×

মুক্তচিন্তা

৩৩৩ : জেবুন্নেসা-সুলতানা-জহুরা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ মে ২০২১, ১২:১২ এএম

জেবুন্নেসা-সুলতানার গোত্রে প্রায় পড়ে গিয়েছিলেন জহুরা। ভাগ্যের ফের বা ঘটনাচক্রে রক্ষা। সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে ঘিরে জোর আলোচনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসা বেগম। তার নানা কীর্তি ভাইরাল হয়ে ঘুরছে সামাজিক মাধ্যমে। এর আগে স্থানীয় সাংবাদিক আরিকুল ইসলাম রিগানকে নাজেহাল করে ক’দিন শিরোনামে ছিলেন কুড়িগ্রামের তখনকার ডিসি পারভীন সুলতানা। রোজিনাকাণ্ডে ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ১৭ মে তারিখে এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়েও মিডিয়ায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ শিরোনামে জেবুন্নেসা। এর কাছাকাছি সময়ে প্রশংসিত শিরোনামে নারায়ণগঞ্জ সদরের ইউএনও আরিফা জহুরা। নারায়ণগঞ্জে খাদ্যসামগ্রীর চেয়ে জাতীয় কলসেন্টার ৩৩৩ নম্বরে ফোন করার অপরাধে ফরিদ নামের চারতলা বাড়িওয়ালাকে জরিমানা করেছেন তিনি। জরিমানা হিসেবে ১০০ গরিব মানুষকে সরকারি খাদ্য সহায়তার অনুরূপ প্যাকেট বিতরণ করতে নির্দেশ দেন জহুরা। তাৎক্ষণিক বেদম প্রশংসা তার। অয়েল ডান, গুড জব বলে ধন্যবাদ পেতে দেরি হয়নি। কেউ প্রশ্ন তোলেননি চারতলার মালিক জালিয়াতি করেছে, মামলা হবে জালিয়াতির এবং দণ্ডবিধিতে তার শাস্তিও নির্ধারণ করা আছে। ইউএনও তার ইচ্ছামতো একটা সাজা দিয়ে বাহবা নিতে পারেন কি-না? তাহলে অন্য কোনো কর্মকর্তা বা বিচারক কাউকে কোনো অপরাধে ইচ্ছামতো সাজা দিলে সেটা মানবেন তো? এক মন্ত্রী অনেকদিন আগে একজনকে কান ধরে উঠ-বস করিয়েছিলেন, সেটাও তাহলে ঠিক ছিল? প্রশ্ন এদ্দূর গড়ানোর আগেই দেখা গেল পুরো ঘটনাটা বিপরীত। ৩৩৩ নম্বরে কল করে খাদ্য সাহায্য চাওয়া নারায়ণগঞ্জের কাশিপুরের ফরিদ উদ্দিনকে ধরতে সাংবাদিকসহ দলবল নিয়েই গিয়েছিলেন ইউএনও জহুরা। সেখানে গিয়ে তার কাছে মনে হয়েছে এক ভদ্রলোক আস্ত প্রতারক। চারতলার মালিক হয়েও তিনি ভং ধরেছেন। তাই শাস্তি হিসেবে নগদে সাজা দিলেন ফরিদ উদ্দিনকে নিজ খরচায় অনুরূপ খাদ্য দিতে হবে ১০০ লোককে। তাৎক্ষণিক মস্ত ঘটনা বা খবর হলেও অল্পসময়ের মধ্যে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসে। ইউএনও আসলে প্রতারিত হয়েছেন। এমনটি বুঝিয়েই তাকে দিয়ে এ ঘটনার নেপথ্য হোতা স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি। ফরিদ উদ্দিন আসলে পুরো বাড়ির মালিক নন, শুধু যেটুকুতে তিনি থাকেন সেটুকুরই পৈতৃকসূত্রে মালিক। তিনি প্রতারক নন। সাহায্যের আশায়ই ফোন দিয়েছিলেন ৩৩৩ নম্বরে। কিন্তু তার চারতলা ভবনে থাকার দরুন একটা আচ্ছা কেস পেয়েছেন বলে আয়োজনটি গুটিয়ে আনেন স্থানীয় মেম্বার আইউব আলী। বাঁচতে হলে ইউএনও এলে যেন তার কাছে ক্ষমা চান অসহায় ফরিদ উদ্দিনকে সেভাবেই আয়ত্ত করেন মেম্বার। তিনি সেটাই করেন। ইউএনওর কাছে ক্ষমাই চাইলেন না, মাথা নিচু করে শাস্তিও মেনে নেন। বিপত্তি দেখা দেয় শাস্তি হিসেবে ১০০ লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা নিয়ে। তার তো ওই সামর্থ্য নেই। জেলে যাওয়ার ভয়ে ধারদেনা করে জরিমানার শর্ত মোতাবেক ১০০ জনের খাবার দিয়েছেন। এই ৩৩৩-তে কল দেয়ার নেপথ্য ঘটনা আরো পীড়াদায়ক। কাশিপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের নাগবাড়ি শেষ মাথা এলাকার বাসিন্দা বৃদ্ধ ফরিদ উদ্দিন নিয়মিত এফএম রেডিও শোনেন। রেডিওতে সংবাদে তিনি জেনেছেন, ৩৩৩ নম্বরে কল করে খাদ্য সহায়তা পাওয়া যায়। সেই ভরসায় গোপনে তিনি কল করেছিলেন ওই নম্বরে। কিন্তু সহায়তার বদলে ভাগ্যে জুটল হয়রানি-ভোগান্তি, জরিমানা। তার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। কাজ করতে পারেন না। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। অন্য মেয়ে টিউশনি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ জোগান। প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য নিয়মিত ওষুধ লাগে। তার নিজেরও দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। দুই চোখেই অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। তিনবার স্ট্রোক করেছেন। কোনো রকমের সঞ্চয় নেই তার। নিজের ওষুধ কেনারও পয়সা নেই। ছয় ভাই ও এক বোন মিলে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমিতে চারতলা ভবন করেছেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন চারতলায় উপরে টিনশেড দেয়া ঘরে। অবিবাহিত মেয়েটি লোকলজ্জার ভয়ে গয়না বিক্রি, ধানদেনা করে জহুরা ম্যাডামের আরোপিত জরিমানার ৭০ হাজার টাকার খাদ্যসামগ্রী কিনেছেন। অপমানে এরই মধ্যে বৃদ্ধ ফরিদ উদ্দিন দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। এই ত্রাণ জোগাড় করতে গিয়ে তাদের স্বর্ণালঙ্কার বন্ধক রাখতে হয়েছে, ধার করতে হয়েছে। মেম্বার আইয়ুব আলীও তাদের সুদে ১০ হাজার টাকা ধার দিয়েছেন। ভাবা যায়? যার মধ্য দিয়ে দেশের লাখ লাখ নিম্ন-মধ্যবিত্তের অবস্থা ফুটে উঠেছে। যারা লজ্জায় চাইতে পারে না, আবার চাইলেও বিপদ। ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেছেন, ওই লোকের ‘ক্ষতিপূরণ’ দেয়া হবে। ইউএনও জহুরা বলেছেন, বিহিত ব্যবস্থা নেয়া হবে তাকে যারা মিসগাইড করেছে তাদের বিরুদ্ধে। এ ধরনের ঘটনার কি আসলে ‘ক্ষতিপূরণ’ হয়? তার সামাজিক-মানসিক ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে। ভাবতে হবে এই বৃদ্ধ যেই অসহায়ত্বের কথা স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে বলতে পারলেন সেটা কেন ইউএনও জানার চেষ্টা করলেন না। তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক। বিচারিক ক্ষমতার সমান্তরালে তার কি সংবেদনশীল-নির্ভুল বোধ-জ্ঞান থাকতে নেই? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই বলে আসছেন, সরকারি সহায়তা কোনো দয়া নয়, তার অধিকার। সরকার ৩৩৩ কলসেন্টারের মাধ্যমে অসহায় ও দুস্থ মানুষদের খাদ্য সহায়তা প্রদান করছে। কেউ ওই নম্বরে কল করে তাদের সংকটের কথা জানালে উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও অফিসে জানানো হয়। পরে তা যাচাই করে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেয়া হয়। জাতীয় হেল্পলাইন ও তথ্য বাতায়ন কেন্দ্রের হটলাইন শর্টকোড নম্বর ৩৩৩। দেশের নাগরিকদের বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের নানান ধরনের তথ্যগত সেবা দিয়ে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্মটি। করোনা মহামারি এবং লকডাউনের মতো পরিস্থিতিতে সেই প্ল্যাটফর্মেই সেবা পেতে নাগরিকদের কল বেড়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি। ২০১৪ সালের জুনে প্রায় ২৫ হাজার ওয়েবসাইটের সমন্বয়ে তৈরি করা হয় জাতীয় তথ্য বাতায়ন। পরবর্তীতে এটিতে হেল্পলাইন যুক্ত করা হয় এর শর্টকোড হয় ৩৩৩। প্রায় এক বছর পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের পর ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হয় হেল্পলাইন নম্বরটি। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের বাস্তবায়নাধীন ও ইউএনডিপির সহায়তায় পরিচালিত এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত হয়ে আসছে প্ল্যাটফর্মটি। ২০২০ সালে দেশে করোনা ভাইরাস আক্রমণের সময় এবং পরবর্তীতে লকডাউন আরোপিত হলে প্ল্যাটফর্মটির প্রয়োজনীয়তা, দক্ষতা এবং উপকারিতা আরো বেশি পরিলক্ষিত হয়। আর সেটি অব্যাহত আছে চলতি লকডাউনেও। এ সংকটের সময়ে দেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হেল্পলাইনে পরিণত হয়েছে কলসেন্টার ‘৩৩৩’। যে কোনো সময়ে ‘৩৩৩’ নম্বরে ফোন দিয়ে মানুষ করোনা ভাইরাস সম্পর্কে তথ্য, চিকিৎসকের পরামর্শ, খাদ্যসহ বিভিন্ন সহায়তা পাচ্ছেন। বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রে ত্রিপল থ্রি-তে রিং করলে খাদ্য পাওয়া যায়Ñ অবশ্যই ব্যতিক্রমী বিষয়। এ কারণে সরকারের এ ইতিবাচক উদ্যোগটি বেশ প্রশংসিত। শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ছিল, অনেক মধ্যবিত্ত কারোনার কারণে দারিদ্র্যসীমার মধ্যে চলে আসবেন, তারা হয়তো লজ্জায় বলতে পারবেন না। এজন্য খাদ্য সংকটে থাকা কেউ ৩৩৩ নম্বরে কল দিলে তাকেও যেন খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়। চমৎকার এবং কল্যাণকর এমন উদ্যোগের কীভাবে কারা সর্বনাশ ঘটায় নারায়ণগঞ্জ সেটার উদাহরণ। ইউএনও জহুরা বা মেম্বার আইয়ুব আলী উদাহরণের মসলা মাত্র। মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App