×

মুক্তচিন্তা

হোস্ট কমিউনিটির জন্য অশনি সংকেত!

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ মে ২০২১, ১২:০৯ এএম

২০২০ সালে মার্চের ৮ তারিখ বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিস্থিতি কী ভয়াবহ হতে পারে, তা নিয়ে আমি ভীষণ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছিলাম। এটার মূল কারণ ছিল, উখিয়া ও টেকনাফে নির্মিত ৩৪টি অস্থায়ী শরণার্থী ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ঘনবসতিপূর্ণ আবাসন এবং তাদের গাদাগাদি করা জীবনাচার ব্যবস্থা। তাছাড়া স্বাস্থ্য সচেতনার বিবেচনায়ও যেহেতু রোহিঙ্গারা খানিকটা পিছিয়ে, সেহেতু তাদের পক্ষে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল ছিল। কিন্তু ঢাকা এবং চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায় যে মাত্রায় সংক্রমণ হয়েছে গত এক বছরের অধিক সময় ধরে, সে তুলনায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা এবং হার তুলনামূলকভাবে অনেক কম হওয়ায় খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার খবর নিঃসন্দেহে উদ্বেগের। ফলে এ সংক্রমণ রোধে তরিত ব্যবস্থা নিয়ে যে পাঁচটি ক্যাম্পে বিশেষ লকডাউনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে সেটা নিঃসন্দেহের প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু কেন হঠাৎ করে সংক্রমণ বেড়ে গেল, সেটা জানাটা যেমন জরুরি, তেমনি সংক্রমণের পরিমাণ যেন আর না বাড়ে সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত ৩৪টি শরণার্থী ক্যাম্পে প্রায় ৪২ হাজার ১৮৬ জন রোহিঙ্গাকে করোনার টেস্ট করা হয়েছে, এর মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা হচ্ছে ৯৯৭ জন এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১২ জন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ২০২০ সালের মে মাসে। কিন্তু হঠাৎ করে ২০২১ সালের মে মাসে এসে ক্যাম্পে সংক্রমের পরিমাণ বেড়ে যায়। যেমন এক হিসাব অনুযায়ী, যে কারণে ২০ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত বিশেষ লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে, ১৪ থেকে ২০ মে পর্যন্ত এক সপ্তাহের মধ্যে ক্যাম্পগুলোতে করোনা রোগী শনাক্ত হয় প্রায় ১৬৫ জন। যেখানে পুরো এক বছরের শনাক্ত হয় ৯৯৭ জন সেখানে এক সপ্তাহে শনাক্ত হয় প্রায় ১৬৫ জন, যা পরিষ্কারভাবে সংক্রমণ প্রবৃদ্ধির আশঙ্কাজনক ইঙ্গিত দেয়। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে ৩৪টি ক্যাম্পের মধ্যে সংক্রমণের সংখ্যা এবং তীব্রতা বিবেচনায় কুতুপালংয়ের ক্যাম্প ২, ৩, ৪, ১৫ এবং ২৪-এ ২০ মে থেকে ১২ দিনের জন্য বিশেষ লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এ পাঁচটি ক্যাম্পে মোট রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। অনেকে বলছেন, এদের প্রত্যেক রোহিঙ্গাকে টেস্ট করে আক্রান্তদের বের করে দ্রুত চিকিৎসা দিতে হবে। কিন্তু সেটা কতটা বাস্তবসম্মত, তা বিবেচনার দাবি রাখে। যেমন, এখানে প্রতিদিন ২০০-এর বেশি মানুষকে টেস্ট করা সম্ভব নয়। যদি প্রতিদিন ২০০ করে টেস্ট করা হয়, তাহলে এক লাখ টেস্ট করতে লাগে ৫০০ দিন আর আড়াই লাখকে টেস্ট করতে লাগবে ১ হাজার ২৫০ দিন। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে তিন বছর। এ গেল মাত্র ৫টি শরণার্থী ক্যাম্পের অবস্থা। আর এভাবে যদি ৩৪টি ক্যাম্পের ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে টেস্ট করতে হয়, তাহলে লেগে যাবে এক দশকেরও বেশি সময়। সুতরাং সবাইকে করোনা টেস্টের আওতায় আনা একটা অবাস্তব এবং অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু রোহিঙ্গাদের মধ্যে টেস্ট করানোর প্রবণতা একেবারেই নেই বললেই চলে। আবার যাদের মধ্যে সামান্য করোনার উপসর্গ দেখা যায়, তারাও স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে দূরে থাকে এবং নিজেদের উপসর্গ লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। ফলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি। সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কথা হচ্ছে, ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠী নিয়মিত মেলামেশার একটা পরিসর উখিয়া এবং টেকনাফের সর্বত্র লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন হাট-বাজারে, ক্যাম্পগুলোর ভেতরে এবং বাইরে, দোকানপাটের নানা বিকিকিনিতে, নিত্যদিনের নানা উপলক্ষে  রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয় জনগণের মেলামেশার একটা পরিসর সক্রিয়ভাবে বিদ্যমান। ফলে রোহিঙ্গাদের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান সংক্রমণের প্রবণতা স্থানীয় জনগণের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ার একটা প্রবল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তাই যদি শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে সংক্রমণ রোধ করা না যায়, তাহলে উখিয়া ও টেকনাফের অবস্থা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো লক্ষণ, ইচ্ছা ও প্রবণতা নেই। নিয়মিত মাস্ক পরা, স্যানিটাইজার দিয়ে বা সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করা কিংবা সামাজিক (শারীরিক) দূরত্ব মেনে চলার কোনো বালাই নেই। অবশ্য শুধু রোহিঙ্গাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, কেননা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোর যে আবাসন-ব্যবস্থা, ক্যাম্পগুলোর কাঠামোগত বিন্যাস এবং একই ঘরে অনেক মানুষের বসবাস করার যে ব্যবস্থা সেখানে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে কতটা মানা সম্ভব সেটাও একটা বড় প্রশ্ন বটে। তথাপি করোনা ভাইরাসের বাংলাদেশের সংক্রমণ বৃদ্ধির শুরু থেকেই সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে করোনা টেস্টের ব্যবস্থা, আইসোলেশন সেন্টার তৈরি, কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা, অস্থায়ী হাসপাতাল স্থাপন প্রভৃতির একটা সুব্যবস্থা করা হয়েছিল, যাতে করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে করোনা ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে না পড়ে। এবং সেটা অনেক ক্ষেত্রে বেশ সফলও হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালের সংক্রমণের প্রবৃদ্ধি সত্যিই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। তাই ১২ দিনের এ বিশেষ লকডাউনের সিদ্ধান্ত যাতে সত্যিকার ফলপ্রসূ হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। যাতে অন্য ক্যাম্পের কোনো রোহিঙ্গা এ ৫টি ক্যাম্পে কোনোভাবেই প্রবেশ করতে না পারে আবার এ ক্যাম্প থেকে কোনো রোহিঙ্গা যেন কোনোভাবেই বের হয়ে অন্য ক্যাম্পে না যেতে পারে সেদিকে কঠোর নজরদারি জারি রাখতে হবে। পাশাপাশি যেসব রোহিঙ্গা সম্প্রতি সংক্রমিত হয়েছে, তাদের সঙ্গে কার কার কোথায় কোন অবস্থায় সংযোগ এবং মেলামেশা হয়েছে, তার যদি কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করা সম্ভব হয়, তাহলে খুব সহজেই এবং দ্রুততম সময়েই করোনার সংক্রমণ যাতে আর না বাড়ে সে ব্যাপারে কার্যক্রম পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে। যেমন, কন্ট্রাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে যদি কিছু রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়, তাহলে তাদের ক্যাম্পে অবস্থিত অস্থায়ী আইসোলেশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া যাবে যাতে করে তাদের মাধ্যমে অন্য কারো কাছে এ ভাইরাসে সংক্রমিত না হয়। এছাড়া হোস্ট কমিউনিটির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মেলামেলাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে করে ক্যাম্পের সংক্রমণ স্থানীয় জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে না পড়ে। কক্সবাজারের করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ কমিটির একটি দাবি আমার কাছে খুবই যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে যে, ৩৪টি ক্যাম্পের ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার সবাইকে করোনা টেস্ট করা সম্ভব না হলেও তাদের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গাকে রেন্ডম-সেম্পলিং বা দ্বৈবচয়ন পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচন করে যদি টেস্ট করানো যায়, তাহলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংক্রমণের একটা চিত্র পাওয়া যাবে। এবং ক্যাম্পে সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সেটা জরুরি। এখানে মনে রাখা জরুরি যে, রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণের জন্য আন্তর্জাতিক অনেক সাহায্য সংস্থা কাজ করছে কিন্তু যদি করোনা সংক্রমণের কারণে রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটা বড় ধরনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে তার দায়-দায়িত্ব বাংলাদেশকেই নিতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা এবং সংকট সৃষ্টির পেছনে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা না থাকলেও বাংলাদেশই এ সংকট এবং সমস্যার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। তথাপি যতদিন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আছে, তাদের দেখভাল ও নিরাপত্তার দায়িত্ব বাংলাদেশের। এ দায়দায়িত্বের জায়গা থেকেই রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে করোনার হানা বাংলাদেশের জন্য সুখবর নয়। এবং হোস্ট কমিউনিটির জন্য এটি একটি অশনি সংকেত। পরিশেষে বলব, করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে বাংলাদেশ এমনিতেই বড় সমস্যার মধ্যে পড়েছে। ভারতের করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহ রূপ লাভ করার কারণে বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুত ভ্যাকসিন দিতে পারছে না। বাংলাদেশ চীন এবং রাশিয়ার টিকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও আবেদন করেছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সে অবস্থায় সব রোহিঙ্গাকে ভ্যাকসিন দেয়ার চিন্তা করা এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশ থেকে (যেখানে চাহিদার অতিরিক্ত মজুদ আছে যেমনÑ কানাড, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের কিছু দেশ) শরণার্থীর বিশেষ কোটায় সব রোহিঙ্গাকে ভ্যাকসিন দেয়ার ব্যবস্থা করা যায় কি না, তার একটা সক্রিয় উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। গত ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে ইউএনএইচসিআর বিশ্বব্যাপী শরণার্থীদের ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য একটা আবেদন পেশ করেছে। এবং ইতোমধ্যে সার্বিয়া, জর্ডান, নেপাল এবং রওয়ান্ডাতে শরণার্থীদেরও ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হয়েছে। সুতরাং উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করা বাংলাদেশের নয়, বরঞ্চ শরণার্থীদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে দায়িত্ব ও কর্তব্য তার মধ্যেই পড়ে। অতএব রোহিঙ্গা ক্যাম্পে লকডাউন, রেন্ডম সেম্পলিং, টেস্ট বৃদ্ধি, কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন প্রভৃতি কঠোরভাবে কার্যকর করার মাধ্যমে একদিকে যেমন করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে, অন্যদিকে রোহিঙ্গাদেরও ভ্যাকসিনের আওতায় আনার জন্য ইউএনএইচসিআরসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও দায়বদ্ধ করার একটা সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এতেই শরণার্থীদের পাশাপাশি হোস্ট কমিউনিটিরও সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App