×

জাতীয়

চীনা রাষ্ট্রদূতের আকস্মিক রূঢ় ভাষা ব্যবহারে বিস্ময়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ মে ২০২১, ১১:২২ এএম

চীনা রাষ্ট্রদূতের আকস্মিক রূঢ় ভাষা ব্যবহারে বিস্ময়

চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ঢাকায় এসে দুই দেশের সহযোগিতাকে অর্থনীতি থেকে রাজনৈতিক পর্যায়ে উত্তরণের স্পষ্ট বার্তা দিয়ে যাওয়ার বছর পাঁচেক পর দেশটির রাষ্ট্রদূত লি জিমিং রীতিমতো হুমকি দিলেন বাংলাদেশকে। গতকাল সোমবার এক ভার্চুয়াল মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের ‘কোয়াড’ জোটে বাংলাদেশ যোগ দিলে চীন ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ধ্বংস হয়ে যাবে। এরপর থেকেই ঢাকা-বেইজিং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কোন দিকে গড়াবে- তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। কূটনৈতিক মহল আকস্মিক এমন হুমকিতে বিস্ময় প্রকাশ করলেও সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, ‘কোয়াড’কে চীন কঠিনভাবে দেখছে। এই প্রেক্ষাপটে তারা মনে করেছে, কোয়াডে যোগ দিলে বাংলাদেশও চীনবিরোধী হয়ে পড়বে। সবমিলিয়ে এটা স্পর্শকাতর ইস্যু। এখানে অন্য মাত্রা আছে। এটা নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, চীনকে ঢাকার স্পষ্টভাবে বলা উচিত, তোমরা যে সহযোগিতা চাইছো তা আমরা দেব, কিন্তু তার আগে আমাদের ভ্যাকসিন দাও, রোহিঙ্গা ফেরাতে সাহায্য কর।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্টে শি জিন পিং ঢাকা সফরের ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে রাজনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে উদ্যোগী হয় ঢাকা-বেইজিং। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সারা বছরের সময়সূচিভিত্তিক কাজের তালিকা তৈরি করে বাংলাদেশ ও চীন। ওই সফরের পর বার্তা সংস্থা সিনহুয়া জানিয়েছিল, রাজনৈতিক স্তরের উচ্চপর্যায়ে পারস্পরিক আস্থা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা এগিয়ে নেয়ার মাধ্যমে সম্পর্ককে নতুন ধাপে নেয়ার এটাই সঠিক সময়। এরপর থেকে দেশ দুটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যুক্ত হয়ে নানা কাজও সম্পাদন করে।

কিন্তু গত এপ্রিলে ঢাকা সফরে এসে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল ওয়েই ফেঙ্গহি ‘কোয়াড’ নিয়ে ঢাকাকে কড়া বার্তা দিয়ে যাওয়ার পর রাষ্ট্রদূত লি জিমিং গতকাল তার পুনরাবৃত্তি করেন। এরপরই ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে, বেইজিংয়ের সঙ্গে ঢাকা এখন কেমন সম্পর্ক রাখবে? ‘কোয়াডে’ বাংলাদেশের অবস্থানই বা কি হবে?

চীনের রাষ্ট্রদূতের এই ‘হুমকি’ যে কথার কথা নয়; তা তার কাজেই ফুটে উঠেছে। যে চীন বাংলাদেশকে করোনার টিকা নিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত করেছিল- সেই চীনই এখন বলছে ডিসেম্বরের আগে ঢাকার কাছে টিকা বিক্রি করতে পারবে না। তবে চীনের দেয়া উপহারের ৫ লাখ টিকা আগামীকাল বুধবার ঢাকায় পৌঁছাবে। গতকাল সোমবার সকালে ‘ডিকাব টকে’ রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, চীন মনে করে কোয়াড গ্রুপটি চীনবিরোধী। আমি এটা পরিষ্কার করে বলতে চাই, কোয়াড নিজেকে অর্থনেতিক কাজে সম্পৃক্ত বলে দাবি করলেও তা সত্য নয়। এই চার সদস্য বিশিষ্ট ক্লাবে যোগ দিলে এটি বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে না। কারণ এর ফলে চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ধ্বংস হবে।

প্রসঙ্গত, স্মরণাতীতকালে কোনো কূটনীতিক এত কঠিন ভাষা ব্যবহার করেননি। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ কোয়াডে যোগ দেবে- এমন কথা না বললেও রাষ্ট্রদূত কেন এই রূঢ় ভাষা ব্যবহার করলেন?

জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, চীনের রাষ্ট্রদূত ‘ধ্বংস’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে তিনি এই ধরনের শব্দ কেন ব্যবহার করলেন তা বুঝতে হবে। বাংলাদেশতো কোয়াডে যোগ দেবে এমন কথা কখনোই বলেনি; তবু অযাচিতভাবে রাষ্ট্রদূতের এমন ভাষা ব্যবহার প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তিনি বলেন, ভ্যাকসিন কূটনীতি নিয়ে হয়তো ঢাকার প্রতি চীনের ক্ষোভ রয়েছে। তাই বলে এমন রূঢ় ভাষার প্রয়োগ, যা আমাদের বিস্মিত করেছে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রদূত এই রূঢ় ভাষা সরাসরি না হলেও সরকারকে ইঙ্গিত করেই বলেছেন। এক্ষেত্রে সরকার হয়তো পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারে। তবে এটা ঠিক চীন যখন কোনো কথা বলে সুদূরপ্রসারি চিন্তা-ভাবনা করেই বলে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই জোট যে চীনবিরোধী জোট হিসেবে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে সেটা চীনের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে আরো স্পষ্ট হয়েছে। অনেকেই বলেছেন, ইউরোপের সামরিক জোট ন্যাটো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আগ্রহ কমলেও, মূলত চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব-প্রতিপত্তির জবাব দিতে এশিয়ায় ন্যাটো ধাঁচের একটি জোট গঠনে আমেরিকা আগ্রহী হয়ে পড়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় ছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনকে কোণঠাসা করতে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মিত্রদের নিয়ে একটি সামরিক জোট গড়তে আগ্রহী হয়ে পরে। তবে চীনকে আটকাতেই যে এই জোটবদ্ধ উদ্যোগ, পরিষ্কার করে তা আগে কখনোই বলা হয়নি। এমনকি এসব বৈঠক নিয়ে এই চারটি দেশের সরকারগুলোর পক্ষ থেকে জনসমক্ষে যেসব ঘোষণা দেয়া হয়েছে বা যেসব নথিপত্র চালাচালি হয়েছে, তার কোথাও চীন শব্দটিই নেই।

তবে রাষ্ট্রদূত লি জিমিং নিজেও জানান, জোটটি চীনবিরোধী। যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের জোটে যোগ দিলে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক অবনতি হবে। চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও দেশটির স্টেট কাউন্সিলর ওয়েই ফেঙ্গহি ২৭ এপ্রিল একদিনের জন্য ঢাকা সফরে আসেন। সফরের সময় তিনি জানান, কোয়াডকে তারা চীনবিরোধী জোট বলে মনে করেন। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ভূমিকা নিয়েও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে কথা হয় তার।

২৭ এপ্রিল চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঢাকা সফরে আসার আগে মার্চে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর ও এপ্রিলে ভারতের সেনাপ্রধান ঢাকা সফর করেন। জয়শংকর ঢাকায় এসে বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক সংযুক্তির অর্থাৎ ওই সাগর সন্নিবেশিত ৯টি দেশে চীনের উপস্থিতি কমানোর প্রতি ইঙ্গিত করেন। প্রসঙ্গত, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে নৌ চলাচল ‘অবাধ ও স্বাধীন’ রাখার উপায় খোঁজার যুক্তি দেখিয়ে ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যে ‘কোয়াড’ (কোয়াড্রল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ) সংলাপের সূচনা হয়।

চীনা রাষ্ট্রদূত যে কোয়াড নিয়ে কথা বলেন তা নয়, রোহিঙ্গা নিয়েও কথা বলেছেন। তিনি জানান, মিয়ানমারে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হওয়ায় এ বিষয়ে এখন বাংলাদেশের ধৈর্য ধরা ছাড়া কোনো উপায় নেই। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ এখনই সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশও যোগাযোগ করতে পারছে না। পরিস্থিতি উন্নতির কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। আমাদের ধৈর্য ধরা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আমরা দ্রুত কোনো ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সম্ভাবনা দেখছি না।

করোনা ভাইরাসের টিকা প্রসঙ্গে চীনা রাষ্ট্রদূত জানান, তার দেশ বাংলাদেশকে সিনোভ্যাকের টিকা দেয়ার প্রস্তাব দিলেও ঢাকা এ টিকা পেতে এখনো অনুমতি দেয়নি। বাংলাদেশ শুধু সিনোফার্মকে অনুমোদন দিয়েছে, তাই শিগগিরই সিনোভ্যাক ভ্যাকসিন পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, ‘জি টু জি’ কিংবা বাণিজ্যকভাবে চীন বাংলাদেশকে টিকা দিতে প্রস্তুত। কিন্তু শুধু সিনোফার্ম কোম্পানিকে বাংলাদেশ সরকার জরুরি অনুমতি দেয়ায় লম্বা সিরিয়ালের জটিলতা তৈরি হয়েছে। তাও এ সিদ্ধান্ত নিতে বাংলাদেশ সময় নিয়েছে তিন মাস। ফলে এখন দ্রুত টিকা পাওয়ার সিরিয়ালে সামনে আসতে পারেনি বাংলাদেশ।

লি জিমিং বলেন, আপাতত আমি যেটুকু বলতে পারি, বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশের টিকা কেনার জন্য আমার তরফ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করব। তবে বেইজিংয়ে আমার সহকর্মীরা প্রথমে আমাকে যেটা বলেছে, ওই লাইন এত বেশি দীর্ঘ যে ডিসেম্বরের আগে টিকা পাওয়ার আশা না করাই ভালো।

তিস্তা ‘রিভার কম্প্রিহেন্সিভ ম্যানেজমেন্ট এন্ড রেস্টোরেশন’ প্রজেক্টে চীনের ঋণ প্রস্তাব নিয়ে লি জিমিং জানান, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। ‘ফিজিবিলিটি স্ট্যাডিজ’ এর রেজাল্ট পেলে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু হতে পারে। তার মতে তিস্তা নিয়ে যে কোনো প্রকল্প করা বাংলাদেশের জনগণের অধিকার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App