয়ে আব্দুস সবুর বলেন, আমাদের ছেলেরা প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন বিভিন্ন কন্টেন্ট তৈরি করে সারাদেশে সেগুলো শেয়ার ও বণ্টন করছে। আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আমাদের প্রতিপক্ষ সামাজিক মাধ্যমে অনেক মিথ্যা গুজব ছড়াচ্ছে, উসকানি দিচ্ছে। বিপরীতে আমরা সত্য বিষয়গুলো তুলে ধরছি। সফলও হচ্ছি। আমাদের প্রশিক্ষণগুলো সম্পন্ন হলেই পুরো সাইবার জগত আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

সাইবার জগতে আওয়ামী লীগের চেয়ে মৌলবাদ অপশক্তি বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বেশি শক্তিশালী কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি মনে করি না। আমরা সব সময় সত্যটাকে প্রাধান্য দেই, মিথ্যার আশ্রয় নিই না। আর তারা গুজবকে প্রাধান্য দেয়।

তথ্য ও প্রযুক্তিবিদ কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ভাইসচ্যান্সেলর ও বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, সরকারবিরোধীদের একটা অংশ দেশের বাইরে থেকেই ফেসবুকে চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালায়। নেতিবাচক প্রচারণা মানুষের মাঝে বেশি প্রভাব ফেলে। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পূর্বে ফেসবুকের প্রপাগান্ডা মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ বড় ভূমিকা রেখেছে। সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নিয়েছে। জয়বাংলা অ্যাপস করে বিরোধী পক্ষের প্রপাগাণ্ডার জবাব দিয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ আগের থেকে অনেক বেশি সক্রিয়। এর সুফলও আমরা দেখছি। যেমন, সোনারগাঁওয়ের রয়েল রিসোর্টে মামুনুল হকের নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা সরকার সমর্থকরা মানুষের কাছে ফেসবুকের মাধ্যমে পৌঁছাতে পেরেছে। বিরোধীরা আওয়ামী লীগের কাছে টিকতে পারেনি।

মূলত ফেসবুকের মাধ্যমে কোটাবিরোধী ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তখনো সরকারবিরোধী অপশক্তি এই আন্দোলনে ঢুকে ছাত্রদের উসকানি দিয়েছিল। ফলে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রলীগ নেত্রীর লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। এমনকি ঢাবির ভিসির বাসভবনেও ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনা ঘটেছিল। ফেসবুক পোস্ট ও ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ ব্যবহার করেই আন্দোলনকারীরা সংঘবদ্ধ হয়েছিল। নিরাপদ সড়কের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেটাও ফেসবুকের মাধ্যমে। গুজব এমন পর্যায়ে ছড়িয়েছিল যে আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা লাশ খুঁজতে গিয়েছিল। পরে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়Ñ যা ক্ষমতাসীন দলটির জন্য এক প্রকার অস্বস্তির সৃষ্টি করেছিল।

তথ্য ও প্রযুক্তিবিদ মাহফুজুল ইসলাম স্বীকার করেন কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ফেসবুক সরকারবিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। জনগণের সেন্টিমেন্টও ছিল সেদিকেই। ফলে তারা মিথ্যা গুজব দ্রুত ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল। তখন আওয়ামী লীগ ফেসবুকে সক্রিয় ছিল না। এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে অন্য কেউ পারবে না।

তিনি বলেন, বিশ্বের কিছু জায়গায় সামাজিক মাধ্যমে বিপ্লব হয়েছিল। মানুষের সেন্টিমেন্টও বিপ্লবের পক্ষে ছিল। ফেসবুকের মাধ্যমে আমাদের দেশে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে যে সেন্টিমেন্ট জাগ্রত হয়েছিল। যার ফলে সরকার আইন পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। কাজেই সেন্টিমেন্টের পক্ষে যখন ফেসবুকে পোস্ট দেয়া হয়, তখন সেটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই সেন্টিমেন্টের বিপরীতে সঠিক যুক্তি দাঁড় করাতে না পারলে, বিপ্লব হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে ভবিষ্যতে সেই শঙ্কাটা আর নেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App