×

সাময়িকী

জনইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ মে ২০২১, ১২:২৬ এএম

জনইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন
তপন পালিত অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন একটি কথা সবসময় বলেন, ‘পথে না নামলে দাবি আদায় হয় না।’ এই বিশ্বাস থেকেই তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি সারাটা জীবন রাজপথে কাটিয়েছেন। দাবি আদায়ের জন্য লেখালেখি, সংগঠন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আদালতেরও দ্বারস্থ হয়েছেন বহুবার। অধ্যাপক মামুন লেখালেখি, সভা-সমিতি, সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘ কর্মময় জীবনে যে শক্ত ভিত তৈরি করেছেন সে ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আজ অনেকে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি এমন একজন শিক্ষক, যিনি ক্লাসরুমে শিক্ষকতার পাশাপাশি ইতিহাসকে ক্লাস রুমের বাইরে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছেন। উদারনৈতিক সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে তিনি রাজনৈতিক ভাষ্যে এবং মৌলবাদ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে রাজপথের লড়াইয়ের অগ্রণী সংগ্রামী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহসভাপতি হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শুরু হলে অনেকে যখন ভয়ে সাক্ষী দিতে রাজী হননি তখন তিনি এগিয়ে এসেছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে তিনি ছিলেন প্রথম সাক্ষী। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হলে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা দখলের হুমকি দেয়। নির্মূল কমিটির আহ্বানে সারাদেশে হরতাল চলাকালে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা আক্রমণ করে। ঢাকায় প্রবেশের পথে হেফাজতের কয়েক হাজার কর্মী মহাখালীতে নির্মূল কমিটির সমাবেশে আক্রমণ করে সভাস্থল চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। চাচা মহীউদ্দীন খান আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও মুনতাসীর মামুন রাস্তায় পিকেটিং করেছেন। কারণ তখন তার কাছে হেফাজতের তাণ্ডব থামানো জরুরি মনে হয়েছে। তারপরও হেফাজতের তাণ্ডব থামানো সম্ভব হয়নি। পুলিশ বা আমরা অনেক চেষ্টা করেও তাকে সভাস্থল থেকে সরাতে পারিনি। শুধু বললেন, ‘দাবি আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে এই রাজপথেই একদিন আমার পাশের জন গুলি খেয়ে মারা গেছেন। সেদিন আমিও মারা যেতে পারতাম। তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’ তার এই অবিচল অবস্থান দেখে যেমন অবাক হয়েছি, তেমনি তার প্রতি শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পেয়েছে হাজার গুণ। অনেকের মতো তিনি শুধু এসি রুমে বসে বক্তৃতা করে বা ক্লাস নিয়ে দায়িত্ব শেষ করেননি, বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে রাজপথে থেকে দাবি আদায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমাজে জাগরূক রাখতে তিনি সদা জাগ্রত থেকে জনস্বার্থে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পেছনে ভুয়া মাজার সরানোর জন্য তিনি রিট করেন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী কারো নামে স্থাপনা না হওয়ার জন্য রিট করেন এবং রিট করেন বধ্যভূমি ও গণহত্যার স্থল সংরক্ষণের জন্য। এর প্রত্যেকটির পক্ষে তিনি রুল পেয়েছেন। যে কারণে খুলনার শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী খান এ সবুরের নামের সড়ক তার পূর্বতন নাম ‘যশোর রোড’ ফিরে পেয়েছে। তিনি পত্রিকার প্রথম পাতায় কলাম লিখে জনসমাজের সামনে তুলে ধরেন গোলাপ শাহ মাজার সত্যিকার অর্থে কোনো মাজার নয়। তার এই সাহসী পদক্ষেপ জনসমাজের অন্ধত্ব দূর করতে সহায়তা করে। এছাড়াও ২০০১ সালের নির্বাচনের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বিএনপি-জামায়েত জোট সরকারের সন্ত্রাসীদের হামলার প্রতিবাদ করায় মিথ্যা মামলায় মুনতাসীর মামুনকে কারাবরণও করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি রাজপথ থেকে ভয় পেয়ে সরে আসেননি। মুনতাসীর মামুনের সবচেয়ে প্রিয় জগৎ হলো বই আর লেখালেখির জগৎ। ছোটবেলা থেকেই তার বইয়ের প্রতি ভালোবাসা। স্কুলে পড়ার সময় ঢাকা ও চট্টগ্রামের পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতো। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানে বাংলা ভাষায় সেরা শিশু লেখক হিসেবে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে আহমদ ছফা ও সত্যেন সেনের উদ্যোগে কালি-কলম প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গ্রন্থ ‘গল্প বলি’। মুনতাসীর মামুন যেমন লেখালেখি করেছেন তেমনি আন্দোলন সংগ্রামে থেকেছেন সক্রিয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বুলেটিনের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। কাপ্তানবাজারের কাছে বিসিসি রোডের এক ছাপাখানায় ছাপা হতো ‘প্রতিরোধ’। মুনতাসীর মামুনসহ কয়েকজন মিলে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার আগে হাতে হাতে ‘প্রতিরোধ’ বিক্রি করেন। শাহরিয়ার কবির, বেবী মওদুদ, বেনজির আহমদ ও মুনতাসীর মামুনসহ কয়েকজন মিলে ‘রানার’ নামে একটি সাপ্তাহিকও বের করতেন। স্বাধীনতার পর আহমদ ছফা লেখক সংগ্রাম শিবিরের ধারাবাহিকতায় ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’ গঠন করেন। এটি ছিল স্বাধীনতা লাভের পর লেখকদের প্রথম সংগঠন। মুনতাসীর মামুন ও মুহাম্মদ নুরুল হুদা আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। তবে সংগঠনের মূল চালিকা শক্তি ছিলেন আহমদ ছফা। ক্রমেই তিনি আহমদ শরীফ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রমুখ প্রগতিশীল লেখকদের এই শিবিরে নিয়ে আসেন। লেখক শিবির লেখকদের মোটামুটি শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়। এই সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধের তিনটি সংকলন প্রকাশের কথা আহমদ ছফা বাংলা একাডেমির পরিচালক কবির চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনা করেন। তিনটি সংকলনের নাম হবে ‘হে স্বদেশ’। গল্প সম্পাদনের জন্য সম্পাদক ছিলেন মুনতাসীর মামুন ও মুহাম্মদ নুরুল হুদা। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংকলন ‘হে স্বদেশ’ই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলা ১৩৭৮ সালে ২১টি গল্পের সংকলন ছিল বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘হে স্বদেশ’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে মুনতাসীর মামুন বিচিত্রায় সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হন। তখন তিনি ছোটগল্প রচনায় নিমগ্ন ছিলেন। এরপর তিনি গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর পরই প্রবন্ধ ও গবেষণায় নিবিষ্ট হয়ে পড়েন। অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনার জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে একাত্ম। গবেষণার বিষয় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিকে জনপ্রিয় করার জন্য যারা ভূমিকা রেখেছেন তিনি তাদের অন্যতম। সত্তর দশক পর্যন্ত তিনি সাহিত্যচর্চা ও গবেষণা নিয়েই মগ্ন ছিলেন। কিন্তু স্বৈরাচারের কবলে যখন দেশ তখনই তিনি কলম ধরেন এর বিরুদ্ধে। নতুনভাবে রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে তার আবির্ভাব ঘটে। সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠা, সামরিকায়ন, সামরিক শাসন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, গণতন্ত্রের অঙ্গীকার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ সমকালীন রাজনীতির চড়াই-উতরায়ের নানা দিক নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। মুনতাসীর মামুন নিজে কাজ করে তৃপ্ত নন। তার কর্মতৃষ্ণা তিনি অন্যদের মধ্যেও সঞ্চারিত করে চলেছেন। যে কাজগুলো হওয়া প্রয়োজন, যে বিষয়টি গুরুত্ববহ, এমন অনেক কাজ তিনি অন্যদের দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তার সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘গণহত্যা বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ ও ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন নির্ঘণ্ট গ্রন্থমালা’। অনালোচিত সব গণহত্যা ও বধ্যভূমির ইতিহাস উঠে এসেছে এসব গ্রন্থমালায়। তরুণ গবেষকরা মাঠ পর্যায়ে গবেষণার মাধ্যমে গ্রন্থ রচনা করছেন এবং করছেন। অনেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা-নির্যাতনের কথা নতুন করে জানতে পারছেন কাজ করতে গিয়ে। তারাও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন যা মুনতাসীর মামুনেরই অবদান। এই সিরিজ সম্পাদনার মধ্য দিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবরের প্রামাণ্য ইতিহাস রচনা করে চলেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য মুনতাসীর মামুন যেমন মাঠে আন্দোলন করেছেন তেমনি লেখালেখি চালিয়ে গিয়েছেন। মুনতাসীর মামুন মাঠের আন্দোলন, লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে তরুণ প্রজন্মের সামনে যুদ্ধাপরাধীদের অপকর্মের কথা প্রচার করেছেন। যা অন্তিমে তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে সহায়তা করেছে। তার গবেষণাকর্ম, বক্তৃতা, বিবৃতি, চিন্তাভাবনা, সংগঠন প্রতিষ্ঠা সবই তো জাতির জন্য আলোকদিশারি। মনীষী আবুল ফজলকে বলা হতো জাতির বিবেক। সে অর্থে মুনতাসীর মামুনকে বলা যায় জাতির আলোকদিশারি। প্রজ্বলিত প্রদীপ হাতে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেনÑ তার বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা সেই ধারারই প্রবর্তক। আগামী ২৪ মে এই জনইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের ৭০তম জন্মদিন। জন্মদিনের  শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App