×

সাময়িকী

কবিতার অনুপম বাতিঘর

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ মে ২০২১, ১২:২৫ এএম

কবিতার অনুপম বাতিঘর
সালমা বেগ অকূল গাঙে যদি প্রচণ্ড ঝড়ে বাত্যাঘাতে টলমল করে ডিঙা; আর সে ডিঙার মাঝি যদি হয় আনাড়ি; তেমন দুর্যোগে সে মাঝির বুক যতটা বিচলিত হয়; প্রিয় এ মানুষের কথা লিখতে নয়, ভাবতে গেলেও আমি ততটাই বিচলিত বোধ করি। কারণ সাহিত্যাঙ্গনে কী সৃষ্টিবৈভব অথবা প্রজ্ঞা, তিনি এক মহিরুহ; আর আমি তাঁর পাশে সামান্য তৃণমাত্র। সাহিত্যের দশদিগন্ত বিস্তৃত তাঁর শাখা-প্রশাখা; আর প্রতিটি শাখাই তাঁর বিপুল সবুজে পল্লবিত। তবুও নিজের সীমাবদ্ধতার কথা বিস্মৃত হয়ে তাঁকে নিয়ে কিছু বলতে চাই। তাঁকে নিয়ে বলতে চাওয়া আমার ব্যক্তিগত আবেগ নয় শুধু, বরং কৃতজ্ঞচিত্তের নৈবেদ্য নিবেদনও। প্রতিদিন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তিনি নবীন কবিতাকর্মীদের জন্য কবিতার যে দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন; এই যে অল্পদিন আগেই তিনি ‘আত্মানুসন্ধান’ শিরোনামে বাংলা কবিতার ছন্দপ্রকারণ, বানানরীতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখে আমাদের পথের দিশা দিলেন; তাঁর সে ঋণ কি আমরা শোধ করতে পারবো? সুতরাং তাঁকে নিয়ে লিখতে যাওয়া এক অর্থে নতুন প্রজন্মের সৃজনকর্মীদের পক্ষে ঋণস্বীকারও বলতে পারি। তিনি কেবল সৃজনে নন, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেও বর্ণিল! তাঁর জন্মদিনে তাঁর সে বর্ণময়তায় আমি শুধু অর্ঘ্যারোতি দিয়ে স্মরণ করতে চাই তাঁরই আলোকচ্ছটার বৈভবের কথা। তিনি ফরিদ আহমদ দুলাল; যিনি একজন কবি-প্রাবন্ধিক-লোকগবেষক-কথাসাহিত্যিক; যিনি নিষ্ঠ সংগঠক-নাট্য নির্দেশক-নাট্যকার; যিনি সফল মঞ্চাভিনেতা, প্রকৃতিপ্রেমী মনোযোগী পরিব্রাজক; সর্বোপরি তিনি আপাদমস্তক কবি। ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র পাড়ে জন্ম ও বেড়ে ওঠা, প্রকৃতির সন্ধানে ছুটে চলা অদম্য এক স্রোতপ্রবাহ তিনি। নাট্যজন বাবা মীর্জা মো. ফেরদৌসী ও শিক্ষক মায়ের তৃতীয় সন্তান ফরিদ আহমদ দুলাল যেন প্রকৃতিপাঠে এক মাতাল ঋত্বিক; যেন এক নগরবাউল। ষাটোর্ধ্ব বয়সেও তাঁর জানার আগ্রহে ঘাটতি নেই, শেখার আগ্রহে সামান্য ক্লান্তি নেই। সৃষ্টিশীলতার মহাযজ্ঞে সংশপ্তক এ ঋষির অন্য নাম দুলাল; অনুপম সে নামের দ্যুতি। সংকল্পে তিনি অবিচল, অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছায় তাঁর অদম্য সাহস, আর বুক ভরা দম। স্তাবক সময়ের নতজানু সংস্কৃতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলার স্পর্ধা দেখান ঠোঁটকাটা দুলাল। যে কারণে আপাদমস্তক একজন প্রেমিক পুরুষ হয়েও অনেকের বিরাগভাজন। সত্যের নিবিড় সৌন্দর্য আবিষ্কারে চেনা পৃথিবীর পরিপার্শ্ব আর প্রকৃতির  প্রতি প্রেমে তিনি ছুটে চলেন অবিরাম। প্রথম যৌবনে নাটক নিয়ে প্রশংসিত হওয়া কবি পরবর্তীতে কী নিয়ে মেতে থাকেননি। ‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডি পাঠ!’ কী তাঁর অজানা। তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠ হবার পর থেকে তাঁকে যত জানছি ততই অবাক হচ্ছি। বিভিন্ন মাছ ও পাখির জীবনচরিত যেন তাঁর নখদর্পণে। শুধু মাছ আর পাখি কেন নানান জাতের গাছ ফুল সম্পর্কেও তাঁর জ্ঞান আমাদের অভিভূত করে। এটা তো তাঁর কবিত্বের বাইরের প্রসঙ্গ কিন্তু কবিতায় ইতিহাস, ফুল-পাখি, পৌরাণিক কাহিনী, দেশ ও মৃত্তিকা, যাপিত জীবন, প্রেম-বিরহ, নৈসর্গিক বেদনার এক নিবিড় চাষি। ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা উচ্চারণ করি, কিছুদিন আগেই তিনি ‘বাংলার পাখিপুরাণ’ নামে একটি কবিতা লিখলেন; বলা যায় আমার সাথে বাংলাদেশের চেনা পাখিদের গল্প করতে করতে তিনি লিখে ফেললেন কবিতাটি। পাখি এবং কবিতার উপর কতটা দখল থাকলে একজন মানুষ গল্পচ্ছলে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে এমন অসাধারণ কবিতা লিখতে পারেন, ভেবে বিস্মিত হতে হয়। আসুন কবিতাটি পাঠ করি, বাংলার বনে আর জলাশয়ে লোকালয়ে হাঁটো যদি পাখিদের সাথে সাক্ষাৎ হবে বারবার নিরবধি বউ কথা কও পাখিকে খুঁজেছো যদি সে তোমায় ডাকে আম্রকাননে বাঁশের আড়ায় কাঁঠাল পাতার ফাঁকে? নদী তীরে পাবে খঞ্জনা বক কাদাখোঁচা জল-চিল কুড়া ও ডাহুক সারসও পাবে পানকৌড়ির বিল জলাশয় যদি থাকে আশপাশে মাছরাঙা পাবে জেনো আকারে ও রঙে হরেকরকম ডুবে নেই ফাঁক কোনো। (বাংলার পাখিপুরাণ : ফরিদ আহমদ দুলাল) মনোযোগ দিয়ে দেখলাম কবিতাটিতে অর্ধ শতাধিক পাখির নাম তিনি তুলে আনলেন, যাদের প্রায় সবার কথাই আমরা জানি; কিন্তু মনে রাখি ক’জন! আমি ভাগ্যবতী, কবির এ প্রজ্ঞাটি ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ পেলাম! এ বিস্ময় কবির পাঠককে জানানোও আমি দায়িত্ব মনে করি। বাংলা ভাষার আর কোন কবি পাখিদের অমন আত্মীয় আমার জানা নেই। দুই. কবির হৃদয় মানেই যেন প্রেম-নারী-প্রকৃতি আর আবেগের ব্যাপক সংক্রমণ। ফরিদ আহমদ দুলালও ব্যতিক্রম নন; তাঁর কবিতায় ঘুরে-ফিরে প্রেম আর নারী মূর্ত হয়ে উঠেছে। তবে তাঁর কবিতায় দেখি জীবনানন্দের ভিন্ন আস্বাদ। তাঁর ‘মৈমনসিংগীতিকা-ভাসান’-এ দেখি বঙ্গনারীর চিরকালীন বঞ্চনার বিরুদ্ধে লোকবাংলার নারী জীবনের নবরূপায়ন। তাঁর এ দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। আবার তাঁর ‘নাইওর’ কাব্যের কথা স্মরণ করতে পারি, যেখানে বাংলার লোকজীবনের এক অনিবার্য অনুষঙ্গ ‘নাইওর’ নানান মাত্রায় উপস্থাপন করেছেন তিনি। এভাবেই প্রণয়ের প্রচলিত ধারণার বাইরে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে তিনি আরো গভীর এবং নান্দনিক হয়ে ওঠেন। তাঁর ‘কৃষ্ণকলি নাম তার’ কাব্যে যখন তিনি অনার্য-দ্রাবিড় নারীর পুরু ঠোঁট যৌবন-সৌন্দর্যের বিভা অবলীলায় উচ্চারণ করেন নারীর দেহবল্লরীর সৌন্দর্য; তখন যেন অজান্তেই তাঁকে অন্য উচ্চতায় দেখতে চায় পাঠক। আসুন আমরা একটি কবিতার পাঠ গ্রহণ করি, কৃষ্ণকলি কোন নতুন নামের জাদু নয় প্রাচীন সে মায়াজাল তবু তার আলো-ছায়া-মাখা-মুখ দেখে সমকাল অবাক তাকায় বিকেলের রোদ মায়াবী সকাল। কবিতার সন্ধানে আমিও বেরোই কখনো পথে চাই নিটোল একটি কবিতা প্রার্থনা কবিতা চড়ুক রথে, কবিতা কোথায় কোন হেরেমের অন্ধকারে নাচে পথে পথে জ্যামে-জনারণ্যে কৃষ্ণকলি-মুখ আটকে আছে; যার সন্ধানে কিশোর পথ চলা নিয়ে স্বপ্নের সাম্পানে বাঁচে। (কৃষ্ণকলি : কৃষ্ণকলি নাম তার) তিন. পাঁচ দশকের অধিক নিরবচ্ছিন্ন সাধনায় বাংলাদেশ-ভারতের সাহিত্যাঙ্গনে কবি ফরিদ আহমদ দুলাল এক অনিবার্য নাম। প্রথমত নাটক পরিচালনা-নির্দেশনা ও অভিনয়ের কারণে তিনি অনেক বেশি ডিকটেটর। যার প্রমাণ আমি পেয়েছি তাঁর ‘স্বতন্ত্র’ সম্পাদনায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করে। শুদ্ধতার ব্যাপারে তিনি অতিমাত্রায় কট্টরপন্থি। সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ না করেও আমার কবিতা লেখার প্রতি তাঁর কঠিন দিক নির্দেশনায় মাঝে মাঝেই কবিতা লেখা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এত কঠোরতার মাঝেও তাঁর ভেতরে দেখি একজন কোমল স্বভাব মায়াময় মানুষ। কবিতার ব্যাপারে তাঁর এতটাই নিষ্ঠা; যে কেউ কবিতা বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে মনে হয় তিনি নতুন করে উজ্জীবিত হন। কবিতার ছন্দ-মাত্রা বা কোনো শব্দ নিয়ে সংশয় নিয়ে যে কেউ তাঁর শরণাপন্ন হলে তিনি ধৈর্যের সাথে সহজভাবে বিষয়টি সবিস্তার বুঝিয়ে দেন। আর তাঁর শব্দভাণ্ডার সম্পর্কে কী বলবো। যে কেউ তাঁর কাছে কোন শব্দের সন্ধান করলে সাথে সাথে সেই শব্দ অর্থসহ ব্যাখ্যা বলে দেন, আমি তো যখন-তখন, অনেককেই দেখি তাঁর শরণাপন্ন হতে। তাইতো তাঁকে আমি ‘মোবাইল উইকিপিডিয়া’ বলি। আমার তো মনে হয় তাঁর তুলনা কেবল তিনি নিজে। সংগঠক হিসেবে ফরিদ আহমদ দুলাল অপরিহার্য। ময়মনসিংহের সাহিত্য সংসদের শ্রীবৃদ্ধিতেই শুধু নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। ময়মনসিংহের সাহিত্যাঙ্গন যখন বন্ধ্যা সময় পার করছে কবি তখন একক প্রচেষ্টায় একক শক্তিতে ‘স্বতন্ত্র’ সাহিত্যপত্রের উদ্যোগে কাজ করছেন, সচল রেখেছেন সাহিত্যচর্চার চাকা। সাহিত্যের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা ও একাগ্রতা-মগ্নতা আর দূরদর্শিতা দিয়ে কাব্যিক উত্তরণে সহায়ক হয়েছেন সবসময়। কবি ফরিদ আহমদ দুলাল কাব্যাঙ্গনে আমার বন্ধু, অভিভাবক ও কাব্যের অবিচ্ছেদ্য সূক্ষ্ম সংযোগ-সুতো। তিনি আমার কাছের মানুষ, পাশের মানুষ; তারপরও বিশেষত্বের ভিন্নতায় আপন বৈশিষ্ট্যের একজন স্বতন্ত্র মানুষ। আমার বিশ্বাস সামনের দিনগুলোতেও তাঁর কাছ থেকে পাবো সুন্দর সৃষ্টির পাশাপাশি শুভ দিকনির্দেশনা। কবির জন্মদিনে তাঁর সুস্থতা ও দীর্ঘসৃজনমুখর ঔজ্জ্বল্য কামনা করে প্রত্যাশা করি আমৃত্যু তিনি আমাদের মাথার ওপর ছায়া হয়ে শুদ্ধ কবিতার দিকনির্দেশনা দিয়ে যাবেন। জয়তু ফরিদ আহমদ দুলাল।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App