×

মুক্তচিন্তা

ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সংহতি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২১, ১২:১০ এএম

গাজা উপত্যকায় আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। প্রতিনিয়ত এ দৃশ্য দেখছি সপ্তাহখানেক ধরে দেশি-বিদেশি টিভি চ্যানেলগুলোতে। ঈদুল ফিতরের জন্য কয়েকদিন ধরে বিস্ময়কর হলেও দেশের সংবাদপত্রগুলো বন্ধ থাকায় প্রতিদিনকার বিস্তারিত খবর জানতে পারলেও ছবিগুলোই তো কথা বলে। ছবিগুলো গোটা পৃথিবীকে স্তব্ধ ও উদ্বিগ্ন করে তোলে। ফিলিস্তিনিরা আক্রান্ত। আক্রমণ করেছে তাদের চিরশত্রু ইসরায়েল। ইসরায়েল সমর্থন পাচ্ছে শতভাগ মুসলিম অধ্যুষিত ও মুসলিম বিশ্বের নেতা বলে পরিচিত সৌদি আরব ও মধ্য প্রাচ্যের আরো কয়েকটি মুসলিম দেশের। এই দেশগুলো, ইসরায়েলসহ গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার চিরশত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। আর ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে রয়েছেন সারা বিশ্বের প্রগতিকামী, স্বাধীনতাকামী, উন্নয়নকামী, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বের শত কোটি নানাভাষী মানুষ। ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে লাল পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে ইসরায়েলি কমিউনিস্ট পার্টি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, বিক্ষোভ দেখিয়েছেন ফরাসি নাগরিকরা এবং বিশ্বের বহু স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী অসংখ্য দেশের মানুষ। ফিলিস্তিনিদের লড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। এমন মনে হচ্ছে এ লড়াই দীর্ঘতর হবে হয়তো। ১৯৬৪ সালে আরব দেশগুলোর শীর্ষ বৈঠক মিসরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আলফাতাহর নেতৃত্বে ফিলিস্তিনীয় বিভিন্ন গেরিলা গ্রুপ উপস্থিত হয়ে ইসরায়েলিদের নির্মূল করার দাবি প্রাথমিকভাবে উত্থাপন করেন। ১৯৭৬ সালে ফিলিস্তিন আরব লীগের পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৯১ সালে সিরিয়ার সক্রিয় সমর্থনে লেবাননের সেনাবাহিনী ফিলিস্তিন নিরাবেশনি অর্গানাইজেশনকে (পিএলও) দক্ষিণ লেবাননে থাকা পিএলওর শক্তিশালী ঘাঁটিগুলো গুঁড়িয়ে দেয়। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সঙ্গে পিএলওর সম্পর্ক এই সময় তিক্ত হয়ে ওঠে, কারণ পাশ্চাত্যের দেশগুলো দৃশ্যতই সিরিয়া ও লেবাননকে সমর্থন জানিয়েছিল পিএলওকে ওই ঘাঁটিগুলো বিতাড়ন ও উচ্ছেদ করার ব্যাপারে। কিন্তু ইসরায়েলিদের সঙ্গে ফিলিস্তিনের যুদ্ধ চলতেই থাকে। ১৯৯৩ সালে ইসরায়েল পিএলওর সঙ্গে আলোচনায় বসে এবং দুটি রাষ্ট্র পরস্পর পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয়। ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আংশিকভাবে মেনে নিতেও বাধ্য হয়। ১৯৯৪ সালে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের সর্বজনীন বিপ্লবী নেতা ইয়াসির আরাফাত ১৯ সদস্যবিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেন এবং ফিলিস্তিনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলগুলোর প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ করেন। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর একের পর দেশ পিএলও স্বীকৃতি দেয়। এ ব্যাপারে ইয়াসির আরাফাত সর্বাধিক সমর্থন পান সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেস নেত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীও ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অকুণ্ঠ চিত্তে সমর্থন দেন। ১৯৯৫ সালে অপর এক চুক্তি বলে আরো দুই বছরের জন্য ফিলিস্তিনিদের দখলে থাকা বিস্তীর্ণ আরবভূমি, সব শহর-নগর ও গ্রামে তাদের স্বায়ত্তশাসন বর্ধিত করা হয়, পূর্ব জেরুজালেম ব্যতিরেকে। ১৯৯০-এর দশকে জেরুজালেমের পশ্চিম তীরে বিরাট এলাকা ফিলিস্তিনিদের দখলে আসে। কিন্তু এ নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে পুনরায় তিক্ততা বৃদ্ধি পায় এবং সশস্ত্র সংঘাত দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বেড়ে যেতে থাকে। ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের আলোচনা স্থগিত ঘোষিত হয়। ২০০৪ সালে ঘটল এক শোকাবহ ঘটনা। পিএলও চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করেন। সমগ্র স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকামী দেশগুলো এবং কোটি কোটি বিশ্ববাসী হয়ে পড়েন শোকস্তব্ধ। উল্লসিত হতে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ মুসলিম দেশে। লড়াকু ফিলিস্তিনি মুক্তিযুদ্ধারা স্বভাবত গভীর শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর পিএলও চেয়ারম্যান এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিশ্ববাসী জানত পিএলও একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুদ্ধ করছে। এই লক্ষ্য পিএলওর গৃহীত চার্টারেও সুস্পষ্টভাবে লিখিত হয়েছিল। ইয়াসির আরাফাত ছিলেন এমনই একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত, স্বপ্নদ্রষ্টা। কিন্তু ইয়াসির আরাফানে মৃত্যুর পর পাশ্চাত্য ও মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বে থাকা প্রধান প্রধান মুসলিম রাষ্ট্রের প্রকাশ্য ও গোপন সমর্থনে হামাস নামক সশস্ত্র উগ্র ধর্মান্ধ গ্রুপের সঙ্গে পিএলওর বিরোধ সৃষ্টি হয়। উগ্র ধর্মান্ধতা এবং দ্রুত চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জনের দাবিকে সস্তায় জনপ্রিয় করে তোলে। স্বভাবতই বিবাদ-বিসম্বাদ-অন্তঃকলহের সৃষ্টি হয়, যুদ্ধরত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মারাত্মক বিভেদের সৃষ্টি করে। এই বিবাদ-বিসম্বাদ ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইকে আত্মঘাতী বিভেদের মধ্যে ঠেলে দেয়। ইসরায়েল সুযোগ গ্রহণে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। বিশ্বের সব প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সমর্থন ইসরায়েলের ঔদ্ধত্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হলো। বিশ্বের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে ১৯৯১ সালের আরো একটি আন্তর্জাতিক বিপর্যয় ঘটে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটে যায়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ মারাত্মক অসহায়ত্বের শিকার হন। সেই অসহায়ত্ব গ্রাস করেছিল ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রাম ও তার অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাতকেও। হয়তো বা এই আঘাত তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল এবং তার মৃত্যুকেও ত্বরান্বিত করেছিল। এহেন আঘাত পিএলও এবং সমগ্র ফিলিস্তিনি জনতাকেও কম বিপর্যস্ত করেনি। অপরদিকে শিগগিরই ইসরায়েলে প্রেসিডেন্ট (এবং সম্ভবত পার্লামেন্টেরও) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। সেখানকার কুখ্যাত প্রেসিডেন্ট নেতানিয়াহু তার হৃত জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যেও কৌশলগত কারণে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ অভিযানে মেতে উঠেছেন। সেটিও একটি কারণ ফিলিস্তিনিদের ওপর আক্রমণ পরিচালনার। ইতোমধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল পরিদর্শনে গিয়ে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিয়ে এলেন। তিনি ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান যুদ্ধ স্থগিত ঘোষণার পরামর্শ দেন। ইসরায়েলের জন্য মার্কিন মন্ত্রীর এই উপদেশ সাপে বর হয়ে দেখা দিল। অপরদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াশিংটন ফিরে গিয়ে সে দেশের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে রিপোর্ট প্রদান করলে তিনিও একই সুরে ফিলিস্তিনকে যুদ্ধ (তাদের ভাষায় আক্রমণ) স্থগিতের আহ্বান জানান তবে বাইডেন এ কথাও বলেন, ফিলিস্তিনি নারী-শিশু যেভাবে ইসরায়েলি হামলায় মৃত্যু ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তা তাকে পীড়িত করছে। এতে ফিলিস্তিনির আদৌ খুশি হওয়ার বা ইসরায়েলের বেজার হওয়ার কোনো কারণ ঘটেনি। আমেরিকা তার নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই চলেছে। এখন বাকি আছে জাতিসংঘের তরফ থেকে প্রকাশ্য ভূমিকা নেয়ার। অনুমান করি ফিলিস্তিনিদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ-হাসপাতালগুলো পুড়ে ছাই হওয়ার পর এবং এর পরিণতিতে আত্মরক্ষার্থে ফিলিস্তিনিরা তাদের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার এবং অন্যত্র চলে যাওয়ার পর জাতিসংঘ আবির্ভূত হবে এবং উভয় দেশকে যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানাবেÑ যা তারা সচরাচর করে থাকে। পরিস্থিতি দৃষ্টে বুঝাই যাচ্ছে, ফিলিস্তিনিরা প্রাণপণ লড়াই বজায় রাখলেও যুদ্ধরত গেরিলা বাহিনী ও গ্রুপগুলোর মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মান্ধতা নিয়ে যে দ্বন্দ্ব অঘোষিতভাবে চলে আসছে তার দরুন তাদের মধ্যে প্রকাশ্যে আত্মঘাতী অনৈক্যেরও সৃষ্টি হয়েছে। এর সুযোগে ধর্মান্ধ ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা উগ্র সাম্প্রদায়িক বৈদেশিক শক্তিগুলোর বৈষয়িক এবং নৈতিক সহায়তা দিয়ে উগ্রপন্থিদের উগ্রতর করে তুলছেন। তারা ইসরায়েলকে গুঁড়া করে দেয়ার মতো অবাস্তব চিন্তায় আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে একদিকে হামাস ও অপরদিকে ইসরায়েলকেও উসকানি দিচ্ছেন। এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। অপরদিকে নিবন্ধটি লেখার শেষ মুহূর্তে জানা গেল জাতিসংঘ উভয়কে অস্ত্র বিরতির আহ্বান জানাতে চাইলে আমেরিকা তাতে বাধা দিয়ে শুধু ফিলিস্তিনকে অস্ত্র বিরতির আহ্বান জানায়Ñ ফলে ইসরায়েল দ্বিগুণ উৎসাহে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। দেশ-বিদেশেও দেখা যায়, প্রতিবাদী মানুষরাও বিভক্ত। নানা দেশের উগ্র ধর্মান্ধরা উগ্রতা ছড়াচ্ছেনÑ অপরদিকে ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের চিরকালের মিত্র প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক কোটি মানুষ একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক ও ধর্মীয় ও জাতিগত উগ্রতামুক্ত অসাম্প্রদায়িক ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের লড়াইকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছেন দৃঢ়তার সঙ্গে। ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, আমেরিকার ডেমোক্র্যাটিক পার্টির উদারপন্থি অংশ, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিশ্বের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো। তাদের সবার ওই প্রতিবাদী কণ্ঠের সঙ্গে সংহতি জানাই। সংহতি জানাই বাংলাদেশ ও ভারতের বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ সব গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তির মিছিলের সঙ্গেও। ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রাম সফল হোক। রণেশ মৈত্র : সাংবাদিক ও রাজনীতিক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App