×

মুক্তচিন্তা

করোনার রাজ্যপাট শেষ হবে কবে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২১, ১২:০১ এএম

করোনার রাজ্যপাট শেষ হবে কবে

২০২০-এর গোড়ায় নভেল করোনা যখন ঝড়ের বেগে অমিতশক্তিতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল তখন কেউ কেউ মন্তব্য করেছিলেন- Covid-19 is the 21st Century Plague, let us treat it that way. মহামারি হিসেবে এখনো অবশ্য প্লেগের মতো সে প্রলয়কারী হয়ে ওঠেনি। প্লেগের ইতিহাস, সাম্রাজ্য বিস্তার শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়ে। প্রাণ সংহারকারী হিসেবে তার ভূমিকা ছিল ভয়ঙ্করভাবে নিষ্ঠুর। শুধু ১৪ শতকেই মহামারিরূপে ইউরোপের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছিল প্লেগ। তবে ততটা সংহারকারী চেহারায় আবির্ভূত না হলেও একুশ শতকের নভেল করোনা সংক্রামক শক্তিতে যে যথেষ্ট পরাক্রমশালী, তাতে সন্দেহ নেই। বিশেষত বারবার জিনেটিক উপাদান বদল করে ক্রমাগত ভোল পাল্টে ফেলার ক্ষমতাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস বিশেষ গুরুত্বসহকারেই দেখছে। অবশ্য সব ভাইরাসেরই কমন বৈশিষ্ট্য, সংখ্যা বেড়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জিন স্ট্রাকচারেও কিছুটা পরিবর্তন বা Mutation হয়। কিন্তু নভেল করোনার ভোল পাল্টে ফেলার পদ্ধতি বড় বিস্ময়কর! কারণ দ্বিতীয়বার ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় নতুন যে Variant-রা চিহ্নিত হয়েছে, অ্যান্টিবডিকে ছলে-বলে এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল তাদের রপ্ত। এমন বুদ্ধিদীপ্ত স্মার্ট ভাইরাসদের আগে প্রকৃতির বুকে কোনোদিন চিহ্নিত করা যায়নি- Covid-19 virus has properties that have never been found in nature before. ভাইরোলজিস্টদের সংশয়ের জট ক্রমেই তাই জটিল থেকে জটিলতর। চিকিৎসাবিজ্ঞানেরও এক সংবাদের শিরোনাম- ‘As Virus grows stealthier, vaccine makers reconsider battle plans.’ অর্থাৎ আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন দ্বারা কোভিড করোনার বিরুদ্ধে নির্মূল অভিযান শেষ পর্যন্ত কতখানি সফল হবে, সে সম্বন্ধে সন্দেহ জাগরূক হতে শুরু করেছে। SARS-CoV-২, ওরফে কোভিড করোনার সংক্রমণের প্যাটার্ন দেখে বিশেষজ্ঞরা আগেই অনুমান করেছিলেন মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া অন্যান্য ভাইরাসের মতো করোনাও বারবার ফিরে ফিরে আসবে। জন হপকিনস ইউনিভার্সিটির সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, কোভিড করোনাকে দুর্বল করার জন্য Herd immunity খুব গুরুত্বপূর্ণ। Herd immunity হলো দেশের মোট জনসংখ্যার কমপক্ষে ৭০ শতাংশ টিকা নেয়ার ফলে কিংবা আগের ইনফেকশনের কারণে ভাইরাসের বিরুদ্ধে যখন ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা মানুষের জন্য নিজের শরীরের বাইরে এই ধরনের রেজিট্যান্স পাওয়ার অপ্রত্যক্ষ প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে। কারণ সিংহভাগ মানবদেহেই যখন প্রতিরোধ দুর্গ প্রস্তুত হয়, ভাইরাসের পক্ষে অল্পসংখ্যক দুর্বল মানুষকে খুঁজে বের করা তখন কঠিন হয়ে পড়ে। সুতরাং সংক্রমণের অনুপাতও কমতে থাকে ধীরে ধীরে। আপাতত কোভিড ১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ সবচেয়ে মারমুখী ভারত আর ব্রাজিলে। Variant-রা সিভিয়ার হওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা প্রচুর। এছাড়া ভারতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের Variant। প্রথমবারের চেয়ে দ্বিতীয়বারের আক্রমণের ধরন এবং রোগ লক্ষণও আলাদা। এবারের সিংহভাগ শিকার তরুণ প্রজন্ম। শিশুদের বেলায় ৫-১২ বছরের সংখ্যা বেশি। ভারত সম্পর্কে বলা হচ্ছে ঘন জনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ার কারণেই কেবল নয়, জনসচেতনতার অভাব, ইলেকশনের প্রচার-প্রচারণায় বিপুলসংখ্যক সমাবেশ, দারিদ্র্য, নিয়মবিধি অবহেলা করা, ইত্যাদি কারণে সংকট ঘনীভূত হয়েছে। ফলে অতি দ্রুত অধিকসংখ্যক রোগীকে সব ধরনের মেডিক্যাল সাপোর্ট সরবরাহ করা সামর্থ্যরে বাইরে থাকায় হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো সেখানকার রোজকার সংবাদ। রোজকার সংবাদ যেমনই হোক বাস্তবতা হলো নভেল করোনার সংক্রমণ সম্বন্ধে এখনো পর্যন্ত পরিচ্ছন্ন উত্তর বিশেষজ্ঞদের জানা নেই। বহু জিজ্ঞাসার জবাব তাই অনুচ্চারিত। কারো কারো ক্ষেত্রে প্রথমবার আক্রান্ত হওয়ার পরে দ্বিতীয়বার সংক্রমণের ঘটনা যেমন বিরল নয়, তেমনি ভাইরোলজিস্টরা এখনো নিশ্চিত নন, অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার পরও পুনরায় সংক্রমণের ঘটনা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় বুদ্ধিমান মানুষের মনে অনেক জটিল প্রশ্নেরই উদয় হচ্ছে তাই। কারণ SARS-CoV-২ নামে করোনা ভাইরাসের যে উত্তরাধিকারকে কোভিড-১৯ মহামারির জন্য দায়ী করা হচ্ছে, তার সঙ্গে ভ্যাকসিন বিজ্ঞানীরা অনেক সম্পর্কসূত্রকেই মেলাতে পারছেন না। বরং গবেষণা বিশ্লেষণে তাদের মনে হয়েছে এর Variant-দের মধ্যে প্রোটিন উপাদানগুলো এমনভাবে সন্নিবেশিত করা রয়েছে যাতে মনে হচ্ছে, ভাইরাসের বারবার বদলে যাওয়ার ঘটনাগুলো, মানবদেহে সংক্রমিত হওয়ার বিষয়টি পূর্ব থেকেই নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে মাস কয়েক আগে নরওয়ে এবং ব্রিটেনের দুজন ভ্যাকসিন বিজ্ঞানী দুই গুরুত্বপূর্ণ উপসংহার এনেছিলেন। যেখানে বলা হয়েছিল- (১) “The mutations that would normally be seen in course of animal to human transmission have not occurred in SARS-CoV-2, indicating that it was fully ‘Pre-adapted’ for human infection. (2) SARS-CoV-2, has insertions in its protein sequence that have never been detected in nature and contribute to its infectivity and pathogenicity.” সংশয় তাই ঘুরেফিরে, কবে শেষ হচ্ছে নভেল করোনার রাজ্যপাট? জিনেটিক উপাদান এত দ্রুতগতিতে বারবার পাল্টে ফেলে একেক দেশে, একেক সময়ে নভেল করোনার আবির্ভাবের কারণ কি সত্যি সত্যি প্রাকৃতিক? নাকি প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান সভ্যতায় এটি কোনো রাষ্ট্রপক্ষের শক্তিশালী হওয়ার পথে নীরব যুদ্ধের ঘোষণা? মানুষের শক্তি অর্জনের আকাক্সক্ষা কত ভয়ঙ্করভাবে সভ্যতাকে ধ্বংস করতে পারে, তার নীরব সাক্ষী মানুষের প্রাচীন ইতিহাসের অজস্র ঘটনাপুঞ্জ। ক’মাস আগে কোভিডের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে পটপরিবর্তিত হয়েছে। ইলেকশনের মাঝপথে হঠাৎ ভারতজুড়ে ভয়ঙ্কর চেহারায় ভাইরাস ঝাঁপিয়ে পড়ায় প্রতিপক্ষেকে ঘায়েল করার জন্য এত বড় মোক্ষম অস্ত্র রাজনীতিকদের কাছে দ্বিতীয়টি ছিল না। বাস্তবিকই করোনাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় রাজনীতিতে মহামারি ঘনিয়ে তোলার চেষ্টা সুযোগসন্ধানীদের থেমে নেই। এই ধরনের পরিস্থিতি মানবজীবনে কতটা উদ্বিগ্নতার জন্ম দেয় সে সম্বন্ধে ২০২০-এর মধ্য এপ্রিলে আমেরিকার একটি সংবাদ পত্রিকায় চমৎকার একটি মন্তব্য লিখেছিলেন একজন- If Covid-19 is the crucible, then Politics is the forge. If Novel corona virus is mortar in which human kind finds itself, politics is the pestle. অর্থাৎ কোভিড-১৯ যদি কামারখানার চুল্লি হয়, তাহলে রাজনীতি হচ্ছে কামারশালায় ধাতু গলানোর আগুন। এবং এই দুয়ের কারণে মানুষের অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যে অবস্থাকে বলা চলে করোনার হামানদিস্তায় রেখে রাজনীতির মুষল দিয়ে পিষে ফেলার মতো। তবে তারপরও আশার কথা হলো, নভেল করোনার রাজ্যপাট কবে হবে শেষ হবে তার উত্তর জানা না থাকলেও, জনসমাজের সচেতনতা, মাস্ক পরিধান করা, সোশ্যাল ডিসট্যান্স বজায় রাখা এবং সিংহভাগ মানুষের টিকা গ্রহণই এখনো পর্যন্ত মহামারি কোভিড ১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার যথাযথ নির্ভরযোগ্য উপায়।

দীপিকা ঘোষ : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App