×

পুরনো খবর

এবং কথা- ৭১

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ মে ২০২১, ১২:৫৪ এএম

মাহফুজ রিপন আজ ষোলোই ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। এই দিনে বাঙালি জাতি নয় মাসের মুক্তির সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছিল লাল-সবুজের পতাকা, একটি মানচিত্র, একটি দেশÑ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। ধরমপুর মাধ্যমিক স্কুলে মহান বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান চলছে। দর্শক সারিতে স্কুলের ছাত্র, শিক্ষক এবং অভিভাবকগণ। সঞ্চালক মাইক্রোফোন নিয়ে বললেন, ‘প্রিয় সুধী, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে আমাদের স্কুলের শিক্ষক তপু রায়হানের কাছ থেকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনবো।’ ছাত্ররা করতালি বাজাল। তপু রায়হান আসন ছেড়ে মঞ্চে এলেন। মাইক্রোফোনটা সঞ্চালকের হাত থেকে নিয়ে সামনের সকলকে একবার দেখে ধীরে ধীরে বলা শুরু করলেনÑ ‘সুধীজন, মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা নেবেন। আজ আপনাদের একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প শোনাবো। সেই মহামানুষটা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, প্রথম অপারেশনটা কীভাবে হয়েছিল; সেই গল্প। গল্পের নায়ক কিন্তু আমার বাবা।’ ‘আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা রায়হান শেখ স্বদেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য, একটি নতুন পতাকার জন্য যুদ্ধ করেছেন। তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। এমনি করে স্বাধীনতা সংগ্রামের মানুষগুলো দ্রুতই আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তাদের এই বিদায় খুব কষ্টের। আমরা ক্রমেই তাদের চিরতরে হারাচ্ছি। আজ সন্তানের হয়ে বাবার বীরত্ত্বের কথা বলবো, এটা আমার জন্য খুবই সম্মানের। আমার পিতা তার যাপিত জীবনের ভাঁজে ভাঁজে, যুদ্ধের দিনগুলোর কথা এবং তাঁর কর্মময় জীবনের কথা নানাভাবে আমাদের বলে গিয়েছেন। ঘরে কোনো অতিথি এলেÑ মুড়ি, পাটালি গুড় এবং আদা-চায়ে চুমুক দিতে দিতে যুদ্ধের সময়ের কথা বলতেন। সেই সব কথা পরিবারের সবাই শুনেছি। সেগুলো এখন স্মৃতিতে জমাট বেঁধে আছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে এইটুকু পাওয়াই অনেক গর্বের।’ ‘বাবা মাত্র ষোলো বছর বয়সে কর্মজীবন শুরু করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। দেশের নানা প্রান্তের সেনা নিবাসগুলোয় তিনি চাকরিসূত্রে থেকেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানেও গিয়েছেন। সেখানে থাকার সময়ে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যকার পার্থক্য তাকে নাড়া দিতো। স্বাধীন দেশে পশ্চিম পাকিস্তান যে সুবিধাগুলো পাচ্ছিল, তা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পাচ্ছিল না। পূর্ব প্রান্তে এই নিয়ে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলন হচ্ছিল। যা আমার বাবা সেনা ব্যারাকে থেকে, রেডিও শুনে এবং খবরের কাগজ পড়ে জানতেন। নিজের রাজ্য পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তানের মতোই সব সুযোগ-সুবিধা পাবে এই আশাই তিনি করতেন সবসময়। কিন্তু দেশের সামরিক নেতারা (তাঁরই উর্ধ্বতন কমান্ডাররা) সেটা চাইতেন না। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারাও। তাই একাত্তরের সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ তাঁকে উদ্বীপ্ত করেছিল। আর পঁচিশে মার্চের কালরাতে ঢাকায় যখন নির্বিচারে গণহত্যা চলছিল, তখন তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কর্মরত। কী ঘটছে ঢাকায়, তা অন্যদের মতো তিনিও জানতেন না। তবে তাঁদের মনে একটা উৎকণ্ঠা ছিল সব সময়। প্রতিদিনের শারীরিক ব্যায়ামের বিরতিতে নিয়মিত বাঙালি সেনাদের সাথে দেশের অবস্থা নিয়ে আলোচনা হতো। দিনের পর দিন ব্যারাকে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি দেখে বাঙালি সৈন্যদের চিন্তা হচ্ছিল। তবে কি ওদের কোনো দুরভিসন্ধি আছে? ডি কোম্পানিতে তখন কোর্স চলছে। আর যে চারপায়াতে তিনি ঘুমাতেন, তার পাশেই থাকত থ্রি নট থ্রি রাইফেল। অস্ত্রটা তাঁর অতি প্রিয়, চাকরিতে যোগদানের পর থেকে এই একটি অস্ত্রই তিনি বহন করছিলেন। যে কোর্সটা চলছিল, সেটা ছিল আসাল কোর্স, এখানে বেয়োনেটের ব্যবহার এবং শরীরের কৌশলই ছিল মুখ্য। তাই রুমে অস্ত্র থাকলেও গুলি ছিল না। পঁচিশে মার্চের গভীর রাত, হঠাৎ কুকুর বিশ্রীভাবে চিৎকার করে উঠল। কিছুক্ষণ পরে গুলির শব্দ! কিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজায় বুটের লাথি। রায়হান শেখ বুঝতে পারলেন, পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি সেনাদের আটক করছে। তিনি লাফ দিয়ে মেঝেতে নামলেন, সাথে আরও চার-পাঁচজন সহযোগী মিলে চারপায়ার সাহায্যে দরজায় পেলা দিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু সে বাঁধা বেশি সময় টিকবে না বুঝতে পেরে জানালার শিক বাঁকা করে একে একে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। তারপর ড্রেনের ভেতরে নিজেদের লুকিয়ে সেনানিবাস থেকে অতি সন্তর্পণে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তখন গভীর রাত। বড় রাস্তা ছেড়ে দিয়ে তারা জঙ্গলের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলেন। সাথে চারজন সৈনিক। তাদের বাড়িও পূর্ব পাকিস্তানের নানা জায়গায়। বাকি চারজন তাদের মতো চলে গেলেন। এরপর তিন রাত তিন দিন পায়ে হেঁটে, অনাহারে-অর্ধাহারে বাবা যখন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে এলেন, তখন ফজরের আজান দিয়েছে সবেমাত্র। মুকসুদপুর সদর থেকে তাঁকে আরো সাড়ে তিন মাইল পথ হাঁটতে হবে নিজের গ্রাম কাওয়ালদিয়া পৌঁছানোর জন্য। কমলাপুরের খাল পার হয়ে প্রভাকরদী গ্রামে আসতেই দেখলেন, দুধ বিক্রেতা একদল কিশোর, তারা মাথায় দুধের হাঁড়ি নিয়ে ছুটছে। সেখান থেকে পা বাড়াতেই দেখলেন তাঁর বাড়ির পাশের রুস্তুম শেখ লালশাকের আঁটি নিয়ে টেংরাখোলা বাজারে যাচ্ছে। সাত সকালে বাবাকে দেখে রুস্তুম শেখ থমকে দাঁড়ালেন! মাথা থেকে শাকের আঁটি নামিয়ে প্রথমেই তিনি আমার দাদির মৃত্যুর খবর দিলেন। বাবা পাগলের মতো হয়ে গেলেন। দীর্ঘ পথ হাঁটতে হাঁটতে তাঁর পায়ের তলায় দুটি ফোসকা পড়েছিল। যে ব্যথা তিনি উপলব্ধি করতে পারছিলেন; কিন্তু রুস্তুম শেখের কথা শুনে বুকের মাঝে শত শত ফোসকা পড়ে গেল, সে উপলব্ধি ভয়ানক কষ্টের! পৃথিবীর গভীরতম কষ্টের সেই খবর শোনার পর তার পা আর একদম এগোচ্ছিল না। বাবা তার মায়ের মুখ দেখার জন্য সেনানিবাস থেকে কোনোক্রমে পালিয়ে এসেছেন নিজ গ্রামে, নিমেষেই সে মানুষটির বেঁচে থাকার ইচ্ছা চিরতরে মন থেকে যেন মুছে গেল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বাবা আবার হাঁটা শুরু করলেন। বাড়ি পৌঁছে দাদির কবর জিয়ারত করলেন। একদম শান্ত হয়ে গেলেন বাবা। এই সময়ে দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। একজন সৈনিক হিসেবে তিনি আর শান্ত থাকতে পারলেন না। আগে দেশ, নিজের মাতৃভূমি; তিনি ঘর ছাড়লেন। আমার দাদির মৃত্যুতে তাঁর কোনো পিছুটানই যেন রইল না। একটা গামছায় চিঁড়া আর পাটালি গুড় বেঁধে তিনি যুদ্ধে চলে গেলেন। পরদিন সকাল দশটার দিকে এলেন কালনা ঘাটে। ডিঙি নৌকায় মধুমতি নদী পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাবা যখন নড়াইলের লোহাগড়া বাজারে এসে দাঁড়ালেন তখন প্রায় দুপুর। সেদিন হাটবার ছিল। কিন্তু মানুষের তেমন ভিড় ছিল না। মুদিখানা, নাপিতের দোকান আর দু-একটা ওষুধের দোকান খোলা ছিল। চারপাশে এক ধরনের অস্থির নীরবতা, বাবা একটা নাপিতের দোকানে গিয়ে ভাঙা আয়নায় নিজেকে দেখলেন। মাথার চুলগুলো কেমন লালচে হয়ে উঠেছে। কষ্টের কথা ভাবতে ভাবতে বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের দিকে তাকাতেই তার নজরে পড়ল ছই দেয়া একটা নৌকা। নৌকায় তিনজন জওয়ান। নৌকার গলুইয়ে যে বসে আছে, দূর থেকে তাকে তৈয়ব শেখের মতো মনে হয়। তৈয়ব শেখ পুলিশে চাকরি করতেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পাকিস্তানি সেনাদের প্রথম প্রতিরোধের সময় তিনি দুই হাতে বন্দুক চালিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। বাবা দ্রুত খালপাড় দিয়ে নেমে ঘাটে এসে দাঁড়ালেন। চিৎকার করে বললেন, ‘তৈয়ব ভাই না? তোমরা কোথায় যাও? আমারে সাথে ন্যাও।’ তৈয়ব শেখ দূর থেকে ভালো করে দেখে দ্রুত নৌকা ঘাটে ভিড়ালেন। লাফ দিয়ে বাবা নৌকায় উঠলেন। তখন পরিচয় হলো রুহুল আমিন, জব্বার মোল্যা আর স্কুল মাস্টার রফিকের সঙ্গে। তৈয়ব শেখ আমার বাবার দূর সম্পর্কের মামাতো ভাই হন। ছোটবেলায় নাকি দুজন গ্রামের পাঠশালায় একই সঙ্গে পড়েছেন। নৌকার সবাই যাচ্ছিলেন বাইশরশির দিকে। সেখানে আরো কয়েকজন মিলিত হবেন। সন্ধ্যার আগেই তাঁদের পেঁৗঁছতে হবে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে সবার বৈঠা একযোগে পানিতে নামল। বাইচের নৌকার মতো কলকল শব্দ শুরু হলো তখন। এরপর বড় বিল পার হয়ে তাঁরা কুমার নদীতে এসে পৌঁছালেন এবং সন্ধ্যা হওয়ার বেশ আগেই পৌঁছে গেলেন বাইশরশির বাবুবাড়ি। পুরনো জমিদার বাড়ির মতোই বাইশরশির বাবুবাড়ি। পুরনো ইমারত, নানা রকম গাছগাছালির ছায়ায় ঘেরা এ বাড়ির উঠোন। সেখানে অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিরত সেনা, ইপিআর, পুলিশ সদস্যদের সাথে গ্রামের আরো কিছু মানুষ একটি মানচিত্র নিয়ে বসে আছে। পাশে শোঁ শোঁ শব্দে রেডিও বাজছে। সবার মধ্যে একটা থমথমে ভাব। কিন্তু তৈয়বরা যাওয়ার সাথে সাথেই বাবুবাড়ির সবার মধ্যে একটা আলাদা গতি চলে আসল। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এলো। কেরোসিনের কুপি জ¦ালিয়ে, রাতের খাবার তাড়াতাড়িই খেয়ে নিল সবাই। এরপর মূল মিটিং শুরু হলো। স্বাধীনতার এই যুদ্ধে এখানের সবাই যেতে চায়; কিন্তু অস্ত্র কোথা থেকে আসবে। ভাবতে ভাবতে রাত শেষ হয়ে আসে। বাবা আগেই জানতেন, এই অঞ্চলের একজন ডাকাত বাস করে। তার সাথে যোগাযোগ করলে কেমন হয়। এ কথা বলা মাত্র সঙ্গে সঙ্গে সবাই সম্মতি জানাল। ডাকাতের নাম রুস্তুম। তার কাছে অস্ত্র আছে এবং সে অস্ত্রের সন্ধানও দিতে পারেবে। রুস্তুম খুবই ভয়ঙ্কর, পুলিশের সাথে গোলাগুলি করে অস্ত্র রেখে দেয়া ডাকাত। মসজিদে ফজরের আজান দিয়েছে। পূর্ব আকাশ ফুঁড়ে সূর্যের লাল আভা বেরিয়েছে পথে। রফিক মাস্টার এবং বাবা তেল-কালি মেখে ভিক্ষা করতে বের হলেন। পরনের জামা ও লুঙ্গি ছেঁড়া। হাতে টিনের থালা। একজন চোখে দেখে না অন্যজন তাকে সহযোগিতা করে। দুজনের মাথায় টুপি, মুখে ইসলামি গজল। সারা গ্রাম ঘুরে নাস্তার বেলা হলে আস্তে আস্তে তাঁরা রুস্তুম ডাকাতের বাড়িতে ঢোকে। কুকুর ঘেউঘেউ করে ওঠে। রফিক মাস্টার, বাড়ির লোকজন তাঁদের দেখছে কি না লক্ষ করে কুকুরকে চাঁড়া বিস্কুট খেতে দেয়। মুহূর্তে কুকুর দুটো শান্ত হয়ে যায়। গজল গাইতে গাইতে তাঁরা বাড়ির ভেতরে ঢোকে। দুজন দুজনের দিকে তাকায়। পুকুরঘাট থেকে শুরু করে গাছপালা কোথায় কোনটা অবস্থিত, কোন রাস্তা কোথায় গিয়েছে তারা সব লক্ষ করে। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসা আলাপে তাঁরা বুঝতে পারে, আজ রুস্তুম ডাকাত বাড়িতে আসবে এবং এটাও জানে, রুস্তুম ডাকাত এলাকার শান্তি কমিটিতে যোগ দিয়েছে। সুধী, আপনারা জানেন, রাজাকারবাহিনী গঠনের আগে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর সহযোগিতায় এ দেশে শান্তি কমিটির মতো একটি ভয়ঙ্কর দল গঠিত হয়েছিল। শান্তি কমিটির সবাই পরবর্তী সময়ে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসে যোগ দিয়ে তাণ্ডব চালায় পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে। সারাদিন এখানে সেখানে কাটিয়ে যখন তাঁরা বাইশরশির বাবুবাড়ি ফিরলেন, তখন বেশ রাত। দলের সবার মধ্যে রুস্তুম ডাকাতের সব বিষয় তাঁরা খুলে বলেন। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল, রুস্তুমের বাড়ি আক্রমণ করতে হবে। এটাই হবে তাঁদের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। মাটির রাস্তার জায়গায় জায়গায় কাদা-পানি জমেছে। জুতা পায়ে সে রাস্তায় হাঁটা অসম্ভব। দলের সবাই খালি পায়ে মাজায় গামছা জড়িয়ে নিলেন। দু-একজনের গায়ে চাদর। একজনের হাতে বাজারের ব্যাগ। চাদরের আড়ালে এবং বাজারের ব্যাগে দেশি ধারাল অস্ত্র। সব মিলে আটজন বের হলেন। বাবুবাড়ি থেকে দুই মাইল রাস্তা অতিক্রম করার পর তাঁরা দু-দুজন করে চার ভাগ হয়ে হাঁটা শুরু করলেন। আর পরিকল্পনা করলেন রুস্তম ডাকাতের বাড়ির চার দিক দিয়ে আক্রমণের। তবে একটা ভয় ছিলÑ দেশি অস্ত্র, ডাকাতের বন্দুকের সাথে পেরে উঠবে কি না? তবুও উপায় নেই। তাঁরা যখন বাড়ির কাছে পৌঁছলেন তখন রাত তিনটা। চারদিকে সুনসান নীরবতা। কুকুরটাও বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। চারটি দল বাড়ির চার পোতায় চারটি টিনের ঘরের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। তাঁরা বোঝার চেষ্টা করলেন, কোন ঘরে রুস্তম ডাকাত রয়েছে। তৈয়ব শেখ ইশারায় বললো, বাড়ির দক্ষিণ পাশের ছোট ঘরে তার থাকার সম্ভাবনা আছে। গরমও পড়েছিল ভীষণ। তাঁরা ঘরের পেছন থেকে ধীরে ধীরে উঠানের কাছে এসে দাঁড়ালেন এবং দেখলেন, ছোট ঘরের খোলা বারান্দায় জলচৌকির ওপরে মাথা রেখে কে যেন ঘুমাচ্ছে। দ্রুতই তাঁরা ঘরটা ঘিরে ফেললেন। বাবা এবং তৈয়ব শেখ যখন বারান্দার কাছে গেলেন, দেখলেন ডাকাতদলের এক সদস্য পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু ভাগ্য ভালো যে সে তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। একনলা একটি বন্দুক রাখা ছিল মাটিতে। তৈয়ব শেখ আস্তে আস্তে বন্দুকটা কুড়িয়ে নিলেন এবং বাবার হাতে দ্রুত চালান করে দিলেন। বাবা সেটি দিলেন তাঁদের পিছে এগিয়ে আসা একজনের হাতে। এবার তাঁরা দুজনে সতর্কতার সাথে ডাকাত সদস্যটার কাছে গেলেন এবং গামছা দিয়ে মুখ চেপে ধরলেন। যাতে কোনো শব্দ করতে না পারে। তারপর হাত-পা দড়ি দিয়ে বেঁধে বাগানের ভেতর একটি গাছের সাথে বেঁধে রাখলেন। মুখটা গামছা দিয়েই বাঁধা হয়েছিল। এবার দেশি ধারালো অস্ত্রের সাথে তাঁদের হাতে একটি একনলা বন্দুক। তৈয়ব শেখ দ্রুত দেখে নিলেন বন্দুকে গুলি আছে কি না। গুলি একদম লোড করাই ছিল। এরপর দরজার সামনে শিং খুঁচে একে একে চারজন ঘরের ভিতরে গেলেন। বাকি চারজন বাইরে প্রস্তুত থাকলেন। তাঁরা ঘরের ভিতরে গিয়ে দেখলেন, নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে রুস্তম ডাকাত। পাশে তার ছোট বউ। এবার কী করবেন। তখন একজন ঘর থেকে বের হয়ে আরো দুজনকে ডাকলেন ভেতরে আসতে। ইশারায় বুঝানো হলো, আগে রুস্তুমকে ঘুমন্ত অবস্থায় বেঁধে ফেলতে হবে। তার বৌকে বলা হবে চুপ থাকতে। যদি সে-ও আক্রমণ করতে যায়, তাহলে তাকেও বেঁধে ফেলতে হবে। সেই মতো দুজন রুস্তুমকে চেপে ধরলেন। আর দুজন দড়ি দিয়ে বাঁধা শুরু করলেন। তৈয়ব শেখ এক নলা বন্দুকটা তার দিকে তাক করে রইলেন। অন্য এক হাত দিয়ে জলচৌকির ওপরে রাখা হারিকেনটার আলো বাড়ালেন। ধস্তাধস্তি ও হারিকেনের আলোয় রুস্তুমের বই উঠে গেল সাথে সাথেই। বাড়ির কুকুরটিও এতক্ষণ বাদে চেঁচানো শুরু করল ডাক ছেড়ে। বাবা রুস্তুমের বউকে বোঝানো শুরু করলেন। বন্দুক ও এত মানুষজন দেখে সে আর রা করল না। এরপর রুস্তুমকে কষে বেঁধে দুজনে প্রায় কাঁধে করে বাড়ির উঠোনে নিয়ে এলেন। চার ঘরের অন্য সদস্যরাও উঠে গিয়েছিল ততক্ষণে। কুকুর এই শেষ রাতে বিশ্রীভাবে ডাকছে কেন? এটাই ছিল তাদের জেগে ওঠার কারণ। তাদের মধ্যে রুস্তুমের আরো তিন বউ ছিল। সব মিলে রুস্তুমের চারটা বউ। তারাই সামনে এসেছিল। বাকি সকলকে ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছিল না হারিকেনের আলোয়। তবে একটা বিষয় দেখা গিয়েছিল সবার মুখে। তা হলোÑ স্বস্তি। অতিষ্ঠ করা এই ডাকাতের ওপর সবারই একটা চাপা ক্ষোভ ছিল। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছিল না। সেই রাতেই রুস্তুম ডাকাতকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুকুরের ভেতর থেকে, ঘরের পাটাতন থেকে অনেক অস্ত্র, নগদ অর্থ এবং সোনার গহনা উদ্ধার করেছিল নবগঠিত সেই মুক্তি বাহিনীর দল। ভোরে আলো ফুটতেই রুস্তুম ও তার দলের সদস্যকে নিয়ে তাঁরা রওনা হলেন যশোর জেলার দিকে। গ্রাম্য জঙ্গলের পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ডাকাতদের সাথে কথাবার্তায় অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছিল। পাকিস্তানি সেনারা শান্তি কমিটির মাধ্যমে তাদের এই অস্ত্র দিয়েছে। যে অস্ত্র এখন হাত বদল হয়ে তৈয়ব আর রায়হান শেখদের কব্জায়। এই অস্ত্র নিয়েই পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে লড়বে তাঁরা। মুক্তিযোদ্ধাদের মনে এক ধরনের চাঞ্চল্য ও দৃঢ়তা ফুটে ওঠে, কেননা তাঁদের প্রথম অপারেশনটা যে সফল হয়েছে।’ হঠাৎ ঘুঙুরের শব্দ। সঞ্চালক তপুর হাত থেকে মাইক্রফোনটি নিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানালেন। আস্তে আস্তে মঞ্চের আলো নিভে গেল। কিছুক্ষণ পরেই রঙিন আলোতে বিজয় নিশান বেজে উঠল। জয় জয় বাঙালির জয়, জয় জয় জনতার জয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App