×

সাময়িকী

দোতারার সুরে ভাসে বারুদের ঘ্রাণ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২১, ১২:০৬ এএম

দোতারার সুরে ভাসে বারুদের ঘ্রাণ
কঙ্কন সরকার দোতারাটার ছেঁড়া সুতো জোড়া দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে তারে নখ বুলান। টুং টুং করে জানান দেয় সে, ভালো হয়ে গেছি! সহাস্য বদনে ও অবস্থাতেই গান জুড়ে দেয় ঝড়ু বৈরাগীÑ কী বাতাসে আইলো রে দ্যাশে নৌকায় বাঙালির মুক্তি দিবে শ্যাখে... বউ বিরক্তিমাখা মুখে রান্নাঘর থেকে হাঁকেÑ হ্যা গো, গান কী সউগ সমায়? ভাতগুলা যে জুড়ি যায়! এ বিরক্তি কিন্তু কথার কথা, মনের নয়! নয়তো যখন মন চায় বৈরাগীর গান বুঁদ হয়ে শোনে না তখন! ট্যটাং টুং টুং ট্যাটাং টুং টুং ট্যাং-এর সাথে গানের গলা মেলান। দোতারাটা পেলে ঝড়ু বৈরাগীর খাওয়া-নাওয়া যে কোথায় উবে যায়! বউ এবার খেঁকিয়ে ওঠেÑ তারখান ছিড়ি গেচিল্, ভালোয় হচিল্! কিসকব্যান ভালো হইলো? হাঁক দেয়Ñ কটে গো, শুনছেনÑ? ভাত শুকটি নাগিলÑ দোতারার শব্দ থামে আঙুল থেমে যাওয়ায়। উঠানের পেয়ারা তলায় পাতানো আধা ছেঁড়া চট ছেড়ে খড়ের ছাউনিঅলা নড়বড়ে বারান্দাটায় খাড়া করে রেখে তিনবার ছুঁয়ে হাত কপালে ঠেকিয়ে রান্নাঘরে যান। বোশেখের সকাল বেলারই তপ্ত গরমের ঘাম মুছতে মুছতে বউয়ের সযত্নে পেড়ে দেওয়া পিঁড়িতে বসেন। গেলাস ঢেলে হাত ধুয়ে সামান্য জল থালের চারপাশে ছিটিয়ে দেন। এ তার বাবার থেকে পাওয়া খাবার শুদ্ধিকরণ নিয়ম! দুগ্রাস মুখে পুড়ে বউয়ের দিকে তাকায়। বলে, জানো গো, এবার শ্যাখের জন্যি আরো দুতিনখানা গান বান্দিমো! বউ গ্লাসে জল ঢেলে নোটাটা রাখতে রাখতে বলেÑ ওগল্যা ছাড়া তোমার ফের আচে বা কী! হা হা হাÑ একগাল হেসে আঙুল মুখে পুড়ে চাটতে চাটতে বলে, নাবড়াটা আইজে খুব মজার হইচে গো! দাও, দাও আরো চাইরটে ভাত দাও! প্রশংসা পাওয়ার উচ্ছ্বাসে বউ ভাত দিয়ে এক হাতা রাবড়িও দেয় পাতে। খাওয়া ঠেকতে না ঠেকতেই বাইরে থেকে ডাক ভেতরে ঢুকতে থাকেÑ ঝড়ু দ্যা, আছ? নজ ব্যাপারী খরমের খট খট আওয়াজ তুলে উঠানে দাঁড়ায়। সদা হাস্যময় ভঙ্গিতেই হ দাদা আছম বলে ত্রস্ত্রতার সাথে হাতমুখ ধুয়ে ঘাড়ের ময়লাযুক্ত তেল চিটচিটে গামছাটাতে মুছতে মুছতে খড়ের বানানো মোড়া এগিয়ে দিয়ে বসতে বলে। থাউক তো ঝড়ুদ্যা, অতো ব্যস্ত হওয়া নাগব্যার নয় বলতে বলতে নজ ব্যাপারী মোড়াটা ঠিক করে নিয়ে বসে। ঝড়ু পান সুপারির খোঁজে ঘরে যায়। খুঁজতে থাকা ভঙিতে বলে, ক্যাগো, গুয়া টুয়া আছেÑ? হ, ডাবরত দেখ বলে রান্নাঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ঝড়ু বউ স্বামীর থালে ভাত বেড়ে নিয়ে খেতে বসে। স্বামীর এঁটো থালেতে নাকি বউরে খেতে হয়! তাতে নাকি দরদ না, কী যেন বাড়ে! জীবনের সঙ্গী দোতারাটা নিয়ে ঝড়ু বৈরাগী পিঁড়ি পেতে নজ ব্যাপারীর সামনে বসে। তারে দুই-একবার নখ বুলায়ে পরখ করে। ভালো হয়ে যাওয়ার হাসি ফোটে মুখে চোখে। পান চিবাতে চিবাতে নজ ব্যাপারী কথা শুরু করেÑ ঝড়ু দ্যা ইয়াহিয়্যা নিববাচন ফির বন্দ করব্যার নয়তো? দোতরাটা কোলে বসিয়ে ঝড়ু বৈরাগী কথাটা শোনে। চোখ মুদে এক পলকে খুলে জোরের সাথে বলে, দাদা, নিববাচন না দিয়া কোনটে যাবে ওম্র্যা? শ্যাখ সাইব বাঙালিক যে জাগাইচে? এটা কী, হা? বৃটিশক তাড়াবার জন্যে বাঙালি কত ত্যাগ স্বীকার দিলে আর ধর্ম ধর্ম করি পাকিস্তান হইল! হউক। কিন্তু চেয়ার দখল করি থোয়া কী ধর্মত আছে! নিজের উদর ভরেয়া মাইনষক উপাস থাকপ্যার কওয়া কী ধর্ম, ঝড়ু দ্যা! একটানে আক্ষেপ ঝড়ানো গলায় বলে নজ ব্যাপারী। ঝড়ু বৈরাগী ফ্যাল ফ্যালে চোখ ফেলে শুধু শোনে। বাঙালি য্যান সতিনের পোলা? চোখ ফুলে ওঠে নজ ব্যাপারীর। শোনো দাদা, নমাজের দোয়াত মুই আল্লার কাছে কান্নাকাটি করম বাঙালির য্যান জয় হয়। ঝড়ু জোর দেয়Ñ হইবে দাদা, হইবে। কান্দনের ডাক কী ওপরআলা শুনব্যারে নয়! নির্বাচন হলো। পাকিস্তানিদের বাঙালির প্রতি চরম বৈষম্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো বাঙালি বিপুল জয়লাভের মধ্য দিয়ে। ফলাফলে কিন্তু শাসকরা যারপরনাই ভড়কে যায়! ইতস্তত করণীয়তেও! বাঙালি কী শুধু নির্বাচনে জিতল, না আত্মঅধিকারের চরম জানান দিল! বড় বড় পাক পদাধিকারীরা গোঁফে তা দিতে শুরু করল। কৌশলে আঁটা মুখের ভাজে ছলনা আঁকিবুঁকি করে! শক্ত চোয়ালে দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে ! কূটবুদ্ধি পাক পারে মস্তিষ্কে- বাঙাল কা সাচ্চা মুসলমান নেহি হ্যায়! এমহারা পাক জমিন কো নেহি বুঝতা হায়! শালা তো দুশমন হ্যায়। অতএব ফন্দি! মানে, ওরা বিচার মানবে কিন্তু তালগাছটা ওদের থাকতে হবে! আজান দিয়ে ওয়াক্তি ঘরে নামাজও পড়ান মাঝেমধ্যে নজ ব্যাপারী। কয়েকটা বাড়ি মিলে পাড়াটার বাইরের উঠানে খড়ের ছাউনি দেওয়া এই ওয়াক্তি ঘর। সামনে দিয়ে মেঠো রাস্তা বয়ে চলেছে আপন গন্তব্যে। খানিকটা দূরে গড়ে ওঠা পাশের পাড়ারও দু-চারজন মুসল্লি আসেন মাঝেমধ্যে। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা ওঠে কখনো কখনো। কখনো কখনো চলে তা ওয়াক্ত শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত। কেউ কেউ পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিও তুলে ধরে। এর মধ্যে মাঝ বয়সী ফজল উদ্দি নজ ব্যাপারীর কথায় প্রায়ই সায় দেন। বিশেষ করে নজ ব্যাপারী যখন মুসল্লিদের শোনান পাকিস্তানিদের বেইনসাফের কথা, মানুষের অধিকারের কথা, পাকিস্তানিদের শোষণের কথা, হক বেহকের কথা। যখন পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে শান্তি কমিটি গঠিত হয় পাড়ায় পাড়ায়, তাতে নজ ব্যাপারী, ফজল উদ্দি যোগ দেয় না। কেউ কেউ আড়চোখে তাকায়! স্বল্প শিক্ষিত নজ ব্যাপারী সংসারের কাজ করে, গরু মাঠে চড়ায়, সকাল হলে বাপের থেকে পাওয়া কোরআন শরিফ দাওয়ায় বসে নিত্য নিত্য পড়ে। তবে খানিকটা ফুসরত পেলে চলে আসেন ঝড়ু বৈরাগীর কাছে। কেননা মহব্বতি টান যে! তাদের এখন আলাপ-আলোচনা অন্যদের মতোইÑ নির্বাচনে জয়, বাঙালিকে ক্ষমতা দেবে, কিনা? ইত্যাদি ইত্যাদি। কদিন পরে তাদের আলোচনায় যুক্ত হলো শ্যাখ সাহেব আর ইয়াহিয়ার বৈঠক। একদিন কথার ফাঁকে নজ ব্যাপারী জোরে একনাদা থুতু ফ্যালে। বলে, তালবাহানা! মুখ সমুখে ঝুঁকে বলে, কিসের ফির বৈঠক, হা? শ্যাখ সাহেবকে বাঙালি মান দিচে না? তাক ওমরা মানবার নয় মানে! দ্যাশ কী ওমাক দলিল করি দিচে! থামে। বলে, মোনাফেকি, না? যেন রাগ চোখ ফেটে বেরোবে! বুকের মাঝে জ¦লন্ত আগুন যেন চোখে ফুটছে নজ ব্যাপারীর! ঝড়ু বৈরাগী মাথা দোলায়। লম্বা কোকড়া চুলগুলো দুলে দুলে ওঠে। টুং টাং করে মৃদু আওয়াজ তোলে দোতারায়। বিস্ময় ভরা চোখে বলে ওঠে, দাদা, রক্ত দেওয়া নাগবে নাকি! খানিক চুপচাপ দুজনই। দোতারায় সুর ভেজে একটা গান ধরে বৈরাগী। যখন মনে নানান আউল-বাউল খ্যালা করে তখন গান গায় ঝড়ু বৈরাগী। এবার একখান নতুন গান বান্দিচেÑ যেতই তালবানা কর তোমরা বাঙালির জয় হবেই ভোমরা... বাঙালির হাজার বছরের চাওয়াÑ স্বাধীনতা। আন্দোলন-ত্যাগ-রক্ত দানে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া পথে পাকিস্তানিদের রাতের আঁধারে প্রকাশ পাওয়া কাপুরুষতা বাঙালির চাওয়াকে ত্বরান্বিত করে। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। দুধরনের মানুষ চলে যেতে থাকে বাড়ি ঘর ছেড়ে! কেউ পাকিস্তানিদের হিংস্র শিকারে পরিণত হয়ে, কেউ দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করার মানসে! কিংবা উভয়ই! ওরা পুড়ছে বাড়ি, পুড়ছে প্রতিষ্ঠান, পুড়ছে ধর্মীয় কেতাব, মারছে মানুষ, পুড়ছে বাংলার সংস্কৃতি! যাত্রাগান, বাঁশির সুর, ভাটিয়ালী গান, ভাওয়াইয়া গান, বিয়ের গীত, লালন-রবীন্দ্র-নজরুল ওদের শত্রু! দোতারাটা বুকের মাঝে নিয়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, তুইও, তুইও! সন্তান কোলে নেবার মতো করে নিরাপত্তার পরশ দিতে থাকেন আদরে আদরে। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়ায়। হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শুধায়, মন খারাপ করিস না। চুপটি করি থাক। চোয়াল শক্ত করে বলে, বিজয়তো হইবেইÑ তকন গলা ছাইড়ে গামো! দোতারাটাকে একটা বন্দুকের মতো লাগে! মন বলে, এলা সুরের সাথে বারুদও পোসব করিস তুই! ঝড়ু বৈরাগী চোখের জল ভরা দোতারাটা মুছে মুছে কাপড়ে পেঁচিয়ে খড়ির নিচে রাখে। রেখে দিতে দিতে বলে, তুই যে বাঙালির মনের গান গেইয়েছিস! তাইতো ওদের ভালো লাইগবে না তোর সুর! তোর প্রতি ওদের কঠিন ঈর্ষা! এক সন্ধ্যায় ঝড়ু বৈরাগীর পাড়া ছাই হয়ে যায় হানাদারদের ক্ষোভের আগুনে! গুলিতে, বেয়নেটের খোঁচায় আর আগুনে পুড়ে কয়েকজনের ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ পড়ে থাকে মাতৃভূমিতে। এক পরিবারের মা- মেয়েকে নিয়ে গেছে। রাতের আঁধারে ঝড়ু দম্পতি এক কাপড়ে কোনো রকমে জীবন বাঁচায়ে চলে যায় ভারতে। দোতারাটা আধপোড়া হয়ে পড়ে থাকে ছাই হয়ে ভরে থাকা উঠানটার একদিকে। এর ওপরও নিদারুণ অত্যাচার গেছে! নজ ব্যাপারীকে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে দেখতে হয় বীভৎসতার এ করুণ চিত্রকে। চোখ-মুখ অন্ধকার হয়ে আসে। মাথা এপাশে-ওপাশে দোলাতে দোলাতে বলে, দাদা, তোমার পোড়া দোতারা য্যান বারুদ হয়ে বেইনসাফিদের পুড়ে ছারখার করে দেয়! এর কয়েক দিন পরে তাকেও যেতে হয় ভারতেÑ মুক্তিযোদ্ধা হতে। এক দুপুরে নজ ব্যাপারীর আযান-এর ললিত সুর ভাসছিল বাতাসেÑ মুসল্লিদের কানে পৌঁছতে। আযান শেষের দিকে। হঠাৎ দ্রিম, দ্রিমÑ গুলির শব্দ! দেখতে পায় পাশের পথ ধরে এগিয়ে আসছে জলপাই রঙের গাড়ি। চারিদিক থেকে ভেসে আসছে আতঙ্কমাখা চিৎকারÑ বাঁচাওÑ বাঁচাওÑ ছুটছে মানুষ তার সামনেÑ পেছন যে যেদিক পারছে, সেইদিক দিয়ে। থমকে যায় নজ ব্যাপারী! ভয় পাওয়া মনে ঊর্ধ্বশ^াসে দৌড় শুরু করে। খানিকটা দূরে বাঁশবাগানের ভেতর কচুরিপানা ভরা জলাশয়ে লাফ দেয়। জীবন বাঁচাতে জলাশয়ের পানিতে ডুবে কচুরিপানা মাথায় দিয়ে দেখতে হয় ঝড়ু বৈরাগীর পাড়ার পরিণতি! ওদের নোংরা উল্লাস দেখে ভয় আর ক্রোধে থর থর করে কেঁপে কেঁপে উঠছিল গা। এরা কী মানুষ! না, মানুষরূপী জানোয়ার! দাঁত চিবিয়ে বলেÑ শালা হারামী! পরে বুঝতে পেরেছিল, কোন পাকিস্তানী তোষামোদকারী যেন তার পবিত্র দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করতে খান সেনাদের খবর দিয়েছিল এ বুঝিয়েÑ ও আযান দিলে কী হবে? সাচ্চা মুসলমান নেহি হ্যায়, মুক্তি গো সাহায্য করে গা! যুদ্ধ শেষে বিজয়ী বেশে পুড়ে যাওয়া ভিটায় এলে পাড়ার বেঁচে যাওয়া বয়সী দাদি দুধ পানিতে ধুয়ে নেন তাকে। যেন শুদ্ধতায় মুক্ততার শ^াস নিয়ে নজ ব্যাপারী বলেন, জন্মদাত্রী মাকে হারিয়েছি, তবে গর্ব যে, দেশ মাকে পেয়েছি। ক দিন পরে ঝড়ু বৈরাগীও ফিরে এসে ভারতে চিরদিনের মতো চলে যাবার মন করলেও যেতে পারেননি মায়া আর ভালোবাসার টানে। পুড়ে যাওয়া দোতারাটাকে দুধে জলে ধুইয়ে পাকিস্তানিদের অশৌচতাকে পরিষ্কার করে নেয়! নতুন করে ঘর বান্ধিলে টাঙ্গিয়ে রাখে পইয়ের আলে। তবে নতুন করে কেনা হয়েছে একখানা দোতারা। আর নজ ব্যাপারী ইমামতি করেছেন ওই মসজিদে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আর তাকেও জোগাড় করতে হয় একখানা নতুন কোরআন শরীফ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App