×

মুক্তচিন্তা

একজন উপাচার্য ও একজন উপসচিবের কেচ্ছা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ মে ২০২১, ১২:০৮ এএম

একজন উপাচার্য কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাথা নন, একটি সুশৃঙ্খল জাতির বিবেক এবং অভিভাবকও। বহুবার বুঝাতে চেষ্টা করেছি, বলেছিও যে, দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ইত্যাদি সামাজিক অবক্ষয়ের একটি অন্যতম কারণ হলোÑ রাষ্ট্রে সুষ্ঠু ও সুস্থ শিক্ষা ব্যবস্থা না থাকা, সঠিক ব্যক্তির নিয়োগ না হওয়া এবং সংশ্লিষ্টদের এই ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগী না হওয়া। শিক্ষার্থীরা কী শিখে বেড়ে উঠছে, কেমন পরিবেশে শিখছে, কতটা যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি শিক্ষাদানের কাজটি করছেনÑ এসব বিষয় একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয় হওয়ার কথা। না বললে নয় যে, যে রাষ্ট্র বেশি রকম শিক্ষা ও শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং তার সুরক্ষার কাজে তৎপর থাকে, সেই রাষ্ট্রে সামাজিক অবক্ষয় তথা অপরাধ প্রবণতা অপেক্ষাকৃত বেশ কম এবং জাতীয়তাবোধ, দেশপ্রেম প্রবল। কথাটার যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যাবে যদি উন্নত দেশগুলোর প্রতি আমরা নজর দেই। দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই যে, আমাদের দেশে শিক্ষা কারিকুলাম, শিক্ষার পরিবেশ যথেষ্ট যেনতেনভাবে এবং অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব পেয়ে চলছে। ফলে দায়িত্বশীল ব্যক্তির ইচ্ছা মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলে। যার আরো একটি জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত সম্প্রতি স্থাপন করে গেলেন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে উপাচার্য। শেষ কর্র্মদিবসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ১৪১ জনকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে পুলিশি পাহারায় ক্যাম্পাস ছাড়লেন তিনি। রীতিমতো ফিল্মি কায়দায়। বৈধতার পথ অনুসরণ করে নয়, বরং তিনি মানবিক কারণে এই কাজটি করেছেন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। দাবিও করেছেন। এই মানবিক কারণের ভেতর যারা তার মহানুভবতা পেয়েছেন তারা হলেন তারা নিকট আত্মীয়স্বজন, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাংবাদিক প্রমুখ। মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তিনি এই জাতীয় মানবিক হওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। স্বজনপ্রীতি করেছেন। এসব অনিয়মকে তিনি মানবতার চাদরে মুড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টায় মোটেও লজ্জিত হলেন না। বরং দাপটে দেখালেন। সবই করলেন পুলিশি পাহারায়। চমৎকার! রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে উপাচার্য তার কর্মজীবনের বিদায়বেলায় যে ঘটনাটি ঘটিয়ে গেলেন তার পেছনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পূর্বের কোনো দায়িত্বশীলদের কোনো গাফলতি, উদাসীনতা কিংবা প্রশ্রয় ছিল কি না তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। নতুবা লাগাতার অনিয়মের অভিযোগ মাথায় নিয়ে তিনি উপাচার্য হিসেবে বহালতবিয়তে শেষ কর্মদিবস পর্যন্ত পৌঁছান কী করে। সেই সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কোন সাহসে যাওয়ার বেলায় নিয়োগ দেয়ার ধৃষ্টতা দেখালেন? তিনি ভীত ছিলেন না মোটেও মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করতে, অন্তত এটা পরিষ্কার। মনস্তাত্ত্বিকভাবে দেখলে বলা সহজ হয় যে, ব্যক্তি কোনো না কোনোভাবে সাহস সঞ্চয় করলে তার সাহসের ভীত মজবুত হয়। এমন সাহস থেকে এক পর্যায়ে তিনি দুঃসাহসী হয়ে ওঠেন। মানুষ তৈরির কারখানাগুলোয় এমন দুঃসাহস ও ধৃষ্টতা উৎপাদন হচ্ছে অবলীলায়। এবার আসি একজন উপসচিবের কথায়। সম্প্রতি প্রথম আলোর একজন সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব অভিযোগ করেছেন যে, মন্ত্রণালয়ের গোপনীয় কাগজপত্রের ছবি তুলেছেন, কিছু কাগজপত্র ব্যাগে ঢুকিয়েছেন তিনি। যা মন্ত্রণালয়ের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করেছে। উক্ত সচিবালয় থেকে অভিযোগ উঠেছে এমন যে, রোজিনা ইসলাম দুটি দেশের সঙ্গে ভ্যাকসিন ক্রয়ের গোপন নথি চুরি করেছেন। প্রায় ৬ ঘণ্টা রুমে আটকে নানান প্রক্রিয়ায় হেনস্তা, শারীরিক নির্যাতন করে তাকে থানা এবং অবশেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে তাতে রোজিনা ইসলামকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। একজন নারী আমলা রোজিনা ইসলামের ওপর যেভাবে চড়াও হয়েছে তাতে যদি বলা হয় যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কেবল দুর্নীতিবাজই থাকে না, রংবাজও থাকে, তাহলে বোধহয় ভুল বলা হবে না। ছবিতে দেখা গেল একজন সিনিয়র নারী সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে বিপুল পুলিশি বেষ্টনীতে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জঙ্গি ও সাংঘাতিক সন্ত্রাসীদের সাধারণত যেভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। অস্ত্র নয়, কলমই রোজিনার হাতিয়ার। আর পুলিশের আচরণে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, অস্ত্রের চেয়ে কলমই অধিক শক্তিশালী। আর যিনি কলম ধরেন তিনি তারও চেয়ে অধিক শক্তিশালী। পার্থক্য ছিল, রোজিনা ইসলামকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরানো হয়নি। এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথম প্রশ্ন, দুটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের করোনার ভ্যাকসিন ক্রয়ের নথি ‘গোপন’ হয় কী করে। আর ‘গোপন’ হলেও তা অরক্ষিত অবস্থায় সচিবের এপিএসের টেবিলে থাকে কী করে। ওটা তো মন্ত্রণালয়ের সিন্দুকে থাকার কথা। আর চুক্তি নথির তথ্য জানার অধিকার তো জনগণের থাকার কথা, নাকি নথিতে যা আছে তা জনগণ জানলে শাহেদ আর সাবরিনার মতো কিট কেলেঙ্কারির বিড়াল আবার বেরিয়ে আসবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, সচিবালয়ে প্রবেশ করা কঠিন বিষয়। সাংবাদিকের আইডি তো প্রবেশের পাস হতে পারে না। সরাসরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের এপিএসের রুমে প্রবেশ করাটা নিশ্চয়ই রোজিনা ইসলামের একক ক্ষমতা নয়, তাহলে? কিছুদিন আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কিছু কর্মকর্তা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন এবং এ কারণে রদবদলও হয়েছে। পূর্ববর্তীদের প্রতি দুর্বল কেউ রোজিনা ইসলামের কাছে কোনো গোপন তথ্য ফাঁস করেনি তো দুর্নীতি আজো বহালতবিয়তে আছে এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে? এটা তো সত্যি যে, রোজিনা ইসলামের রিপোর্টিং সবসময়ই দুর্নীতি আর দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ছিল। সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি প্রকৃতার্থে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েই থাকেন, তাহলে তো রোজিনার গায়ে আঁচড় পড়ার কথা নয়, তাই না? রোজিনা ইসলাম তো সরকারের সেই তৃতীয় চোখ, যা সরকার সহজে দেখতে পান না, রোজিনা ইসলাম তা সহজেই দেখিয়ে দেন। তাহলে? তৃতীয় প্রশ্ন, সচিবালয়ের ভেতর এমন ঘটনা অতীতে ঘটেছে বলে প্রাক্তন সচিবদের কেউ কেউ মনে করেন না। তারা লজ্জিত হয়েছেন বর্তমান গুটিকয়েক সরকারি কর্মকর্তার আচরণে। একজন সিনিয়র সাংবাদিকের সঙ্গে এমন হিংস্র আচরণ বর্তমান সচিবালয়ের প্রকৃত অবস্থা উন্মোচন করে কি না, সরকারি আচরণ বিধিতে তা সম্মত কি না? সাংবাদিকদের সঙ্গে আচরণবিধি যেটা বর্তমান সরকার কর্তৃক পাসকৃত তা সরকারের সব আমলা অবগত আছেন কি না? চতুর্থ প্রশ্ন, সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম প্রথম আলোয় কর্মরত। প্রথম আলোর প্রতি মাঝেমধ্যেই সরকারের ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখি। রোজিনা সেই ক্ষোভের শিকার কি না। হলে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। সরকার সঠিক তথ্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে নিঃসন্দেহে। কারণ সরকার সমর্থক পত্রিকা বা মিডিয়া থেকে সরকার কখনোই নিরপেক্ষ তথ্য পাবে না। পঞ্চম প্রশ্ন, একজন সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম নিজের চেষ্টায় তার জায়গা করেছেন। সংবাদ তৈরি ও পরিবেশনার জন্য তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে। অনেক বছর সাংবাদিকতার পেশায় থেকেও যারা সেটা অর্জন করতে পারেননি। সেই অর্জন বুঝবার ক্ষমতা, বোধ সবার আছে তো? বোধহয় নেই। যেভাবে কতিপয় আমলা তার ছবি মোবাইলে রেকর্ড করছিলেন তাতে মনে হয়েছে রোজিনা ইসলামকে সামাজিকভাবে হেয় করার জন্য চেষ্টা চালানো হয়েছে। ভাইরালকৃত ভিডিওতে শুনলাম, রোজিনা ইসলাম আকুতি নিয়ে বলছেন, আমি তো খারাপ কেউ নই! প্লিজ ভিডিও করে আমার ছবি কেউ ফেসবুকে দেবেন না! কী করুণ আকৃতি তার! আহা রাষ্ট্র, তুমি তোমার যন্ত্রে কাদের বসিয়েছ? সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বলছিলেন, তাকে বলা হয়েছিল যে, কেউ রোজিনা ইসলামের গায়ে হাত দেননি। তিনি বলা কথায় বিশ^াস করেছেন। ভালো কথা। তিনি কী রোজিনা ইসলামের বলা কথায় বিশ^াস করবেন? যদি জবাবে বলেন, হ্যাঁ। তাহলে বুঝব তিনি শুধু আমলা নয়, বরং সব জনগণেরই অভিভাবক। এমন প্রতিক্রিয়া প্রকাশের সুযোগ রাখবেন তো মাননীয় মন্ত্রী? সম্ভবত তথ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বললেন, সহানুভূতি নিয়ে রোজিনা ইসলামের বিষয়টি দেখা হবে। মানে? সহানুভূতি কেন, অধিকার নয় কেন? নারী বলেই কী সহানুভূতির কথা উঠেছে? রোজিনা ইসলাম কিন্তু সাংবাদিক পরিচিতি নিয়েই কাজ করেছেন, নারী হিসেবে নয়। নারীকে করুণা করতে করতে কতটা অসম্মানিত করা হয় এবং হচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্লিজ, সহানুভূতি নয়, অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখুন মাননীয় মন্ত্রী। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছিলেন, গুটিকয়েক আমলার কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্ষুণ্ন হয়েছে। সন্দেহাতীতভাবে সত্য। জাতিসংঘের মহাসচিব এবং বিশে^র ১৩৯টি পত্রিকায় প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হয়েছে। প্রশ্ন, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য সেই গুটিকয়েক আমলার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হবে কি না। একজন উপসচিবের দুঃসাহস ও ধৃষ্টতার পেছনের ইতিহাস জানা দরকার। যদি না সত্যিকারার্থে আমরা দুর্নীতিকে জিরো টলারেন্সে নিয়ে আসতে চাই। পরিশেষে বলি, এমন একজন উপাচার্য ও এমন একজন উপসচিব, ব্যক্তিগত সচিবই যথেষ্ট বর্তমান সরকারকে বিব্রত করার জন্য, সরকারকে সমালোচিত করার জন্য এবং সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা হারানোর জন্য। অবাক হই, সচিবালয়ে এমন কোনো সিনিয়র লোকজন ছিলেন না যারা কি না মেধা ও সরকারের আচরণবিধি বলে বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করতে পারতেন? উপাচার্য ও উপসচিবের নেপথ্য উদঘাটন হলে সম্ভবত সরকার অপেক্ষাকৃত কম বিব্রত হবে। ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার প্রশ্নও তখন উঠবে না। স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App