×

মুক্তচিন্তা

লাউয়াছড়া থেকে শিক্ষা নিক সুন্দরবন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২১, ১২:০৮ এএম

লাউয়াছড়া থেকে শিক্ষা নিক সুন্দরবন
সুন্দরবনের সাম্প্রতিক আগুন লাগার ঘটনাটিই নতুন নয়। বনজীবী, সুন্দরবন অঞ্চলের আশপাশের স্থানীয় মানুষ, বন বিভাগ ও গণমাধ্যম সূত্র মিলিয়ে দেখা যায় গত ১৯ বছরে প্রায় ২২ বার আগুন লেগেছে সুন্দরবনে। বন বিভাগের হিসাবে ২২ বারের অগ্নিকাণ্ডে সুন্দরবনের প্রায় ১৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫৩৩ টাকা ক্ষতি হয়েছে। আগুনে বন পুড়ে গেলে খুব একপেশে কায়দায় এর ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করা হয়। মূলত কতটুকু জায়গা পুড়েছে এবং কত ঘনফুট কাঠ পুড়েছে। এবারো গণমাধ্যমে বন বিভাগের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, ‘কোনো সুন্দরী গাছ পুড়েনি’। যেন, কেবলমাত্র সুন্দরী গাছ নিয়েই সুন্দরবন! সুন্দরবনের মতো এক জটিল বাস্তুতন্ত্র যখন ঝলসে যায় তখন এর ক্ষতির হিসাব করবার মতো কোনো দায় বা দায়িত্ব আমরা এখনো বন বিভাগে দেখিনি। একটি বন নিশ্চয়ই কাঠের বাগান নয় বা উদ্ভিদ উদ্যান কি চিড়িয়াখানা নয়। আগুন লাগার ঘটনায় বন বিভাগের নানা সময়ে গণমাধ্যমে দেয়া বক্তব্য হলো, মূলত বনজীবী ও স্থানীয় মানুষদের বিড়ির আগুনে এটি ঘটে। যদিও প্রতিবার আগুন নেভাতে জান নিয়ে সুন্দরবনকে আগলে দাঁড়িয়েছে বনজীবী ও স্থানীয় মানুষরাই। তারপর ক্ষতির প্রসঙ্গে বন বিভাগের বক্তব্য হলো আগুনে মূলত লতাগুল্ম পুড়ে কোনো কাঠের গাছ পুড়ে না বলে বনের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। বন বিভাগের ভাষ্য হলো, জোয়ারের সময় বনে পানি ওঠে না বলে জায়গাটি শুষ্ক থাকে এবং এসব অঞ্চলে লতাপাতা ও গুল্ম জাতীয় সিংড়া ও বলাগাছ বেশি জন্মে। বন বিভাগকে বাণিজ্যিক কাঠসর্বস্ব এই মনস্তত্ত্ব থেকে বাইরে আসতে হবে। সুন্দরবনকে দেখতে হবে এর অগণতি অণুজীব, উদ্ভিদ, প্রাণী ও বননির্ভর জীবন সংস্কৃতির ঐতিহাসিক সংসার ও জটিল বাস্তুসংস্থান হিসেবে। এখানে বলা বা সিংড়া হোক, বাইন বা সুন্দরী হোক, বাঘ কি শামুক হোক, শ্যাওলা কি ছত্রাক হোক যে কোনো প্রাণের ক্ষতি হলেই মুষড়ে পড়বে সুন্দরবন। ঘটবে নানাবিধ স্বাস্থ্য বিপর্যয়। নিহত বলাগাছ ও ঝলসানো বনতল একটি বনের স্তরবিন্যাসের ধরন অনুযায়ী দেখা যায় সুন্দরবনে বারবার আগুন লেগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির ধকল সইতে হচ্ছে বনতলকে। এমনকি সুন্দরবনের নদী-খাল ও খাঁড়ি থেকে বনের ভেতরের দিকে প্রাণবৈচিত্র্যের যে বিন্যাস তা উল্টেপাল্টে গেছে। বিপর্যস্ত হয়েছে খাদ্যশৃঙ্খল এবং আঘাত লেগেছে সামগ্রিক খাদ্যজালে। কারণ আগুন লাগছে মূলত বনপ্রান্তে এবং সেখানে হারগোজা, ধানচি, বাঘ-ফার্ন, সিংড়া, বলা, কালিলতা, গোলপাতা, কেয়া, হেন্তাল, আঙ্গুরলতা, বাওয়ালিলতারই আধিক্য বেশি থাকে। এটিই সুন্দরবনের বৃক্ষসমাজের অবস্থান বৈশিষ্ট্য। সুন্দরবনের জন্য এই বনতল খুবই গুরুত্ববহ এবং এখানকার সব প্রাণিসম্পদ পুরো বনের টিকে থাকা ও বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত। বারবার আগুনে সবচেয়ে বেশি পুড়েছে বলা, সিংড়া ও লতাগুল্ম। বনের এই অংশটুকু নানা প্রাণীর আশ্রয়স্থল। বিশেষত কাঁকড়া, শামুক, গুইসাপ, ব্যাঙ, সাপ, পতঙ্গ ও নানা জলচর পাখিদের। সুন্দরবনের বনজীবী-বিজ্ঞানমতে, বলাগাছের ঝোপে বাটাং, ঘুঘু, বক ও কুকু পাখি বাসা বানায়। বলাগাছের ঝোপ এই পাখিদের আশ্রয়স্থল। মৌয়াল, বাওয়ালি ও জেলেরা বলাগাছের নানা ব্যবহার জানেন। এই গাছের ছাল সুন্দরবন অঞ্চলে দড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নানাকিছু বাঁধার কাজে এই দড়ি কাজে লাগে। সিংড়া গাছের কাণ্ড ঘরের খুঁটি হিসেবেও অনেকে ব্যবহার করেন। বনের আশপাশের অনেকের কাছেই শুকনো বলা ও সিংড়া গাছ জ্বালানির উৎস। বলা ও সিংড়ার ঝোপে মৌমাছি চাক বানায়। এসব চাক ঘন ঝোপের আড়ালে থাকে বলে অনেক সময় নানা আকৃতির হয় এবং এসব ঝোপের মধু মিশ্র স্বাদের হয়। বলা ম্যানগ্রাভ অরণ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ। মালভেসি পরিবারের এই গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ঐরনরংপঁং ঃরষরধপবঁং। এশিয়া অঞ্চলে বিশেষত তাইওয়ানে বনসাই তৈরিতে এর বহুল ব্যবহার আছে, ইন্দোনেশিয়াতে এটি জাগ দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়। অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ জে উদ্দিন, ডারেন গ্রেস ও এভেলিন টিরালংগো ২০০৮ সালে বাংলাদেশের ১২টি ঔষধি উদ্ভিদের সাইটোটক্সিক প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেন। এতে দেখা যায় বলাগাছের এই গুণ যথেষ্ট, যা ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে। বারবার চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর ও নাংলী অঞ্চলে আগুন লাগায় বনতল পুড়ে যাওয়ায় এর বৃক্ষবৈচিত্র্য ও বিন্যাসে এক পরিবর্তন তৈরি হচ্ছে। গত এক দশকে এই অঞ্চলের ঝোপে মৌচাকের সংখ্যা নিদারুণভাবে কমে এসেছে। এটি সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরাগায়ন ও নতুন বন জন্ম এবং বিকাশের জন্য এক বিপদবার্তা। বন বিভাগকে অবশ্যই বনতলসহ সুন্দরবনের সব অংশকে গুরুত্ব দিয়েই এর যাবতীয় ক্ষয়ক্ষতি ও সুরক্ষার গণিত মজবুত রাখতে হবে। একতরফা করপোরেট উপনিবেশিক বাজারি মনস্তত্ত্ব দিয়ে বিবেচনা আর তদন্ত করলে সেটি বনের জটিল জীবনধারার সঙ্গে নিজের সম্পর্ককেই বারবার বিচ্ছিন্ন করে তুলবে। কেন আগুন বারবার? জার্মানির হোয়েনহেম বিশ্ববিদ্যালয়ের এস হারুন রশিদ, কানাডার লেকহেড বিশ্ববিদ্যালয়ের রেইনহার্ড বকার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম এনায়েত হোসেন ও আবু সালেহ খান ২০০৭ সালে সুন্দরবনের বনতলের উদ্ভিদবৈচিত্র্য এবং এর সঙ্গে লবণাক্ততার সম্পর্ক নিয়ে একটি যৌথ গবেষণায় দেখিয়েছেন, বনতলের লতাগুল্ম তীব্র জোয়ার ও উচ্চ লবণমাত্র সহ্য করতে পারে না। বনতলের উদ্ভিদবৈচিত্র্য দেখে সুন্দরবনের সুস্থতা বোঝা যায়। যদি উদ্ভিদের বৈচিত্র্য ও বিন্যাস বেশি থাকে তবে বোঝা যায় সুন্দরবনের স্বাস্থ্য ভালো এবং লবণের মাত্রা কম। আগুনে ঝলসানো সুন্দরবনের এ অংশের বনতল প্রমাণ করছে এখানে লবণের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম এবং এখানে বনতলের উদ্ভিদবৈচিত্র্য বেশি। সুন্দরবনের ১৯ বছরের আগুন লাগার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় মূলত পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জেই এ ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে। তার ভেতর চাঁদপাই রেঞ্জেই এর মাত্রা বেশি। এটি তুলনামূলকভাবে উঁচু অঞ্চল এবং এখানকার নদীপ্রবাহগুলো উজানে আটকে আছে। যেসব অঞ্চল আগুন বেশি লাগছে সেখানে নদী, খাল ও পানিপ্রবাহ কম। কেউ কেউ এ সময়টাতে আগুন লাগিয়ে সুন্দরবনের খাঁড়ি ও খালগুলো থেকে একতরফাভাবে মাছের বাণিজ্য করেন। তবে অনেকে বলছেন সুন্দরবন নিয়ে নানা বিনাশী প্রকল্প, তেল-বিপর্যয় এবং বন্যপ্রাণী বাণিজ্যের মতো বিষয়কে আড়াল করতেই এ ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। লাউয়াছড়া থেকে শিক্ষা নিতে পারে সুন্দরবন ১৯ বছর ধরে বন বিভাগ সুন্দরবনের অগ্নিকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি। এমনকি আগুন নেভানোর জন্য বন বিভাগকে দক্ষ ও প্রশিক্ষিতও করে তোলা হয়নি। বন আইন কী বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুযায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চলে আগুন দেয়ার বিরুদ্ধে আইনি বিধান থাকলেও গত ১৯ বছর এসব আইনের পাতা কেউ ওল্টাচ্ছে না। সম্প্রতি ২০২১ সালের ২৪ এপ্রিল মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় প্রায় দুই একর বন। বন বিভাগ দ্রুত এই আগুন নেভাতে সচেষ্ট হয়, তদন্ত কমিটি গঠন করে তিন দিনের ভেতর তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং দোষীদের বিচারের অঙ্গীকার করে। অগ্নিকাণ্ড রোধে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান যদি এমন সাহসী হতে পারে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ কেন পারবে না? সুন্দরবনে লাগাতার এই প্রশ্নহীন অগ্নিকাণ্ডের দ্রুত তদন্ত ও ন্যায়বিচার দাবি করছি আবারো। পাভেল পার্থ : প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রতিবেশবিষয়ক গবেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App