×

মুক্তচিন্তা

করোনা, ঈদযাত্রা ও ঈদ-আনন্দ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ মে ২০২১, ১২:১০ এএম

সামনে ঈদ কিন্তু কোথাও কেন জানি ঈদের সে আনন্দ নেই। কেনাকাটার আনন্দে ‘ঈদ-বাজার’ বলে একটা ব্যাপার থাকে, যার চেহারাটা বাণিজ্যিক হলেও সুরতটা উৎসবের, কিন্তু সেটাও এবার সর্বত্র গরহাজির। ক্রেতার মুখেও আনন্দ নেই, আবার বিক্রেতার মুখও বেজার। উৎসব নেই কোথাও। ঈদ-আনন্দ বলে যে একটা ব্যাপার আছে, তার ঘাড়ে ক্রমাগত নিশ্বাস ফেলছে করোনার ভয়, মৃত্যুর আতঙ্ক এবং সরকারি নিষেধাজ্ঞা। করোনার ভয়ে সবকিছু সীমিত আকারে করতে করতে সীমিত হয়ে উঠেছে আমাদের আনন্দ, আমাদের আনন্দের ভাগাভাগি, আমাদের আবেগ ও উচ্ছ্বাস। কিন্তু এত সরকারি নিষেধাজ্ঞা, আন্তঃজেলা গণপরিবহনের অভাব, এত করোনার ভয় এবং সামাজিক-শারীরিক যোগাযোগ মেনে চলার এত ওয়াজ-নসিহত সত্ত্বেও ঈদযাত্রা কিন্তু থেমে নেই। ‘বানের পানির লাহান’ মানুষ ঢাকা ছেড়ে ‘দেশের বাড়ি’ যাচ্ছে। চলমান লকডাউনের অংশ হিসেবে দূরপাল্লার সব ধরনের বাস, ট্রেন এবং লঞ্চ সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, যাতে মানুষ নিজ নিজ কর্মস্থল ত্যাগ করতে না পারে; বিশেষ করে ঢাকা ছেড়ে না যেতে পারে। যদিও আকাশ-পথ খোলা রাখা হয়েছে, যাতে ‘বড়লোক’রা ঈদযাত্রা করতে পারে কিন্তু ‘ছোটলোক’দের সব যাতায়াত বন্ধ! ঈদযাত্রায়ও ধনী-দরিদ্রের ফারাক! আজব পুঁজির দুনিয়া! কিন্তু মানুষ সব ধরনের বাধা অতিক্রম করে ‘দেশের বাড়ি’তে রওনা দিয়েছে। যে যেভাবে পারে, কেউ কেউ কিছুটা হেঁটে আর কিছু ছোটকা গাড়িতে করে, কেউ কেউ মাইক্রো ভাড়া করে, কেউবা আবার ছোট ছোট গাড়িতে, কেউ কেউ ট্রাকে করে, কেউবা ট্রাকের ভেতর ত্রিপলের নিচে, কেউবা কিছুটা পিকআপ ভ্যানে, কেউ কেউ নদীতে নৌকায়, কেউবা মিনি লঞ্চে পাহারাদারকে ফাঁকি দিয়ে, কেউ কেউ ফেরি পার হয়ে ভ্যানে-ভটভটিতে-লোকালে, কেউ কেউ অ্যাম্বুলেন্সে, অর্থাৎ যে যেভাবে পারে ঢাকা ছেড়ে ‘দেশের বাড়ি’ যাচ্ছে। এসব নিয়ে মিডিয়া নানান খবর ছাপছে এবং প্রচার করছে। মানুষের এ ঈদযাত্রা অভিযানকে খানিকটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে উপস্থাপন করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকের দেয়ালে বেসুমার হা-হুতাশ পরিলক্ষিত হচ্ছে মানুষের এ দুর্দমনীয় মনোভাব এবং তীব্র ‘বাড়ি-প্রীতি’ নিয়ে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ কেন ঢাকা ছেড়ে এত কষ্ট সহ্য করে, এত ঝুঁকি নিয়ে ‘দেশের বাড়ি’ যাচ্ছে? এর সোজা উত্তর হচ্ছে, কংক্রিটের ঢাকা এবং অট্টালিকার ঢাকা এখনো এসব মানুষের ‘দেশ’ হয়ে উঠতে পারেনি। ঢাকা তাদের ‘দেশ’ না। এসব মানুষের ‘দেশ’ হচ্ছে সেটাই যেখানে এদের আত্মীয় থাকে, পরিবার থাকে, পরিজন থাকে, মা-বাবা থাকে, ভাই-বোন থাকে, যেখানে আবেগ থাকে, শৈশব থাকে এবং যেখানে ঈদের দিন সকালবেলা কদমবুচি করার মুরব্বি থাকে। তাই মানুষ করোনার ভয়, সরকার ঘোষিত লকডাউন, গণপরিবহনের অভাব কিংবা বিজিবির উপস্থিতি কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা না করে ঢাকা ছেড়ে ‘দেশে’ যাওয়ার আনন্দে ঈদযাত্রায় শামিল হয়েছে। শহুরে নাগরিক শিক্ষিত মধ্যবিত্তের চোখ দিয়ে দেখলে এসব মানুষের ঈদযাত্রাকে বোকামি মনে করে কিন্তু এসব মানুষের দুর্দমনীয় আবেগ এবং ভালোবাসায় সাত-সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দেয়ায় যে দৃঢ় সংকল্প সেটাকে দেখতে হবে ‘দেশের বাড়ি’র স্থানিক ডিসকোর্স দিয়ে। অন্যথায় এসব ‘বোকা’ মানুষের আবেগ এবং ভালোবাসার অর্থ আমরা বুঝতে পারব না। উল্লেখ্য, ২০২০ সালের মার্চের ৮ তারিখ বাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে মানুষের জীবনযাপন এবং জীবন প্রণালিতে মৃত্যু আতঙ্ক যেমন একদিকে জেঁকে বসেছে, অন্যদিকে করোনাকে উপেক্ষা করে জীবিকার তাগিদে অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখার প্রবণতাও ক্রমবর্ধমান হয়েছে। বিশেষ করে ২০২০ সালের মার্চ থেকে জুন-জুলাই পর্যন্ত মানুষের মধ্যে করোনা-কেন্দ্রিক যে ভয়-ডর ছিল এবং মানুষের মধ্যে ঘরে থাকার অনিচ্ছা অনুশীলন ও স্বাস্থ্যবিধি মানার যতটুকু আগ্রহ এবং ইচ্ছা ছিল, সেটা পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে পাতলা হতে শুরু করে। ‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে’ বলে মানুষ ঘরের বাহির হতে শুরু করে। মানুষ বহির্জগতের দৈনন্দিন এবং পেশাগত কাজকর্মে ক্রমান্বয়ে সংযুক্ত এবং সম্পৃক্ত হতে শুরু করে। মানুষের এ বাঁধ-ভাঙার অদম্য ইচ্ছাকে সাহস জোগায় করোনা পরিস্থিতির ক্রমোন্নতি কেননা সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে করোনা পরিস্থিতি ভালো হতে শুরু করে। তখন জনসমাগম কমানোর জন্য যা যা বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, সবই খুলে দেয়া হলো আস্তে আস্তে। ২০২০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর এবং ২০২১ সালে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পরিস্থিতি মোটামুটি সহনীয় রূপ ধারণ করে। এরই মধ্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে দেশে অক্সফোর্ড-এস্ট্রোজেনেকার টিকা আসতে শুরু করে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখ থেকে দেশে করোনা ভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়, যা মানুষের মধ্যে ‘বাঁধ ভাঙা’র আরো সাহস সঞ্চারিত করে। পরিস্থিতি আরো স্বাভাবিক হতে শুরু করে। পরিস্থিতির ক্রমবর্ধমান উন্নতির বিবেচনায়, সরকার মের ২৪ তারিখ থেকে স্কুল-কলেজ ক্রমান্বয়ে খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও মের ১৭ তারিখ হল খুলে দেয়ার এবং মের ২৪ তারিখ থেকে ক্লাস শুরু করার ঘোষণা দেয়া হয়। ফেব্রুয়ারিতে পরিস্থিতি দাঁড়ায় : ১৫-২০ হাজার করোনা পরীক্ষায় আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ৩০০-৪০০ আর মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩-৫ জনে। চতুর্দিকে আশার সঞ্চার হতে শুরু করে। কিন্তু মার্চে এসে পরিস্থিতি আবার খারাপ হতে শুরু করে এবং ২০২০ সালের মার্চের চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা শুরু হয়। মার্চের শেষে এবং এপ্রিলে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার আর মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় শতাধিক। ভারতের নাজুক পরিস্থিতি বাংলাদেশকে আরো ভাবিত ও আতঙ্কিত করে তোলে। পরিস্থিতির এমন অবনতি হয় যে, সরকার পুনরায় লকডাউন দিতে বাধ্য হয়। গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়। আন্তঃজেলা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। ট্রেন-বাস-বিমান সবকিছু বন্ধ করে দেয়া হয়। এমনকি প্রথম দফা লকডাউন যথাযথভাবে কাজ না করার কারণে সরকার ‘কঠোর লকডাউন’ দিতে বাধ্য হয়। তারই ধারাবাহিকতায় চলমান লকডাউনকে ১৬ মে পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। এর মূল কারণ হচ্ছে ঈদ উপলক্ষে নগরকেন্দ্রিক মানুষের ‘গ্রামের বাড়ি’ যাওয়ার যে প্রবণতা সেটাকে রোধ করা। কেননা যে বিপুল পরিমাণ মানুষ ঢাকা ছেড়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঈদ করতে যায়, তাতে করে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ যেমন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তেমনি শহর কেন্দ্রিক ভাইরাসে প্রাদুর্ভাব গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ারও একটা বিশেষ আশঙ্কা রয়েছে। ফলে সরকার লকডাইনের সিদ্ধান্ত ১৬ মে পর্যন্ত জারি রেখে মানুষের এ ব্যাপক গমনাগমনকে রোধ করার একটা চেষ্টা করেছে। কিন্তু ঈদযাত্রা যেখানে ঈদ-আনন্দের অংশ, সেখানে লকডাউন দিয়ে মানুষের আবেগ, ভালোবাসা এবং ‘দেশের বাড়ি’র তীব্র টানকে কি ‘লক’ করা যায়? ঈদের দিনে এসব মানুষকে ধরে রাখার কোনো প্রস্তুতি এবং আয়োজন কী ঢাকার আছে? কিসের টানে আত্মীয়, পরিবার, পরিজন, বাবা-মা, ভাই-বোনকে ‘দেশের বাড়ি’ রেখে শহরের বাসায় ঈদ করবে? ঢাকা শহর এসব মানুষের ভালোবাসার জায়গা হয়ে সত্যিকার দেশ হয়ে উঠতে পেরেছে? এসব মানুষের শ্রমের, ঘামের এবং অবদানের কারণে ঢাকা আজ মেগাসিটি হয়ে  উঠেছে এবং এসব মানুষের নিরন্তর, অক্লান্ত এবং নিরলস শ্রমের কারণে ঢাকা শহর টিকে আছে। কিন্তু এসব মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আটকে রাখার কোনো ক্ষমতা কি এ নিষ্ঠুর, নির্দয় এবং কংক্রিটের শহরের আছে? তাই করোনার ঝুঁকি নিয়ে ঈদযাত্রাকে আমরা নিরুৎসাহিত করি, সেটা ঠিক আছে কিন্তু ‘দেশের বাড়ি’ যাওয়ার যে তীব্র টান এবং অকৃত্রিম আবেগ, সেটাকে যেন আমরা কটাক্ষ না করি। গ্রামে গ্রামে করোনা ভাইরাস যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য এ ঈদযাত্রাকে আমরা নিরুৎসাহিত করি কিন্তু এসব মানুষের ঈদ-আনন্দকে যেন আমরা খাটো করে না দেখি। করোনা আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে ঈদ-উৎসব আর ঈদযাত্রার আনন্দ কিন্তু ঈদের দিন আত্মীয়-পরিবার-পরিজনকে ভালোবাসার আনন্দটুকু যেন কেড়ে না নেয়। সবাইকে ঈদ মোবারক। ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App