ইসরায়েলি হামলা, ফিলিস্তিনি দুর্বলতা এবং সমস্যার সমাধান
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৬ মে ২০২১, ১২:১৩ এএম
ফিলিস্তিনি বসতি গাজায় দিনের পর দিন সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলার বর্বরতা যখন বিশে^র মানবিক বোধকে আহত করে চলেছে তখন দেখা গেল জো বাইডেনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিÑ রিপাবলিকান রক্ষণশীলদের ভিন্ন কিছু নয়। ডেমোক্রেটদের ডেমোক্রেসি এখানে সঠিক পথ ধরে চলছে না। এমন আশঙ্কা আমাদের কম ছিল না। যদিও ডেমোক্রেটদের ইশতেহার কিংবা জো বাইডেনের প্রতিশ্রুতি গণতন্ত্রমুখীই ছিল। কিন্তু মার্কিনি বিদেশ নীতির ঐতিহ্য বলে কথা। সেটা বরাবর রক্ষণশীল ধারায় পথ চলেছেÑ কী ডেমোক্রেট, কী রিপাবলিকান নীতি। যেমন, তারা ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের লাগাতার বর্বর আচরণ সমর্থন করে এসেছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর প্রতি অন্ধ সমর্থন জ্ঞাপন করে এসেছে। সে সমর্থন বিশ^গণতন্ত্রীদের চোখে যত আপত্তিকরই ঠেকুক না কেন।
বিগত মার্কিনি নির্বাচনে ট্রাম্প বনাম বাইডেনের প্রতিযোগিতায় গণতন্ত্রী মাত্রেই, এমনকি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পর্যন্ত সবাই চেয়েছেন মার্কিনি গণতন্ত্রের তথা জো বাইডেনের পক্ষে সমর্থন জোগানো তথা বিজয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও কারো কারো মনে সংশয় ছিল; জো বাইডেন কি পারবেন গণতন্ত্রের তরী ভাসাতে, তাকে ঠিকমতো চালনা করতে?
আমরা বরাবর সন্দেহ পোষণ করে এসেছি যে দুর্বল গণতন্ত্রী জো বাইডেন বুঝিয়ে বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে ঐতিহ্যবাহী রক্ষণশীলতাকে প্রশ্রয় দেন। ডেমোক্রেটদের বামধারার নৌকা বাওয়া বুঝি তার কাম্য নাও হতে পারে। বাস্তবে সেটাই আপাতত সত্য হয়ে দাঁড়াল অন্তত ফিলিস্তিনি-ইসরায়েল দ্বন্দ্বে।
ইসরায়েলি অমানবিকতার সামান্য উদাহরণ শান্তিকামী গণতন্ত্রী মানুষকে শিহরিত করে তুলবে।
একটি সংশ্লিষ্ট সংবাদ-শিরোনাম : ‘ইসরায়েলের বোমা পড়ছে হাসপাতাল-স্কুলেও’। ফলে নারী-পুরুষ-শিশুসহ বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। এটা কি ইসরায়েলের হামাসবিরোধী সামরিক অভিযানের নমুনা? যে হামলায় স্কুল ও হাসপাতাল ভবন ধ্বংস হচ্ছে, মারা যাচ্ছে রোগী, শিশু-কিশোর-ছাত্রছাত্রী। এ হামলায় কোনোভাবেই মানবিক যুক্তিতে টেকে না।
দুই.
স্বভাবতই আমরা অবাক হই, ইসরায়েলের মিত্র আরব দেশগুলোর নীরব ভূমিকা দেখে। অবাক হই তাদের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবিকতাবিরোধী নীরব ভূমিকা দেখে, যা কোনোভাবেই গণতন্ত্রের ন্যায়নীতিসুলভ নয়। বিশেষ করে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী ডেমোক্রেট পার্টির, যারা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নির্বাচনে নির্বাচনী প্রচারে গণতন্ত্রের ফুলঝুরি ছড়িয়েছেন, অনেক গণতান্ত্রিক ফুলের পাপড়ি উপহার দিয়েছেন ভোটারদের মাথায়।
এ প্রসঙ্গে একটি তির্যক বা বিতর্কিত সংবাদ শিরোনামের তাৎপর্য, ‘গাজায় ইসরায়েলি হামলায় চরমপন্থি হামাসের লাভ’! এটা কতখানি ইতিবাচক তা বিবেচনার বিষয়। যদিও বিশ্লেষকদের মতে, হামাস সমর্থক দেশগুলো এতে জোরালো মদদ পাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রচারেÑ যেমন ইরান, তুরস্ক, পাকিস্তান প্রভৃতি কট্টর ইসরায়েলবিরোধী রাষ্ট্র। তারা জাতিসংঘে ইসরায়েলবিরোধী লবি চাঙ্গা করে তুলতে চেষ্টা করতে পারে, তেমনি বিশ^জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে জোরালো আবেদন তৈরি করতে পারে, অন্তত চেষ্টা চালাতে পারে।
ফিলিস্তিনি ইস্যু এবং তার একদেশদর্শিতা আজকের নয়। সেই গত শতক থেকে এর সূচনা এবং দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে হিটলারের ইহুদি নিধনযজ্ঞ ইহুদিদের পক্ষে যে সহানুভূতির আবহ সৃষ্টি করেছিল বিশ^জুড়ে এবং বিশেষত পরাশক্তিদের মধ্যে, যে কারণে ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম, এমনকি তাতে লেনিনের সমর্থন অনেকের বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল, যেখানে ছিল যাযাবর ফিলিস্তিনিদের প্রতি অবিচার। অথচ যাযাবর ইহুদিদের সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি অনুরূপ ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধান হতো পরাশক্তির পক্ষে যৌক্তিক পদক্ষেপ।
দুর্বোধ্য কারণে তা হয়নি। ইহুদি সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি ফিলিস্তিনি সমস্যা জিইয়ে রাখা হলো। এর পেছনে চতুর ব্রিটিশ কূটনীতি কার্যকর ছিল বলে মনে হয়। এর ফলে যে ইঙ্গ-মার্কিন, বিশেষ করে মার্কিনি প্রাধান্যের যে ইসরায়েলি স্বার্থরক্ষার লবি জন্ম নেয়, তার প্রতিক্রিয়ায় সম্ভবত ফিলিস্তিনি স্বার্থের লড়াকু সৈনিক স্বনামখ্যাত গ্রান্ড মুফতি অব জেরুজালেম তার কবরে পাশ ফিরে শুয়েছিলেন।
তিন.
অতীতের কথা থাক। কিন্তু এর লিগেসি তথা অবিচারী পরিণামÑ বিশেষত ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক ভুলভ্রান্তিÑ এদের মধ্যকার মধ্যপন্থি ও চরমপন্থি বিভাজন বিশেষভাবে প্রকট হয়ে ওঠে গাজা ও পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনিদের সাময়িক বসতির সমস্যা-জটিলতার কারণে। ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন যা পারেননি, ডেমোক্রেট বার্নি স্যান্ডার্স তা পারতেন। এমনকি ট্রাম্পবিরোধী বিজয়ে পারতেন জো বাইডেন।
কিন্তু আগেই বলেছি, জো বাইডেন তার ব্যাপক গণতান্ত্রিক শক্তির সমর্থনপুষ্ট হয়েও আদর্শ নীতির অভাবে তা পারেননি। তিনি যেটুকু করেছেন, সম্ভবত পার্টির অন্তর্নিহিত চাপে, তা হলো ফিলিস্তিনি বসতি এলাকায় যুদ্ধবিরতি ও শান্তির স্থিতাবস্থা বজায় রাখার চেষ্টা করা।
কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ফিলিস্তিনি আরবরা যুদ্ধ বিরতি বা স্থিতাবস্থার সুযোগ নিতে পারেনি তাদের মধ্যকার বিভাজনের কারণেÑ ফাত্তাহ ও হামাস কখনো রাজনৈতিক চিন্তায় একমত হতে পারেনি। তাই ঐক্যবদ্ধভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে পারেনি, সাফল্য তো দূরের কথা। এ ইতিহাস আজকের নয়, তা বেশ দীর্ঘ। ফাত্তাহর অর্জন হামাস মেনে নেয়নি, যা ছিল অবিবেচনাপ্রসূত।
আমার বরাবর মনে হয়েছে, ইসরায়েলি চাতুর্যের কাছে ফিলিস্তিনি বুদ্ধিমত্তা বরাবর হার মেনেছে। ইসরায়েল যখন নমনীয় ফিলিস্তিনিরা তখন ‘নো নেগোশিয়েশন’ বলে চরমপন্থি অর্বাচীনতার উদাহরণ রেখেছে, তাতে লোকসান বই লাভ হয়নি। হামাস ছোটখাটো রকেট হামলা চালিয়ে বড়সড় ইসরায়েলি বোমাবাজির ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ক্রমে গাজায় ইসরায়েলি বসতি শুরু।
বিস্ময়কর যে, এ অন্যায় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনো পরাশক্তি তীব্র প্রতিবাদ জানায়নি। এখন রাশিয়া ও চীন ইসরায়েলি হামলা ও ভূ-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সমালোচনায় মুখর, তবে সামরিক হামলায় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নেই যেমন থেকেছে রাশিয়া সিরিয়ার পক্ষে। ওরা আন্তরিকভাবে চাইলে সমাধান সহজ হতো। তারা আমেরিকাকেও অন্তত সমর্থনে টেনে আনতে পারত। পরাশক্তির মন বোঝা বড় মুশকিল। এদের সঙ্গে কূটনৈতিক পারস্পরিকতায় ফিলিস্তিনিরা কতটা পারঙ্গম, সেও দেখার বিষয়। এখানেই ফিলিস্তিনি দুর্বলতা। ফলে কিছুতেই লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। তাদের প্রয়োজন চার হাত-পায়ে খেলাÑ কূটনৈতিক এবং সামরিক।
আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।