×

মুক্তচিন্তা

কেনাকাটা ও ঈদযাত্রায় ভূলুণ্ঠিত স্বাস্থ্যবিধি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ মে ২০২১, ১২:৩৭ এএম

কম-বেশি সব সচেতন মানুষের দৃষ্টি এখন করোনা ভাইরাসের দিকেÑ বিশেষ করে ভাইরাসটির রূপ-রূপান্তরের দিকে। এই ভাইরাসের নতুন নতুন ধরন যেমন দ্রুত ছড়ায় তেমনি বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যেও সংক্রমিত হয়। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা প্রতিরোধের সক্ষমতাও করোনা ভাইরাসের নতুন নতুন এসব ভ্যারিয়েন্টের রয়েছে। এসব ভ্যারিয়েন্ট মৃত্যুঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। সুতরাং করোনা থেকে বৈশ্বিক মুক্তি লাভের সম্ভাবনা আরো দীর্ঘায়িত হলো। এ সংবাদ আমাদের মধ্যে হতাশাও আরো বাড়িয়ে দিল। কিন্তু করোনা নিয়ে বিশ্ববাসীর হতাশা বৃদ্ধি পেলেও আমাদের মানচিত্রে করোনার প্রতি মানুষের আচরণ এক অদ্ভুত খামখেয়ালিপনায় আচ্ছন্ন। ১৬ মে পর্যন্ত আন্তঃজেলা অর্থাৎ দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধসহ ৬ মে থেকে জেলায় জেলায় অভ্যন্তরীণ গণপরিবহন পরিষেবা চালুর সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি হলেও ৫ তারিখেই আমরা টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলের কল্যাণে দেখতে পেলাম অনেক স্থানেই গণপরিবহন চালু হয়ে গেছে! আবার ৬ তারিখ দেখতে পেলাম জেলা শহরের ভেতর অভ্যন্তরীণ রুটে গণপরিবহন চলাচল করায় পরিবহন সংশ্লিষ্টরা তেমন আনন্দ পাচ্ছেন না! তারা পুলিশকে নানাভাবে ‘কনভিন্স’ করে কিংবা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় অর্থাৎ ‘অন্তঃজেলা’য় নয়Ñ ‘আন্তঃজেলা’য় চলাচল শুরু করেছেন এবং এতেই তারা বেশি উৎসাহী! যাত্রীও আছে মোটামুটি প্রচুর। তাই পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোয় চলাচল ও যাতায়াতে গণপরিবহনের মালিক-শ্রমিকরা নানা রকমের ফন্দি-ফিকিরের আশ্রয়ও নিচ্ছেন। সরকার কঠোরভাবে চাইলেও গণপরিবহন আর কোনোভাবেই ‘অন্তঃজেলা’য় সীমাবদ্ধ থাকছে না। ফলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের সদিচ্ছা পরিবহন মালিক-শ্রমিক এবং ‘ঘরমুখো’ মানুষের অতি বৈপ্লবিক তথা উল্লসিত চলাচলে একেবারেই ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়েছে! আসন্ন ঈদ উপলক্ষে শৌখিন কেনাকাটা এবং নাড়ির টানে বাড়ি যাওয়ায় মানুষের ভিড় দেখে স্বাভাবিককাল আর করোনার মহামারিকালের মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য নির্ণয়ই যেন দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে! দোকানপাট, শপিংমল এবং বিভিন্ন স্টেশন ও ফেরিঘাটে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখে বোঝারই উপায় নেই যে, এ দেশের জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেকেই করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে অস্থির ও উদ্বিগ্নতার মধ্যে চরম আতঙ্কে বসবাস করছেন। আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত কতটা সক্ষম ও সমৃদ্ধ তার প্রমাণ বিগত চার-পাঁচ সপ্তাহ আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। তখন দৈনিক মৃত্যু একশর ওপরে চলে গিয়েছিল। আর সংক্রমণ হয়েছিল দৈনিক সাত হাজারের বেশি। আমরা হাসপাতালগুলোর করুণ চিত্র যেমন দেখেছি তেমনি দেখেছি অসুস্থ স্বজনদের নিয়ে মানুষের আহাজারি ও আর্তনাদ! সেই সঙ্গে দেখেছি স্বাস্থ্যকর্মীদের অসহায় এবং অসমর্থ চাপাকান্নাও। কিন্তু তখনো আমরা দেখেছি দোকানপাট খুলে দেয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের আন্দোলন ও অবরোধ কর্মসূচি। ব্যবসায়ী সমাজের পক্ষ থেকে হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকর্মী, করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তি কিংবা অসুস্থ মানুষের স্বজনদের দিকে মানবিক দৃষ্টিতে তাকাতে দেখিনি। শুধু দেখেছি ‘জীবন’ ও ‘জীবিকা’র বিচিত্র অজুহাতে নানাভাবে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যনীতি ও পদক্ষেপগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে! ভূমিকম্প থেকে শুরু করে রোদ, ঝড়, বৃষ্টি ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক সব অনুষঙ্গ যেমনÑ আইলা, সিডর, টর্নেডো, টাইফুন ভারতে আঘাত হানলে ভৌগোলিক সংলগ্নতার কারণেই বাংলাদেশও তার প্রভাব অনুভব করে। আবার ভারতের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাও নানামাত্রিক হওয়ায় করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঝুঁকিও অত্যন্ত প্রবল! বর্তমানে ভারতে প্রতিদিন শনাক্ত সংখ্যা চার লাখ অতিক্রম করে ফেলেছে, মৃত্যুর দৈনিক সংখ্যাও চার হাজারের বেশি। এমন অবস্থায় যে কোনো বিবেচনায় ভারতের এই সংক্রমণের প্রভাব যে বাংলাদেশে অনুভূত হবে না, তা আমাদের কোনো বিশেষজ্ঞ মহলই ধারণা করতে পারেননি, আমাদের আশ্বস্তও করতে পারেননি। ফলে এক ধরনের শঙ্কা ও আতঙ্ক আমাদের মনে জন্ম নেয় এবং এটাই স্বাভাবিক। হতে পারে সেটা চাপা আতঙ্কÑ তবু সেটা তো শেষ পর্যন্ত আতঙ্কই। প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সত্য এই যে, জনসমাগম ও মানুষে মানুষে সংস্পর্শের কারণেই করোনার বিস্তার ঘটে থাকে। তাই সাধারণকে সচেতন করার জন্যই গণপরিবহন বন্ধ রেখে এবারের ঈদ আনন্দ যে যেখানে আছেন সেখানেই উদযাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সরকারি কর্মচারীদেরকেও কর্মস্থল ত্যাগ না করার বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। কিন্তু আসন্ন ঈদ উপলক্ষে কেনাকাটা এবং নাড়ির টানে বাড়ি ফেরার আগ্রহে মানুষের সীমাহীন উল্লাস আমরা দেখতে পাচ্ছি। উল্লাসই বলি আর সাধারণ মানুষের আবেগই বলি নাড়ির টানে বাড়ি যাওয়ায় এক শ্রেণির মানুষের এই তাগিদকে কোনোভাবেই রাশ টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। ঈদ-উল্লাসের কাছে, ঈদকেন্দ্রিক তীব্র আবেগের কাছে করোনা সংক্রমণের ভীতি কিংবা আতঙ্ক একেবারে বিলীন হয়ে গেছে! তাই যাত্রাপথ স্বচ্ছন্দ না হলেও বিকল্প পন্থায় পাঁচ থেকে সাত গুণ বেশি টাকা ভাড়া গুনেই ঘরমুখো মানুষের ঢল ছুটছে! মানুষের ঢল ছুটছে দোকানপাট এবং শপিংমলেও। এবার অনেকটা যেন প্রতিশোধের ভঙ্গিতে মানুষ ঈদের কেনাকাটায় মগ্ন হয়েছে। কারণ গত বছরের ঈদে তারা পকেটের টাকার সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। এবার তাই ‘ডাবল শপিং’ করার উন্মাদনায় যেন মেতেছে! শপিং করুন, গণপরিবহন ব্যবহার করুন সমস্যা নেই। কিন্তু নিজের কথা না ভাবেন অন্যের কথা ভেবে হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি কেন রক্ষা করছেন না, সেটিই প্রশ্ন? দোকানপাট বা শপিংমলে স্বাস্থ্যবিধি মানার ন্যূনপক্ষে একটি মাস্ক ভালোভাবে ব্যবহারের মনোযোগও ‘বিক্রি-বাট্টা’ এবং ‘কেনাকাটা’র স্রোতে ভেসে গেছে যেন! সব দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, করোনাই বরং মানুষের তীব্র চাপে অতিষ্ঠ, যেন পালিয়ে বেঁচেছে! প্রবল জনস্রোতে করোনাই যেন দিশাহারা হয়ে পড়েছে আমাদের দেশে! ভারতের সাম্প্রতিক পরিণতি দেখে আতঙ্কিত হওয়া কিংবা সাধারণ মানুষকে সচেতন করে আলাপ-আলোচনা করা যেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের এক প্রকার অহেতুক ‘দুশ্চিন্তা’র বিষয়ে পরিণত! যদি কোনো জাদুর বলে সাধারণের এমন উল্লসিত হুজুগের পরও সংক্রমণ থেকে আমরা সুরক্ষা পাই তবে তো আমাদের সৌভাগ্যের প্রশংসা করতেই হবে। কিন্তু চলমান ঈদ শপিং এবং ঈদযাত্রায় মানুষের দৃশ্যমান উল্লাস শেষ পর্যন্ত কী পরিণতি বয়ে আনে জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা নিশ্চয়ই শঙ্কিতচিত্তে তাই দেখার অপেক্ষায় আছেন। ভারতের করোনা সংক্রমণের নেতিবাচক প্রভাব নেপালে পড়তে শুরু করেছে। সেখানকার মর্মান্তিক দৃশ্যও আমাদের শঙ্কিত করছে। বিগত কয়েক সপ্তাহের ‘ঢিলেঢালা’ লকডাউন পালনের মধ্যেও দৈনিক মৃত্যুসংখ্যা ১১২ থেকে পর্যায়ক্রমে গত শুক্রবার তা ৩৭-এ নেমে আসায় এবং দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা সাত হাজার থেকে নেমে দেড় হজারের কাছাকাছি আসায় আমরা যখন কিছুটা হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে যাচ্ছিলাম তখন আসন্ন ঈদ উপলক্ষে উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে মানুষের কেনাকাটা এবং নাড়ির টানে বাড়ি ফেরার উল্লাস আবারো আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মানুষের কল্যাণের কথা ভাবেন বলেই সাধারণের প্রতি আন্তরিক আবেদন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বেঁচে থাকলে প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা হবে। এবার যে যেখানে আছেন সেখানেই ঈদ করুন। আমরা জানি, আমাদের হুজুগে স্বভাবের কাছে প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বান ‘অরণ্য রোদন’ হয়ে থাকবে। উপরন্তু আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার তার এই অনুরোধকে রাজনৈতিক অপব্যাখ্যা দেয়ারও অবকাশ পাব। কিন্তু মানুষের কল্যাণের জন্য তার এই অনুরোধটি যদি এবারকার ঈদের একটি দিনের জন্য মেনে চলতে পারতাম তবে, দুঃসময়েও কিছুটা সুফল আমাদের ঘরেই আসত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যেখানে দৈনিক মৃত্যু চার হাজার অতিক্রম করছে, সংক্রমণের সংখ্যাও দৈনিক চার লাখ অতিক্রম করে গেছে, তখন আমরা কি ঈদের আনন্দ উপভোগের নামে অতিমাত্রায় স্বেচ্ছাচারিতায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছি না? করোনা থেকে সুরক্ষা পাওয়ার জন্য সতর্কতা অবলম্বন এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় কেন এমন উদাসীন হয়ে পড়েছি আমরা? অনেকে ‘জীবিকা’র কথা বললেও সব সময় তা ঠিক নয়Ñ স্বভাবের কারণেও আমরা স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে চলছি। স্বাস্থ্যবিধির ন্যূনতম বিধান মাস্ক ব্যবহার করা। কিন্তু ছোট ছোট দোকানপাট থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মীদের আমরা মাস্ক পরতে দেখি না। কেউ কেউ যাওবা মাস্ক পরেন তবু তা থুতনির নিচে ঝুলে থাকতেই দেখি। গণপরিবহনের শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও একইরূপ দৃশ্যেরই পুনরাবৃত্তি মাত্র! টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনেই যখন এই হাল বাস্তব পরিস্থিতি তখন নিঃসন্দেহে এর চেয়ে অনেকটাই রূঢ়। কিন্তু এই স্বেচ্ছাচারের পরিণাম যে ভয়াবহ তা কি কেবল দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাই ভাববেন? আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ কি কোনো দায়দায়িত্বই নেবেন না? আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App