×

মুক্তচিন্তা

সরকার ও গণমাধ্যম মুখোমুখি নয় পাশাপাশি পথ চলতে হবে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২১, ১২:১২ এএম

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এম আবদুল মোমেন বলেছেন, ‘বাংলাদেশে লুকানোর কিছু নেই।’ মানবিক, স্বচ্ছ, উন্নত ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলায় এটাই সবার স্পিরিট হওয়া উচিত। বিশেষ করে আমলাতন্ত্রের। বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র যতটা স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত, মানবিক এবং জবাবদিহিমূলক হবে তত দ্রুতই দেশের উন্নয়ন সম্ভব। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বিগত এক যুগে তার শাসনামলে বাংলাদেশ কোথায় পৌঁছেছে তা আজ সবারই জানা। সচেতন ব্যক্তিমাত্রই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থানটি নির্ণয় করতে পারেন। নির্ণয় করতে পারেন বিদ্যমান কী অবস্থা থেকে সামগ্রিকভাবে দেশটির সাম্প্রতিক এই অবস্থান্তর! নির্ণয় করতে পারেন এগিয়ে যাওয়া এই বাংলাদেশের পশ্চাতের শক্তি এ দেশেরই জনগণের বিচিত্র কর্মযজ্ঞের বৈচিত্র্যপূর্ণ সাফল্য। আরো নির্ণয় করতে পারেন জননেত্রী শেখ হাসিনা সামনে থেকে সব কর্মোদ্যোগকে শতধাবিস্তৃত প্রেরণায় বিচিত্র পেশাগোষ্ঠীর শ্রম ও ঘামের ফসলকে সমন্বিত করেছেন। সৃষ্টি করেছেন উপযুক্ত কর্মপরিবেশ। অদম্য স্পৃহা-সঞ্চারী মনোভাবের মাধ্যমে দেশবাসীকে একটি স্বপ্নের লক্ষ্যে ধাবিতও করেছেন তিনি। এই নেতৃত্বগুণের কারণে দেশবাসী তাকে যেমন নির্ভরতার স্থান ভাবেন তেমনি বিশ্ববাসীও তাকে সমীহ করেনÑ তেমনি বাংলাদেশকেও সম্মানের চোখে দেখেন। বাংলাদেশের পক্ষে এ অর্জন যে গৌরব ও অহংকারের তাও সবার জানা। শেখ হাসিনার দেখানো স্বপ্নের পথ ধরেই আমরা ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি দেখতে চাই। দারিদ্র্যের বেশভূষা পরিত্যাগ করে পৌঁছতে চাই উন্নত রাষ্ট্রে। দেশবাসীর অন্তরে গভীরভাবে লালিত এই স্বপ্ন। এই স্বপ্ন বুকে ধারণ করে দেশের প্রতি নিমগ্নচিত্তের প্রকাশও ঘটাতে হবে। ব্যত্যয় হলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এবং শেখ হাসিনার উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে যাবে। স্বপ্নকে হাতের মুঠোয় আনতে চাই, আমাদের স্বপ্ন চলতিপথেই ভেঙে খানখান হয়ে যাবে তা চাই না। একদল মানুষ নানাভাবে জননেত্রীর স্বপ্নকে বিভ্রান্ত প্রতিপন্নের চেষ্টায় সাধারণের সম্মুখে সরকারের বিতর্কিত ভাবমূর্তি উপস্থাপনে তৎপর! এরা সরকারের বাইরে যেমন আছে তেমনি সরকারের একেবারে ভেতর মহলেও আছে। সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সচিবালয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সৃষ্ট ঘটনা সরকারকে ভেতর থেকে যেমন সমালোচনার মধ্যে ফেলেছে তেমনি বাইরে থেকেও প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুলেছে। বিদেশিদের কাছে বিশেষত বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী অনেক রাষ্ট্রের কাছেই বিভ্রতকর এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। ইতোমধ্যে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি অনুধাবন করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের কাছে অকপটে স্বীকারও করেছেন বিদেশিদের প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা। গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দক্ষিণ কোয়িার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তারকে ‘এটি অনভিপ্রেত এবং দুঃখজনক ঘটনা। আমি আশা করব এ ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে’Ñ বলে মন্তব্য করেছেন। এই পরিস্থিতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মোকাবিলা করতে হবে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সৃষ্ট ঘটনায় আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে কিনা?Ñ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘যে ঘটনা ঘটেছে সেটি খুব দুঃখজনক। সেটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ম্যানেজ করা উচিত ছিল। গুটিকতক লোকের জন্য এই বদনামটা হচ্ছে এবং আমি জানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হিসেবে আমাদের এটি ফেস করতে হবে।’ প্রসঙ্গত পররাষ্ট্রমন্ত্রী দলীয় সাধারণ সম্পাদক এবং যুগ্ম সম্পাদকের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সংবাদমাধ্যম দেশের জন্য বিরাট কাজ করেছে। সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণেই দেশবাসী বালিশকাণ্ডের কথা শুনেছে, লাখ টাকার সুপারি গাছের কথা শুনেছে। সাহেদ করিমের কথা শুনেছে। আর এসব প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকার ব্যবস্থাও নিয়েছে।’ সাংবাদিকদের ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, এসব আপনারা সরকারকে খুব সাহায্য করেছেন। রোজিনাকে নিয়ে সৃষ্ট সংকট সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট বলেন, ‘এটি খুবই দুঃখজনক। কারণ শেখ হাসিনার সরকার সংবাদবান্ধব সরকার। আমরা কখনোই আপনাদের নিষেধ করি না।’ এটি বাস্তবই। এই বাস্তবতা দলীয় অনেক নেতকর্মীসহ অনেক মন্ত্রী এমনকি সাবেক বড় বড় আমলাও স্বীকার করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক, প্রজাতন্ত্রের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন আমলাসহ মন্ত্রী নিজেও বিষয়টি বাস্তবতার আলোকে উপলব্ধি করতে চাইছেন না! বরং বাস্তবতার বিপরীতে ‘অতি গেঁয়ো’ আচরণেরই পরিচয় দিয়েছেন! তিনি একপাক্ষিক বিবরণ শুনে জনসমক্ষে মন্তব্য করেছেন ‘রোজিনা অতিরিক্ত সচিব জেবুন্নেসাকে খামচি দিয়েছে!’ এই যদি হয় দেশের একজন মন্ত্রীর মুখের বচন তাহলে দেশবাসীর দুঃখের শেষ কোথায়, কে জানে? এমন রুচিহীন মন্ত্রীদের নিয়ে ২০৪১ সাল পর্যন্ত এ দেশের সমৃদ্ধির অভিযাত্রা কেমন হবে তাও ভেবে পাই না! সচিবালয়ের ভাইরাল হওয়া দৃশ্যে আমরা এক সেকেন্ডের জন্যও রোজিনাকে মারমুখী হতে দেখিনি। অথচ তার প্রতি তেড়ে আসায় সচিবালয়ের অনেককেই মারমুখী দেখা গেছে। ধরা যাক রোজিনা সাংবাদিক নন। একজন অতি নিম্নমানের ছিঁচকে চোর! চোর হলেও কোনো অতিরিক্ত সচিব কিংবা তার কোনো সহকর্মী রোজিনার গায়ে হাত দেয়ার অধিকার রাখেন কিনা এটা এখন ‘জাতীয় সম্ভ্রমের’ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বর্ষেও এ দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গকে এই শিক্ষা দিতে হবে যে, সব নারীর সম্ভ্রম রাখতে হবে, রাখতে হবে আমাদের জাতীয় সম্ভ্রমও! একজন নারীকে একটি কক্ষে ৬ ঘণ্টা আটকে রেখে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও হেনস্তার অভিযোগে এই মুহূর্তে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। তাদের এই মুহূর্তে আইনের আওতায় আনার কোনো আইনগত ভিত্তি কি এখনো তৈরি হয়নি? কোনো আইনি উপায় কি আমাদের দেশে নেই যে, একটি কক্ষের ভেতর একজন নারীকে ৬ ঘণ্টা জোরপূর্বক আটক রাখার ঘটনার বিচার সম্পন্ন করে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিউৎসাহী কর্মকর্তারা এ স্পর্ধা কোথায় পেল! স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে যদি সতীত্বের পারাকাষ্ঠা প্রমাণ করতে পারত তাহলে হয়তো তাদের ‘বাড়াবাড়ি’ কিছুটা সহ্য করা যেত। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে আছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়Ñ দুর্নীতির খবর পত্রিকার পাতায় পাতায়! কিন্তু সাহস করে সেসব প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করতেও তো দেখা যায়নি এতদিন! অর্থাৎ প্রমাণ হয়ে গেছে তাদের স্ব-স্ব দুর্নীতিই সেই সৎ-সাহসকে পঙ্গু করে দিয়েছে! রোজিনা ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত সচিবের সম্পদের যে বিবরণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সয়লাব হয়ে গেছে সে সম্পর্কে দুদকের অনুসন্ধানও কম জরুরি নয়। বর্তমান সরকার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের লক্ষ্যে তৎপর থাকলেও আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঔপনিবেশিক আমলের এবং প্রায় শতবর্ষ পুরনো জীর্ণশীর্ণ একটি কালাকানুন আবিষ্কার করেছে! বাহ! স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বাহ! জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবদ্দশায় বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রকে ঔপনিবেশক প্রবণতা থেকে মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু হায়! ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমরা কেবল বঙ্গবন্ধুকেই হারাইনি, হারিয়েছি একজন আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক দর্শনের প্রবক্তা হিমালয়সম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেও! অসময়ে জাতির পিতাকে হারিয়েছি বলেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণেও আমরা ঔপনিবেশিক হীনমন্যতা থেকে মুক্ত হতে পারলাম না, আফসোস! আমরা দার্শনিকভাবেও উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলাম যে, ডিজিটাল বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক আইনের প্রয়োগ একেবারেই সাংঘর্ষিক উপরন্তু, অনেক ক্ষেত্রেই তা অমানবিক। রোজিনার ঘটনায় আমরা সেই অমানবিকতার দানবীয় রূপটি দেখতে পেলাম। ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করা কারো একার পক্ষে সম্ভব নয়। সবাইকে নিয়েই সেই সমৃদ্ধি অর্জন করতে হবে, ভোগও করতে হবে সবাইকে। সাংবাদিক কিংবা প্রশাসন তথা আমলাতন্ত্রকে মুখোমুখি দাঁড় করানো যাবে না। পাশাপাশি পথ চলতে হবে। তথ্য লুকানো-ছাপনোর মধ্যে রাষ্ট্রের খুব নগণ্য কল্যাণই নিহিত থাকে। সত্য ও ন্যায়কে কে গোপন করে? নিশ্চয়ই অন্যায় ও অসঙ্গত এমন কিছু ছিল, যা প্রজাতন্ত্রের আমলাগণ ‘সিক্রেট’ হিসেবে আগলে রেখেছিল। আর প্রকাশের ভয়ে রোজিনার বিরুদ্ধে আমলাদের মামলা হলো ‘অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টে’! সাধারণের ধারণা এমন অনেক বিষয় আছে, যা জনসম্পৃক্ততা এবং বহুজনের মতামতের ভিত্তিতে গৃহীত হলে তা বস্তুনিষ্ঠ হয়। দুর্ভাগ্যজনক ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র আমলাদের একটি বিষয়ই শিক্ষা দিয়েছে যে, আমলারাই শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, তাদের মতো জ্ঞান আর কোথাও ধরে না! উপমহাদেশীয়দের ‘শাসন’ করার জন্য ব্রিটিশ শাসকদের এরূপ আইন দরকার ছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও ব্রিটিশ আইনের অন্ধ অনুসরণ আমাদের প্রকৃত উন্নতি ও সমৃদ্ধি দিতে পারে না। ২০৪১ সাল পর্যন্ত যদি এরূপ কালো আইন কার্যকর থাকে তবে তখন উন্নত রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি সাধারণ মানুষকে কীভাবে স্পর্শ করবে জানি না! আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রণীত সংবিধানে মত প্রকাশের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। আলাদা প্রেস কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। তাই সাংবাদিকতার সঙ্গে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। এটি সাংবাদিকতার পরিপন্থি।’ সাংবাদিক রোজিনা ইস্যুতে আইনের মারপ্যাঁচ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে, চলতেও থাকবে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কোনোভাবেই সরকার ও গণমাধ্যম যেন মুখোমুখি হয়ে না পড়ে। এ ক্ষেত্রে সরকারেরও একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। তা হলো অতিউৎসাহী আমলাদের নিরুৎসাহিত এবং দ্রুত ন্যায়বিচার দৃশ্যমান করে তোলা। সেই সঙ্গে সরকার যে গণমাধ্যমের মুখোমুখি নয়Ñ বরং পাশাপাশি পথচলায় সহনশীল সেই মনোভাবটি স্পষ্ট করা। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App