×

মুক্তচিন্তা

করোনাকালে সহায়তার ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ মে ২০২১, ১২:১০ এএম

ঈদের পূর্বে প্রকাশিত সংবাদমাধ্যমের একটি খবর নজর কাড়ার মতো। দেশের অন্যতম প্রধান শিল্পোদ্যোক্তা চট্টগ্রামের পিএইচপি গ্রুপ তাদের কর্মীদের ঈদুল ফিতরের একটিসহ একসঙ্গে ১১টি বোনাস দিয়েছে। ঈদুল আজহায় প্রদেয় আরেকটি বোনাস যোগ করলে বছরে কর্মীদের মোট বোনাস হবে সর্বমোট ১২টি। শিল্প গ্রুপটির রয়েছে মোট ২৭টি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন প্রায় ১০ হাজার কর্মী। এত বিপুলসংখ্যক কর্মীকে বছরে ১২টি বোনাস দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। করোনাকালে ইতোমধ্যে প্রদত্ত ১১টি বোনাস প্রদানের ঘটনা সত্যিই দৃষ্টান্ত স্থাপন করার মতো। প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, গত বছরের করোনার সময় তারা ৬টি বোনাস পেয়েছিলেন, এবার পেলেন প্রায় দ্বিগুণ। পিএইচপি গ্রুপ কেবল তার কর্মীদের পাশেই দাঁড়ায়নি, সহায়তা করেছে অন্যদেরও, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ১০ হাজার মানুষকে ১ মাসের খাদ্য সহায়তা দিয়েছে। প্রতিকূল এই সময়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানটির এমন মানবিক আচরণ তাদের কর্মীদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি যেমন আরো নিবেদিতপ্রাণ করবে, তেমনি জাতিও তাদের স্মরণে রাখবে। তারা প্রকৃতই করপোরেট আচরণ করেছে। ‘সিএসআর’ বা ‘করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি’ পালন করেছে যথার্থভাবে। সক্ষম অন্য প্রতিষ্ঠান যদি এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তাহলে কর্মীদের অধিকতর আস্থাগুণে নিজেরা লাভবান হবে, সুনাম বাড়বে, জাতিও উপকৃত হবে। পিএইচপি গ্রুপের মতো দেশে আরো অনেক বড় শিল্পগ্রুপ আছে, আছে বৃহৎ বাণিজ্যিক গ্রুপও- যাদের সামর্থ্য আছে দুর্যোগকবলিত মানুষকে সহায়তা করার। তাদের কেউ কেউ হয়তো সহায়তা করছেনও। তবে অধিকাংশই হাত গুটিয়ে রেখেছেন এ কথা সত্য। দেশের গণমাধ্যম এখন যথেষ্ট সক্রিয়, বড় ধরনের কোনো উদ্যোগের দেখা পেলে নিশ্চই তা প্রচারে কার্পণ্য করত না কেউ। উল্টো আমরা যা দেখছি তা যথেষ্ট হতাশার। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছেন অনেকেই, করোনার বিষমতার অজুহাতে কর্মীদের চাকরিচ্যুত করেছেন, বেতনভাতা কমিয়ে দিয়েছেন। দেশে অন্যান্য খাতের তুলনায় পোশাকশিল্প খাতের ব্যাপ্তি ও গুরুত্বের কথা আমরা জানি। রপ্তানি আয়ের শতকরা ৮০ ভাগের জোগানদাতা তারা, ৩০ লক্ষাধিক মানুষ এ খাতে খেটে খায়। সরকারও তাদের সুযোগসুবিধা দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী থাকে। করোনাকালের প্রণোদনা প্যাকেজে পোশাকশিল্প খাত অগ্রাধিকার পেয়েছে। ব্যাংকও তাদের পক্ষে থেকেছে তুলনামূলক বেশি। দুঃখের বিষয়, অর্থনীতিতে যথেষ্ট অবদান সত্ত্বেও দীর্ঘ ৪ দশকে খাতটি সুনামের ভাগীদার হতে পারছে না। করোনার এই দুঃসময়ে তাদের ভূমিকা অনেক প্রশংসনীয় হতে পারত। পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা তাদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে এ সময় দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারত। তেমনটি লক্ষ করা যায়নি। মালিকপক্ষ কর্মীদেরও সন্তুষ্ট রাখতে পারছেন না। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ও সজাগ কোয়ালিশন গত ৫ মে যৌথভাবে ‘করোনায় তৈরি পোশাক খাতের করপোরেট জবাবদিহিতা’ শীর্ষক এক সংলাপের আয়োজন করে। করোনাকালে করা এক সমীক্ষার ভিত্তিতে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এতে জানানো হয়, করোনার সময় শ্রমিক ছাঁটাই করে ২১.৪ শতাংশ কারখানা কোনো টাকা দেয়নি। আর ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের প্রায় ৩৬ শতাংশ আংশিক বেতনভাতা পেয়েছেন। তাছাড়া গত বছর করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় প্রায় ১০ শতাংশ কর্মী কমানো হয়েছে। চাকরি হারানো এই শ্রমিকদের খুব কমই সমমানের কাজ জুটাতে পেরেছেন। একটি অংশ যুক্ত হয়েছেন অনানুষ্ঠানিক কাজে, বাকিদের কেউ বেকার বা ছদ্মবেশী বেকার, কেউবা নিজে নিজেই কিছু একটা করার চেষ্টা করছেন। করোনাকালে রমরমা ব্যবসা করছে ওষুধশিল্প বা ওষুধের ব্যবসায়ীরা। আমাদের ওষুধশিল্প দ্রুত সম্প্রসারণশীল, বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে দেশীয় ওষুধ। কোভিড ১৯-এ ব্যবহৃত ওষুধপত্রের দাম এখন আকাশছোঁয়া, কোম্পানিমূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রয় হচ্ছে এসব ওষুধ। বেসরকারি হাসপাতালগুলো কোভিডের চিকিৎসা চালু করে অতীতের সব লোকসান একসঙ্গে পুষিয়ে নিতে চাইছে। অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে রোগীকে নিঃস্ব করে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। সরকার দেখেও দেখছে না এসব অনাচার। সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, টিকা আমদানির সুযোগ নিয়ে একটি বড় ওষুধ কোম্পানি ৫০ লাখ টিকা সরকারকে সরবরাহ করে মুনাফা করেছে ৩৮ কোটি টাকা। একে ভাবনাতীত মুনাফা বললে অত্যুক্তি হবে না। ওষুধশিল্পের মালিকরা এই দুর্যোগের সময়ে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে কি দাঁড়াতে পারত না? দাঁড়িয়েছে এমন নজির দেখছি না। করপোরেট হাউসের সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি। সে রকম দায়বদ্ধতার অস্তিত্ব নেই আমাদের এই রমরমা ওষুধশিল্প খাতে। পোশাক, ওষুধের মতো এমন আরো অনেক খাত এবং করপোরেট বাণিজ্যিক গ্রুপ আছে দেশে যাদের সক্ষমতা আছে দুর্যোগের সময় মানুষের পাশে দাঁড়াবার। দাঁড়াচ্ছেন, এ রকম দৃষ্টান্ত কম। ঝড়-তুফান, বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় অতীতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সিভিল সোসাইটি ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দুর্গত মানুষের পাশে দেখা যেত। এখন তা কমছে। করোনা ভাইরাসের ছোঁয়াচে রূপ এবং এর প্রাদুর্ভাবের দীর্ঘ স্থায়িত্ব হয়তো আগ্রহ কমাচ্ছে কিছুটা। সেই ক্ষেত্রে দায়িত্ব বেড়ে যাচ্ছে সরকারের। দুই. গত জানুয়ারি মাসে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) তাদের এক জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করে জানিয়েছিল, কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের পরিণতিতে দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি ২১ থেকে ৪২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী এই ফল প্রত্যাখ্যান করে একে অযৌক্তিক অভিহিত করেছিলেন। এদিকে গত ২০ এপ্রিল অন্য দুই গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসি (পাওয়ার এন্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার) এবং বিআইজিডি (ব্র্যাক ইনস্টিটিউড অব গভর্ন্যান্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট) তাদের করা যৌথ জরিপের ফলাফল তুলে ধরে জানায় যে দেশে নতুন করে ২ কোটি ৪৫ লাখ লোক দরিদ্র হয়েছে। জরিপের এসব তথ্য যা-ই জানান দিক এ কথা নিশ্চিত যে কোভিডের কারণে মানুষ ব্যাপকহারে দরিদ্র হয়েছে, অন্তত দারিদ্র্যসীমার সামান্য ঊর্ধ্বে যেসব মানুষের অবস্থান ছিল তাদের একটা বৃহৎ অংশ নিচে নেমে গেছে। সরকার যদি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর জরিপভিত্তিক এসব তথ্যে আস্থা রাখতে না পারে তাহলে নিজেরা যাচাই করে দেখতে পারে। সরকারি পরিসংখ্যান ব্যুরো আছে এসব কাজের জন্য, তাদের ব্যবহার করা যেতে পারে। সত্য উদ্ঘাটন ও তা মেনে নেয়া প্রতিকারের উপায় খোঁজার জন্য জরুরি। সেটি না করা হলে ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে হতে পারে। গত বছর সরকারের তরফ থেকে ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে নগদ আড়াই হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তা প্রদান করার কথা ছিল। কিন্তু তথ্যভাণ্ডারের অপূর্ণাঙ্গতার দরুন ৩৫ লাখের বেশি পরিবারকে সহায়তা প্রদান সম্ভবপর হয়নি। তথ্যভাণ্ডারের ত্রুটি বছরেও সারানো যায়নি, ফলে এ বছরও ৩৫ লাখ পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে সমপরিমাণ অর্থ সহায়তা প্রদানের কার্যক্রম। এর মর্মকথা এই যে বিপদ ঘাড় থেকে নামতে না নামতেই আমরা ভুলে যাই পূর্বের ভুলত্রুটির কথা। করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় সরকারি সহায়তার পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ের সহায়তাও মিলেছিল বেশ। দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় বেসরকারি সহায়তা চোখে না পড়ার মতো। সামনে তৃতীয় ঢেউয়ের কথা শোনা যাচ্ছে, সে সময় হয়তো বেসরকারি সহায়তা একেবারেই চোখে পড়বে না। সরকারকে এককভাবেই দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য মোকাবিলা করতে হতে পারে। সঠিক তথ্যভাণ্ডারই যদি না থাকে তাহলে সহায়তা কার্যক্রম কী করে ফলপ্রসূ হবে?

মজিবর রহমান : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App