×

মুক্তচিন্তা

হাবীবুল্লাহ সিরাজী স্মরণে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ মে ২০২১, ১২:৩০ এএম

হাবীবুল্লাহ সিরাজী স্মরণে

হাবীবুল্লাহ সিরাজী সাহিত্য অঙ্গনে একাধারে কবি, গদ্যকার ও অনুবাদক হিসেবে পরিচিত। তিনি প্রায় সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই বিচরণ করেছেন অবাধে। সাহিত্যিক হাবীবুল্লাহ সিরাজী ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলার রসুলপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবুল হোসেন সিরাজী এবং মাতার নাম জাহানারা বেগম। তিনি ফরিদপুরের প্রাচীন স্কুলগুলোর মধ্যে অন্যতম ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে ১৯৬৪ সালে মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ফরিদপুরের শতবর্ষী কলেজ রাজেন্দ্র কলেজ থেকে ১৯৬৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৭০ সালে বুয়েট (যা সে সময়ে ইপিয়েট নামে পরিচিত ছিল) থেকে যন্ত্রকৌশল বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। হাবীবুল্লাহ সিরাজী প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেও সাহিত্যের প্রতি ছিল তার অমায়িক টান। অনেকেই ভাবতে পারেন প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারী একজন ব্যক্তি কীভাবে সাহিত্যে বা সাহিত্য অঙ্গনে এত বেশি প্রভাব বিস্তারকারী হলেন। এই প্রশ্নের উত্তর কবি নিজেই একটি সাক্ষাৎকারে দিয়েছিলেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন ‘আমাদের দেশে প্রথাগত হোক বা সামাজিক নানা কারণে হোক, আমরা ধরে নিই যারা বিজ্ঞানের সঙ্গে থাকেন তারা সাহিত্যে আসরে তাদের জন্য এটা অন্তরায় হয়ে ওঠে’। তার মানে লেখক লেখা শুরু করার সময় নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন। তবে তিনি থেমে থাকেননি। তিনি ভাষাকে মূল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এগিয়ে গেছেন দুর্বার গতিতে। সাহিত্যের আকাশে নিজেকে প্রস্ফুটিত করেছেন উজ্জ্বল আলোর মতো। তার মতে, ‘শব্দবিজ্ঞান’ হলো লেখার মূল মন্ত্র, যার মাধ্যমে মনের ভাবকে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। আর শব্দ বিজ্ঞান নিয়ে যে সবচেয়ে বেশি ভালো খেলতে পারবেন তিনি হবেন সাহিত্যের মাঠে পাকা খেলোয়াড়। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি একাধারে কবিতা, গদ্য, শিশুসাহিত্য ও অনুবাদের মতো দারুণ সব কাজ করে গেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন অসামান্য অবদান। তিনি তার লেখায় গভীর জীবনবোধ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তিনি বিজ্ঞানকে মানুষের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে তার সাহিত্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এছাড়াও তিনি গাছ এবং পাখি নিয়ে পরিবেশ সচেতনতামূলক দারুণ কবিতা গ্রন্থ লিখেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’। লেখক তার বয়ানে বলেছেন, ‘আমি আমার ভেতরকার বোধ থেকে বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রকৃতিকে যুক্ত করে এই বইটি লেখার কথা চিন্তা করেছি’। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে লেখক কতটা পরিবেশ সচেতন। সাহিত্যিক হাবীবুল্লাহ সিরাজী তার প্রতিটি কবিতা কিংবা গদ্যে শব্দের খেলা খেলেছেন, প্রয়োগ করেছেন নতুন নতুন সব শব্দ, যেগুলো আগে কখনো ব্যবহৃত হয়নি। তেমনি একটি শব্দ হলো ‘চারুচার্য’, যা তিনি তার ‘মধ্যরাতে দুলে ওঠে গ্যাস’ নামক কাব্যগ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ‘হাওয়া কলে জোড়া গাড়ি’ নামক কাব্যগ্রন্থটিতে যতগুলো কবিতা লিখেছেন তার কোনোটিতে শিরোনাম নেই। যেমন ছিল না শঙ্খ ঘোষের ‘দিনগুলি রাতগুলি গ্রন্থে’। ‘হাওয়া কলে জোড়া গাড়ি কাব্যগ্রন্থটি লেখক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সরাসরিভাবে তুলে না ধরলেও উপমার মাধ্যমে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন এখানে ‘আট কোটি মানুষের সাহসী সঞ্চয়’ বলতে লেখক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বুঝিয়েছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে সোনার মুকুটের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এছাড়া ‘রক্তেভেজা একখণ্ড সবুজ কাপড় উড়তে উড়তে’ বাক্যটি দ্বারা বাংলাদেশকে বুঝিয়েছেন। এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি ভাগকে উপমার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের সবুজ শ্যামল প্রকৃতি, সহজ সরল মানুষের জীবনাচরণ ও মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার অবদানকে সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’, ‘মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতি’, ‘হাওয়া কলে জোড়া গাড়ি’, ‘নোনা জলে বুনো সংসার’, ‘স্বপ্নহীনতার পক্ষে’, ‘আমার একজনই বন্ধু’, ‘পোশাক বদলের পালা’, ‘প্রেমের কবিতা’, ‘কৃষ্ণ কৃপাণ ও অন্যান্য কবিতা’, ‘সিংহদরজা’, ‘বেদনার চল্লিশ আঙুল’, ‘মøান, ম্রিয়মাণ নয়’, ‘বিপ্লব বসত করে ঘরে’, ‘ছিন্নভিন্ন অপরাহ্ন’, ‘জয় বাংলা বলো রে ভাই’, ‘সারিবদ্ধ জ্যোৎস্না’, ‘সুগন্ধ ময়ূর লো’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘মুখোমুখি : তুচ্ছ’, ‘স্বনির্বাচিত প্রেমের কবিতা’, ‘হ্রী’, ‘কতো আছে জলছত্র’, ‘কতোদূর চেরাপুঞ্জি’, ‘কাদামাখা পা’, ‘ভুলের কোনো শুদ্ধ বানান নেই’, ‘একা ও করুণা’, ‘যমজ প্রণালী’, ‘আমার জ্যামিতি’, ‘পশ্চিমের গুপ্তচর’ ও ‘কবিতাসমগ্র’। সাহিত্যিক হাবীবুল্লাহ সিরাজী অনুবাদেও বেশ পটু। তার দুটি অনুবাদগ্রন্থ হলো মৌলানার মন : রুমীর কবিতা ও রসুল হামজাতভের কবিতা। এছাড়াও তিনি উপন্যাস, আত্মজৈবনিক, শিশু সাহিত্য এবং পদ্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ হাবীবুল্লাহ সিরাজী পেয়েছেন নানা ধরনের স্বীকৃতি ও সম্মাননা। তিনি ২০১৬ সালে তার সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রীয় একুশে পদক লাভ করেন। পেশাগত জীবনে হাবীবুল্লাহ সিরাজী ১৯৭২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশ এবং দেশের বাইরে কুয়েত, ইরাক ও মালয়েশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর তিন বছর মেয়াদের জন্য বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে যোগদান। এই পদে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় গত ২৪ মে ২০২১ তারিখে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি আজীবন আপামর জনতার অন্তরে ভাস্বর হয়ে থাকবেন তার মহৎ কর্মের জন্য। অসাধারণ সব সাহিত্যকর্মই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে বাংলার প্রতিটি মানুষের অন্তরে!

মো. বিল্লাল হোসেন : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App