×

মুক্তচিন্তা

দেয়া-নেয়ার কূটনীতি : দাতা কখনো গ্রহীতা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ মে ২০২১, ১২:১৫ এএম

ভারত আমেরিকা, ব্রিটেনসহ মোট ১৫০টি দেশকে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, প্যারাসিটামল ও অন্যান্য ওষুধ সরবরাহ করেছিল। সম্প্রতি প্রায় ৮০টি দেশে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত কোভিড প্রতিষেধক পাঠানো হয়েছিল। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও ভারত বিদেশে ভ্যাকসিন রপ্তানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি ২০২১ সালের শুরু পর্যন্ত। ভারতের এ ভ্যাকসিন দানে ধন্য হয়েছিল বাংলাদেশও। ভারতের এ ভ্যাকসিন দাতা প্রভাবটি সারা বিশ্বে নন্দিত হয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভারতের ভূয়সী প্রশংসা করেছিল। কিন্তু ২০২১ সালের শুরুর সময়টা যেতে না যেতেই পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ভারত তার নিজের গোটা দেশকে চিকিৎসা দিতেই সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। মানুষ শুধু রোগাক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে না, বহু মৃত্যু ঘটে যাচ্ছে চিকিৎসা না পেয়েও। দিল্লি আর অমৃতসরে দুটি হাসপাতালে ভর্তি থাকা ৩৩ জন রোগী অকস্মাৎ বুঝতে পারল, তাদের অক্সিজেন আস্তে আস্তে কমে আসছে; তারপর একসময় অক্সিজেন বন্ধই হয়ে গেল। তাদের সামনে অথবা আড়ালে হাসপাতালের নার্স ও ডাক্তাররা কাঁদছেন। কারণ আর এক ফোঁটাও অক্সিজেন নেই। ডাক্তার আর নার্সদের চোখের সামনেই শ্বাস নিতে না পেরে প্রতিটি রোগীর মৃত্যু হলো। ভারতের কোভিড পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে বসেছে। বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে তাদের দুর্ভাগ্যের কথা। খোলা মাঠ, রাস্তার ধার, ফসলের জায়গাটুকু সবকিছু ভরে উঠেছে মৃত মানুষের শ্মশান আর কবরে। শ্মশানের আগুন জ্বলছে দিনে-রাতে সবখানে। মৃত্যুর মিছিলে ভিড় জমে আছে, লাশ অপেক্ষা করে আছে শ্মশানের লাইনে এসে। আকাশ-বাতাস ভারি করে তুলছে ভারতের মানুষের মৃত্যুর বাস্তবতায়। ভারত হয়ে উঠেছে দিশাহারা। লাশের মিছিলে হাসপাতাল, সরকার, সামর্থ্যবান সব মানুষ যেন থ বনে গেছে। ভ্যাকসিন দাতা ভারত এবার গ্রহীতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্ব কূটনৈতিক মহলে। এরই মধ্যে ৪০টিরও বেশি দেশের কাছ থেকে সহায়তা পৌঁছেছে ভারতে। ইউরোপের বেশকিছু রাষ্ট্র, আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানির পাশাপাশি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ, ভুটান, গায়ানা, মরিশাসের মতো দেশও। সাহায্যের হাত থেকে পিছিয়ে থাকল না চীন আর পাকিস্তান। অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর, ওষুধ যে যা পারছে পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশ পাঠিয়েছে ৩০ হাজার পিপিই, কয়েক হাজার জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন সি এবং ১০ হাজার অ্যান্টিভাইরাল ইনজেকশন। আমেরিকা তিনটি বিমান ভরে পাঠিয়েছে ৪০০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার, ১০ লাখ র‌্যাপিড টেস্ট কিট, হাসপাতালের প্রয়োজনীয় সামগ্রী এবং প্রচুর অন্যান্য জিনিসপত্র। রাশিয়ার দুটি বিমানে এসেছে ২০টি অক্সিজেন প্ল্যান্ট, ভেন্টিলেটর ও অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ। ব্রিটেনের একটি বিমানে এসেছে ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন কনসেনট্রটরসহ আরো কিছু পণ্য। কানাডার কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি সে দেশের সাসকাচোয়ান প্রদেশও পাঠিয়েছে দ্রব্যসামগ্রী। ভারত সংকটকালে গোটা বিশ্ব থেকে সাহায্য পাচ্ছে। বিশ্ব কূটনীতির এ দিকটি অনেক ভালো লাগার একটি অনুভূতি দান করেছে কিছু সমাজকে। বিশ্ব যেন প্রমাণ করে দিল- মানুষ মানুষের জন্য, রাষ্ট্রও মানুষের জন্য, তা সে হোক ভিন দেশের মানুষ। বিপদের সময় সব রাষ্ট্রের সব মানুষই অন্য রাষ্ট্রের মানুষের পাশে বন্ধুর পরিচয়ে। পৃথিবী কি একটু ঘুরে দাঁড়াবে? আমেরিকার কংগ্রেসে প্রথম বক্তৃতায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানান, তার সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কথা হয়েছে এবং তিনি শিকে জানিয়েছেন, ‘প্রতিযোগিতায় স্বাগত, দ্বন্দ্ব-বিরোধ চাইছি না।’ ভারতের করুণ অবস্থার মধ্যে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে এক বার্তায় কোভিড মোকাবিলায় দুদেশের যৌথ সমন্বয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াংই জানিয়েছেন, ‘ভারতের কোভিড পরিস্থিতিতে আমরা উদ্বিগ্ন। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা ভারতকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’ করোনাতে বিধ্বস্ত ভারত। গান গেয়ে পাশে দাঁড়ালেন পাকিস্তানের শিল্পীরা। যখন ভারতের অবস্থা বেসামাল, তখন দেখা গেল পাকিস্তানের নোমান আলী, দিশান আলীসহ অন্য শিল্পীরা ‘দিল্লি-৬’ বলিউড ছবির ‘আরজিয়া’ গানটি গেয়ে অভয় জানাল ভারতকে। ভিডিওটি আপলোড করে তারা লিখল, ‘মনোবল হারিয়ো না, এই দুঃসময় কেটে যাবে। রাত যতই গভীর হোক, সকাল হবেই।’ একই কাজ করে ভারতের সঙ্গে সাহায্যের বার্তা দিয়ে ইসলামাবাদ জানিয়েছে, এ পরিস্থিতিতে ভারতের পাশে দাঁড়াতে চায় তারা। বার্তা পাঠিয়েছে প্রাক্তন ক্রিকেটার শোয়েব আক্তার এবং পাকিস্তানি ক্রিকেট অধিনায়ক বাবর আজম। সংহতি জানাল দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা। সেজে উঠল তিন রঙে। লেখা ভেসে উঠল- ‘স্টে স্ট্রং ইন্ডিয়া’। ভারতের প্রতি সংহতি জানিয়ে তিন রঙে রঙিন হয়ে উঠল কানাডার নায়াগ্রা জলপ্রপাত। রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত আধ ঘণ্টার জন্য তিন রঙে আলোকিত হয়ে উঠল নায়াগ্রা জলপ্রপাত। ভারতের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে তারা ভারতের জাতীয় পতাকার তিন রং গেরুয়া, সাদা এবং সবুজে সাজিয়ে তুলল নায়াগ্রা জলপ্রপাতকে। পৃথিবীর অনেকেই ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকারের অতি-রাজনীতি এবং কোভিডকে অবহেলা করার ফলে তাদের দেশে কোভিডের এ অবস্থা ফিরে এসেছে বলে সমালোচনা করেছে। তাদের অতি আত্মগরিমা এই কোভিড আবার তাদের কাছে ভয়াবহ হয়ে এসেছে বলে অনেকের ধারণা। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী তো রীতিমতো কোভিডযুদ্ধে বিজয় ঘোষণা করেই দিয়েছিলেন। কোভিড চলে গিয়েছে- এ রকম ধারণা নিয়ে বিজেপি সরকারের বিজয়োল্লাস দেখে তখন আঁতকে উঠেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু তাদের সতর্ক বার্তাকে থোরাই কেয়ার করল মোদি সরকার। বরং করোনা বিজয়ের কৃতিত্ব দাবি করে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভাষণ দিলেন স্বয়ং মোদি। কোভিডের ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি সফরে এলেন বাংলাদেশে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের ভোটযুদ্ধে নিজের প্রভাব বাড়াতে হাজার হাজার মানুষের ভিড় ঠেলে বাংলাদেশে মতোয়া সম্প্রদায়ের মন্দিরে গিয়ে পূজা দিতেও তিনি ছাড়েননি। বিশ্বের সবচেয়ে ভালো ফার্মা কোম্পানিগুলো ভারতে রয়েছে। সেখানে রয়েছে সবচেয়ে ভালো ভালো ডাক্তারও। ভারতে রয়েছে সফল টিকাকরণের ইতিহাস। ভারতকে বলা হয় ‘পৃথিবীর ঔষধালয়’। এরপরও তার আজ বেহাল অবস্থার কারণ কী? কোভিডের সময় মোদি যতটা রাজনীতি করেছেন, ততটা স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবেননি। পশ্চিমবঙ্গ দখল করার জন্য কী প্রাণপণ চেষ্টাই না করলেন মোদি! বাংলা দখলের উদ্দেশে দিন-রাত এক করে কয়েকশ কোটি টাকা খরচ করে বিমান আর হেলিকপ্টার উড়িয়ে, আদিবাসী বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজ সেরে, জনসভায় ভাষণ দিয়ে আম-বাঙালির মন জয় করাই ছিল যেন তাদের একমাত্র লক্ষ্য। পশ্চিম আসানসোলের জনসভায় পৌঁছে ভিড় দেখে আপ্লুত হয়ে পড়লেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। বলেই ফেললেন, এত ভিড় দেখে তিনি আপ্লুত। ভাইরাস সংক্রমণের পূর্বে কীভাবে ভিড়ের প্রশংসা করেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী- তা সমালোচনার নতুন দিক খুলে দিয়েছিল অনেকের কাছেই। শুধু এটুকুই নয়, করোনার দাপট যখন তুঙ্গে, তখন গেরুয়া পোশাকের বিজেপি নেতার দাবি- ‘গোমূত্র এবং গোবর কোভিডের দারুণ প্রতিষেধক। নিয়মিত গোমূত্র পান করলে এবং গোবর গায়ে মাখলে করোনা ছুঁতে পারবে না।’ কিন্তু করোনা ভারত থেকে গেল না। কিছু মানুষ চিরতরে বিদায় নিল। তারা হারাল অনেক গুণী মানুষ। হাজার হাজার ভারতবাসী হারাল তাদের স্বজন। কিন্তু তাতে কী! এসবও থামাতে পারল না গঙ্গার পাড়ে অনুষ্ঠিত কোটি মানুষের যোগদানে মুখরিত কুম্ভমেলা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও কুম্ভমেলায় যোগদানের আহ্বান জানালেন। অযোধ্যা থেকে রাম মন্দিরের শিলান্যাস অনুষ্ঠানটি সারা ভারতবাসী লাইভ টেলিকাস্টে দেখতে পেলেও একটি হাসপাতাল উদ্বোধন, অক্সিজেন প্ল্যান্ট চালু কিংবা ওষুধের উৎপাদন কারখানার সূত্রপাত অনুষ্ঠানের টেলিকাস্ট কখনো কিন্তু ভারতের লোক দেখতে পেল না। বরং রাষ্ট্র বলল- ‘৩৭০ ধারা খুব খারাপ, বন্ধ করে দিলাম; তোমরা জয়ধ্বনি কর।’ মানুষ জয়ধ্বনি দিল। রাষ্ট্র বললÑ ‘এনআরসি খুব ভালো। তোমরা সমর্থন কর।’ জনগণ বলল, ‘জয়তু এনআরসি।’ রাষ্ট্র বলল- ‘রাম মন্দির হবে।’ জনগণ বলল, ‘জয় শ্রী রাম।’ কিন্তু এসবের একটি ইস্যুও তাদের মৃত্যু ঠেকাতে পারল না, অক্সিজেন দিতে পারল না, হাসপাতালে জায়গা দিতে পারল না, সময়মতো ভ্যাকসিন দিতে পারল না। ভারতের নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার নিজেদের দম্ভের ঢাক পেটাতে পেটাতে একসময় খেয়াল করল, তারা টিকা রপ্তানিকারক থেকে টিকা আমদানিকারকে পরিণত হয়েছে। তাই যখন দেখি, আত্মনির্ভর ভারতকে বাধ্য হয়ে সিঙ্গাপুর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে অক্সিজেন আমদানির উদ্যোগ নিতে হয়, তখন কবিগুরুর কথা মনে পড়ে যায়- ‘কীসের এত অহংকার, গর্ব নাহি সাজে, বরং থাকো মৌন হয়ে সসংকোচ লাজে’। তারপরও ভালো লাগার সুযোগটি অন্য জায়গায়। দেখে ভালো লাগছে যে, মানবতার জয় হয়েছে। ভারতের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বিশ্বমানবতার মানুষ। ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে ৪০টি দেশ। পাকিস্তান-চীন ভুলে গিয়েছে ভারতের সঙ্গে তাদের শত্রুতার সম্পর্কের ইতিহাস। জয় হোক এই দেয়া-নেয়ার কূটনৈতিক সম্পর্কের- জয় হোক মানবতার।

মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App