×

মুক্তচিন্তা

মূলধারার প্রচারমাধ্যমের প্রতি পাঠকের পাঠবিমুখতা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২১, ১২:০৮ এএম

ভেবেছিলাম লিখব না বিষয়টি নিয়ে। স্থবির হয়ে বসে থাকলাম কটা দিন। হতাশা, কষ্ট নীরবতার পেছনে কাজ করেছে। অবশেষে মনে হলো দুটি কথা লিখি। লেখা দরকার। যদিও আমার এই লেখায় কারোর, কোনো কিছুর কিছুই যায় আসবেও না। তবুও দায়ের জায়গায় দাঁড়িয়ে লেখা। যা হোক, সম্প্রতি সাংবাদিকতা পেশা নিয়ে জনমনে অনেক সংশয় দেখা দিয়েছে। সাংবাদিকদের ওপর জনগণের আস্থার জায়গাটিতে কম্পন দেখা দিয়েছে। আর এই সংশয় ও কম্পন অনাকাক্সিক্ষত একটা নৃশংস ঘটনাকে কেন্দ্র করে, যা অনেকের কাছেই অনাকাক্সিক্ষত, অপ্রত্যাশিত। কারণ সংবাদমাধ্যমকেই সাধারণ মানুষ সঠিক তথ্য জানবার একটা ক্ষেত্র মনে করে থাকে। যদিও অনেক সময়ে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভাজিত ভূমিকা পালন করে থাকে। তারপরও সাধারণ মানুষের সঠিক তথ্য জানবার জায়গাটি হলো প্রচারমাধ্যম। শুধু তথ্য প্রচারই নয়, বরং অকল্যাণকর নেতিবাচক মনোভাব পরিবর্তনে বড় বেশি ভূমিকা রাখে, রাখতে পারে প্রচারমাধ্যম। আমাদের স্বাধীনতা অর্জন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর দৃশ্যমান অংশগ্রহণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত তৈরি ইত্যাদির পেছনে প্রচারমাধ্যমের বড় ভূমিকা রয়েছে। এ কথা না বললে নয় যে, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে তথ্যপ্রবাহ দলীয়করণ করায় মূলত প্রচারমাধ্যমের ওপর জনগণের এই আস্থা ধীরে তৈরি হয়েছিল। আবার দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতার কারণেই নয়, বরং কিছুক্ষেত্রে প্রচারমাধ্যমগুলো ব্যবসায়িক ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার কারণে তার নৈতিকতা, আদর্শের জায়গা থেকে দিন দিন সরে গেছে, যাচ্ছে। ব্যতিক্রম আছে অবশ্যই। যারা এখনো সাংবাদিকতার নৈতিক আদর্শ, লক্ষ্য থেকে একচুলও সরবার কথা ভাবেন না এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা এখনো সাধারণ জনগণের কল্যাণের কথা, অধিকারের কথা ভাবেন, বলেন। বাংলাদেশে নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই নিরাপদ ননÑ এই কথার দ্বিমত পোষণ করবার সম্ভবত কেউ নেই। থাকলে তার ব্যাখ্যা পক্ষপাতমূলক হতে পারে। আড়াই বছরের কন্যা শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক নারী বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন কৌশলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নৃশংসতা ও নির্যাতনের শিকার হন এবং তা প্রায় প্রতিদিনই। পথে-ঘাট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, মাদ্রাসায়, থানায়, পরিবহনে, অফিস-আদালত, ঘরে, হোটেলে এমন কোনো জায়গা বাদ নেই যে নারী যেখানে নির্যাতনের শিকার হননি। ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ড, ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মতো ঘটনা সমাজে প্রায় অহরহ। নারীর প্রতি সহিংসতা শ্রেণিভেদে ভিন্ন কৌশলে সমাজের প্রতিটি শ্রেণিতেই ঘটে। এক্ষেত্রে নারীবান্ধব প্রচারমাধ্যমগুলো গুরুত্বসহকারে সংবাদ প্রচার করে নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি এবং সবার একটা দৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করতে সক্রিয় থেকেছে, সক্ষম হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে একসময়ে ব্যাপকভাবে এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ছিল। এসিড নিক্ষেপ কমে যাওয়ার পেছনে কটি কারণের মধ্যে একটি অন্যতম কারণ ছিল, এসিড নিক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রচারমাধ্যমের ব্যাপক প্রচারণা। সেই সঙ্গে আইনকে সঠিক প্রক্রিয়ায় প্রয়োগ হতে প্রচারমাধ্যমের নজরদারি সংবাদ পরিবেশনাও বিচারহীনতার সংস্কৃতির চর্চাকেও কমিয়েছে। সম্প্রতি গুলশানে এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধার নিয়ে কটি প্রচারমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে জনমনে অনেক সংশয় ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যে প্রচারমাধ্যম নারী নির্যাতনের ইস্যু নিয়ে সোচ্চার, প্রতিবাদী থেকেছে প্রায়শই তাদের এক্ষেত্রে মৌনব্রত পালন করাটা সাধারণ মানুষের কাছে কাক্সিক্ষত হয়ে ওঠেনি। তারা মেনে নিতে পারেনি। আবার মৃত তরুণীর চরিত্র হননের বিষয়টিতেও অনেকে মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন। এক পর্যায়ে জনগণ নিজেরাই গণিতের সুদকষা অঙ্ক কষতে বসেছেন। অঙ্কে প্রাপ্ত ফলাফল সোশ্যাল মিডিয়া তথা ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন, প্রচার করেছেন। এটাই তো স্বাভাবিক। তৎক্ষণাৎ মত প্রকাশের এত সুবিশাল ও সহজ পরিসর আর কই জনগণের। মানুষ তার স্বস্তি, শান্তি খুঁজে ফিরবেন কেউ যদি সেটা দিতে ব্যর্থ হন। ফলে এমন একটি সংবেদনশীল ইস্যুতে সোশ্যাল মিডিয়া তথা ফেসবুক এখন মূলধারার মিডিয়ার থেকে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বেশকিছু ইস্যুতে সোশ্যাল মিডিয়া বড় ভূমিকাও রেখেছে। ফেসবুক আইডিধারীরাই এখন এক একজন সাংবাদিক, সম্পাদক, লেখকে পরিণত হয়েছেন। এদের মাথার ওপর মালিকের কর্তৃত্ব নেই, মাস শেষে বেতন পাওয়ার ঝুঁকি নেই, এমনকি চাকরিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে ক্ষেত্রবিশেষে কঠিন একটা বিষয় থাকে মাথার ওপর। সেট কোচিং হলো ডিজিটাল আইন। মত প্রকাশের স্বাধীনতা কোনো কোনো বিষয়ে নেই, রাখা হয় না। আমাদের দেশে সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা সবার সমান নয়। পত্রিকা ও ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন। কোনো কোনো সাংবাদিক অঢেল ধনসম্পদের মালিক, প্রভাবশালী। কোনো কোনো সাংবাদিক নিম্ন-মধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্তের প্রাচীর টপকাতে পারেননি। ধনসম্পদ কিংবা প্রভাব কোনোটাই তাদের নেই। থাকে না। ওসবে খুব একটা ভ্রুক্ষেপ করেন না। আমি এমন অনেক সাংবাদিকের খবর জানি যারা সাংবাদিকতার পেশার পাশাপাশি বেঁচে থাকবার প্রশ্নে টিউশনি, পার্টটাইম জব করেন। সাংবাদিকতা পেশা থেকে যে বেতন পান তাতে সংসার চলে না। ঠিক বিপরীতে কোনো কোনো সাংবাদিক প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত আয় করেন। পত্রিকার মালিকের সুনজর থাকায় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তাদের আরো আয়-উপার্জনের পথ খোলা থাকে। জীবনযাপনে তারা অভিজাত হয়ে ওঠেন। শিক্ষক ও সাংবাদিকÑ এই দুই পেশার মানুষদের আগে বলা হতো ছাপোষা। বলতে দ্বিধা নেই যে, এখন এদের সম্পর্কে সাধারণের ধারণা বদলে গেছে। অর্থ ও বিত্তে এদের কেউ কেউ কোটিপতির ঘরে নাম লিখিয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের না পড়িয়ে প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টার খুলে, নোট সরবরাহ করে অনেক শিক্ষক রমরমা ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ধনসম্পদ গড়েছেন। এখানে শিক্ষকতার নৈতিক মূল্যবোধ কিঞ্চিত পরিমাণ কাজ করে না। ঠিক তেমন অবস্থা কোনো কোনো সংবাদপত্রের কোনো কোনো সাংবাদিকের বেলায়। প্রচারমাধ্যমকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করিয়ে সাংবাদিকতা পেশাকে নৈতিকতার জায়গা থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে। বিত্ত বড়, নাকি আদর্শ বড়? কৃত্রিমতা ছাড়াই যারা সুন্দর একটি সমাজ ব্যবস্থা ও আগামীর কথা ভাবেন তারা একবাক্যে বলেন, আদর্শ বড়। সারাজীবন তারা আদর্শকে আঁকড়েই বেঁচে থাকেন যেখানে বিত্ত থাকে না, প্রভাব থাকে না। ফলাও করে এদের কথা কেউ প্রচার না করলেও প্রকৃতি এদের কথা মনে রাখে, সময়মতো মানুষকে সেই সত্য মনে করায়। আর কৃত্রিম আদর্শবাদীর পোশাকে যারা সমাজে বিচরণ করেন তারা মনে মনে বলেন, বিত্ত বড় আদর্শের চেয়ে। মুখে না বললেও চলনে-বলনে তাদের সেই অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়। প্রকৃতি সেই সত্যও উন্মোচন করে। আবার সামাজিক অবক্ষয় মূলত আকাশ থেকে পড়া বৃষ্টির জল নয়। সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ চর্চা না হওয়ার এটা একটা প্রক্রিয়া ও ফলশ্রুতি। যে প্রক্রিয়ায় কমবেশি সবাই সম্পৃক্ত থাকেন। দায় এড়াতে পারবেন না। নৈতিক মূল্যবোধ চর্চায় ভালো পারফর্ম করা মানুষের সংখ্যা কমে গেলে অবক্ষয় বাড়ে, সমাজে ক্ষত সৃষ্টি করে। পরিশেষে বলব আসুন, নিজ নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা এক একজন বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তিত্বে পরিণত হই। নৈতিকতার প্রশ্নে আপসহীন হই। একটি মানবমর্যাদার সমাজ গড়ে তুলি। সাংবাদিকতা পেশা হোক সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে একটি সম্মানজনক পেশা এবং সাধারণ মানুষের পরম আস্থা, ভরসার একটি জায়গা। স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App