×

মুক্তচিন্তা

ফিনিক্স পাখির ফিরে আসা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২১, ১২:১২ এএম

ফিনিক্স পাখির ফিরে আসা

কবি মুহাম্মদ সামাদ ‘তুমি ভূমিকন্যা’ কবিতায় লিখেছেন- ‘শেখ হাসিনা, জনগণমননন্দিত নেত্রী/আমাদের শাশ্বত ফিনিক্স পাখি তুমি/অগ্নিস্নানে শুচি হয়ে বারবার আসো/তুমি ভূমিকন্যা- তুমি প্রিয় মাতৃভূমি।’ প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেদনার দীর্ঘ সিঁড়ি ডিঙিয়ে ‘শাশ্বত ফিনিক্স পাখি’ হয়ে উঠেছেন। পুরাণ অনুসারে ফিনিক্স হলো এক পবিত্র ‘অগ্নিপাখি’। এই পাখির জীবনচক্র আবর্তিত হয় হাজার বছর ধরে। শত্রুর কারণে নির্মমভাবে দগ্ধীভূত হলেও ভস্ম থেকেই জন্ম হয় তার নতুন জীবন। শুরু হয় ফিনিক্সের অবিনাশী যাত্রা। কবির কাছে শেখ হাসিনা দুর্ভোগের আগুন থেকে উঠে আসা জাতিস্মর। এজন্য তিনি যথার্থই জননেত্রী। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি অক্ষয়কীর্তির অনন্য ভূমিকন্যা। নির্বাসন পর্ব শেষ করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে প্রিয় দেশে ফিরেছিলেন শেখ হাসিনা। আনজীর লিটন ‘১৯৮১ সাল ১৭ মে’ কবিতায় লিখেছেন- ‘ফিরে এলেন শেখ হাসিনা এলেন বঙ্গকন্যা/পিতা যে তাঁর বঙ্গবন্ধু ঝরলো আলোর বন্যা।/দৃপ্ত তিনি, প্রত্যয়ী তিনি, সাহসী নির্ভীক/বাংলা এবং বাঙালিদের নতুন দার্শনিক।’ প্রিয় জন্মভূমিতে ফিরে আসার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্র নতুন করে পথচলা শুরু করে। তাঁর প্রত্যাবর্তনের পর এদেশ পুনরায় ‘জয়বাংলা’র বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল। ৪০ বছর পূর্বের সেই দিনটি এখনকার মতো ছিল না। সেদিন ছিল ভারি বর্ষণ ও ঝড়ো হাওয়ার এক অপরাহ্ণ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে পাকিস্তানে পরিণত করেছিল। শেখ হাসিনার পদস্পর্শে সেই জল্লাদের দেশ পুনরায় সোনার বাংলা হয়ে ওঠার প্রত্যাশায় মুখরিত হয়েছিল। আজ তার প্রমাণ পাচ্ছি আমরা। চতুর্থবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা ভাইরাসের মহামারি মোকাবিলায় দিন-রাত কাজ করছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন। ঈদুল ফিতরের আগের দিন ১৩ মে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেয়ার সময় তিনি করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে গণটিকাকরণ কার্যক্রম নিয়ে আশার বাণী শুনিয়েছেনÑ ‘ভারতীয় কর্তৃপক্ষ টিকা রপ্তানির ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ফলে সরবরাহ ব্যবস্থায় কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এমতাবস্থায় আমরা বিকল্প উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে রাশিয়া এবং চীনের টিকা উৎপাদনকারী সংস্থার সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। উপহার হিসেবে চীনের কাছ থেকে টিকা ইতোমধ্যেই আমরা পেয়েছি। আমরা টিকা পাওয়ার জন্য আমেরিকার কাছেও অনুরোধ জানিয়েছি। বিশ্ব টিকাকরণ সংস্থা কোভ্যাক্সের কাছ থেকেও আমরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টিকা পাব। বিভিন্ন উৎস থেকে আমরা এক কোটি টিকা ক্রয়ের ব্যবস্থা নিয়েছি। খুব শিগগিরই দেশে টিকা আসতে শুরু করবে। তা ছাড়া দেশেই যাতে টিকা উৎপাদন করতে পারি সে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। নিজেদের টিকা তৈরিতে কয়েক মাস সময় লাগবে। আমরা দেশের সব নাগরিককে টিকার আওতায় নিয়ে আসব, ইনশাল্লাহ।’ ২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনা ভাইরাস আঘাত হানার পর থেকে ২০২১ পর্যন্ত সর্বমোট ১ লাখ ২৯ হাজার ৬১৩ কোটি টাকার সহায়তা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ২১টি খাতে সর্বমোট ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আর অনুদান বাবদ ৮ হাজার ২৬০ কোটিরও বেশি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। গত বছর সাময়িক কর্মহীন ৩৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষকে আড়াই হাজার টাকা করে মোট ৯১২ কোটি ৫০ লাখ দেয়া হয়েছে। এ বছরও সমসংখ্যক মানুষকে একই হারে ৯১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৬০৭ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক, সাধারণ শ্রমিক, নিম্নআয়ের মানুষ, মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সেবকরা, বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক ইত্যাদি পেশার মানুষজন এ সহায়তা কর্মসূচির আওতায় এসেছেন। করোনা ভাইরাস মহামারির সময়েও সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতাধীন বিভিন্ন ভাতা, খাদ্য কর্মসূচি, শিক্ষার্থীদের বৃত্তি-উপবৃত্তি প্রদানসহ আমরা সব ধরনের সরকারি সহায়তা কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছি। এসব কর্মসূচির সুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ৭৮ লাখ। এর মধ্যে বিভিন্ন ভাতাভোগীর সংখ্যা ১ কোটি ৭ লাখ, খাদ্য নিরাপত্তার আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা ২ কোটি ১৮ লাখ এবং বৃত্তি-উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ কোটি ৫৩ লাখ। মুজিববর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ১ম পর্যায়ে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ৬৫ হাজার ৬৫৪টি ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫৩ হাজার ৪৩৪টি গৃহনির্মাণের কাজ চলছে। এ নিয়ে মোট গৃহের সংখ্যা দাঁড়াবে ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৮। বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় এ পর্যন্ত আমরা সাড়ে ৩ লাখ পরিবারকে গৃহনির্মাণ করে দিয়েছি। মে মাসে (২০২১) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশের মহামারির সংকট মোকাবিলায় দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে, যাকে ‘প্রশংসনীয়’ বলেছে ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’। এ দেশের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তিনি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন সেগুলো এক অর্থে অনেক ধনী রাষ্ট্রও করতে পারেনি। তবে এ কথা সত্য, বিশ্ব মিডিয়ায় প্রশংসা পাওয়ার জন্য শেখ হাসিনা কাজ করেন না। তার দিনপঞ্জিজুড়ে আছে করোনা মোকাবিলার জন্য ব্যস্ত সময়ের কর্মকাণ্ড। আর তার এই বর্তমান নেতৃত্ব সম্ভব হয়েছে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ফলে। দীর্ঘদিন মাঠপর্যায়ের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে শেখ হাসিনা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছের মানুষে পরিণত হন। অথচ ১৭ মে তার দেশে ফেরা ছিল অতি সাধারণ, কারণ সেভাবেই তিনি দেশের জনগণের সামনে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। সেদিন তিনি এক বৃহৎ শূন্যতার মাঝে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এ দেশে তার ঘর নেই; ঘরের আপনজনও কেউ নেই। তাই সারাদেশের মানুষ তার আপন হয়ে উঠল। তিনি ফিরে আসার আগে ছয় বছর স্বৈরশাসকরা বোঝাতে চেয়েছিল তারাই জনগণের মুক্তিদাতা। কিন্তু সাধারণ মানুষ ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠছিল, বিচার দাবি করছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের। সেনাশাসকের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকায় জনগণের শাসনের দাবি নিয়ে রাজনীতির মাঠে রাত-দিনের এক অক্লান্ত কর্মী হয়ে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি নেতা কিন্তু তারও বেশি তিনি কর্মী। কারণ দলকে ঐক্যবদ্ধ করা, বঙ্গবন্ধু ও তার শাসনকাল সম্পর্কে অপপ্রচারের সমুচিত জবাব দেয়া, পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা তার প্রাত্যহিক কর্মে পরিণত হলো। দেশে ফেরার প্রতিক্রিয়ায় আবেগসিক্ত বর্ণনা আছে তার নিজের লেখা গ্রন্থগুলোতে। কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন, শেখ হাসিনা যখনই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রেখেছিলেন তখনই বুঝে নিয়েছিলেন- ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু পথ।’ তার ‘পথে পথে গ্রেনেড ছড়ানো’। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের (১৯৮১ সালের ১৭ মে) আগে ৫ মে বিশ্বখ্যাত নিউজউইক পত্রিকায় বক্স আইটেমে তার সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, জীবনের ঝুঁকি আছে এটা জেনেও তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। ১৯৮৩ সালের ২৪ মার্চের সামরিক শাসন জারির দুই দিন পর স্বাধীনতা দিবসে একমাত্র শেখ হাসিনাই সাভার স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি সামরিক শাসন মানি না, মানব না। বাংলাদেশে সংসদীয় ধারার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করবই করব।’ তাই তো কবি ত্রিদিব দস্তিদার শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, ‘আপনিই তো বাংলাদেশ’। ১৭ মে থেকেই দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে দ্রুত দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জয়বাংলা’ সেøাগান নিষিদ্ধ ছিল। সেদিন থেকেই সেই স্লোগান প্রকম্পিত হয়ে উঠল আকাশে-বাতাসে; রাজপথ জনগণের দখলে চলে গেল। সেনাশাসক জিয়া এতদিন শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু প্রত্যাবর্তনের পূর্বে সেই বছরই শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং জিয়ার অভিসন্ধি ভেস্তে যায়। সেদিনের ঢাকায় লাখো মানুষের বাঁধভাঙা স্রোত তাকে কেন্দ্র করে সমবেত হয়েছিল। ১৭ মে সম্পর্কে দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত সংবাদ ছিল এ রকম- ‘ঐদিন কালবোশেখির ঝড়ো হাওয়ার বেগ ছিল ৬৫ মাইল। এবং এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে লাখো মানুষ শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্য রাস্তায় ছিল।’ দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমান থেকে নেমেই তিনি দেশের মাটিতে চুমু খান। এ সময় বিপুল জনতার বিচিত্র স্লোগান মুখরিত করে তুলেছিল ঢাকার রাজপথ। যেন সূর্যোদয় হয়েছে, নতুন দিনের পথচলা শুরু হলো। অশ্রুসজল সেই দিনের কথা আছে নানাজনের স্মৃতিচারণে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সব অশুভ শক্তির মোকাবিলা করতে হবে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, জলবায়ু সংকট নিরসনে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত উদ্যোগ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা, নারীর অধিকার, সুশাসন নিশ্চিতকরণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ধারাবাহিকতা রক্ষায় শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমাদৃত। আর বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে তিনি জনগণের কাছে নন্দিত।

ড. মিল্টন বিশ্বাস : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App