×

মুক্তচিন্তা

সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ মে ২০২১, ১২:০২ এএম

লকডাউনের কার্যকারিতা নিয়ে নানামুখী কথাবার্তা, আলোচনা এবং তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। চলমান লকডাউন শব্দটির পারিভাষিক অর্থ নির্ণয়ও কারো পক্ষে সম্ভব নয়! লকডাউনের মধ্যেই খোলা আছে শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা। সব ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড অনেকটা যেন স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। সমালোচকরা এ ধরনের লকডাউনকে ‘মডিফায়েড লকডাউন’ নাম দিয়ে তিরস্কারও করছেন। বিগত প্রায় তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এরূপ ঢিলেঢালা ‘মডিফায়েড লকডাউনের’ কল্যাণেও আমরা দেখতে পাচ্ছি করোনায় সংক্রমণ শনাক্তের হার ২৩ শতাংশের বেশি থেকে নেমে ৯ শতাংশের কাছাকাছি এসেছে- কমেছে মৃত্যু। সুতরাং এ কথা বলা যায় যে, আমরা যদি ‘সত্যি সত্যি’ লকডাউন মেনে চলতাম এবং পাশাপাশি অন্য স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলতে পারতাম তাহলে সংক্রমণের বর্ণিত হার আরো নিচে নেমে আসত। মৃত্যুর সংখ্যাও কমে যেত। কিন্তু শ্রেণিপেশা নির্বিশেষে আমরা এমন স্বার্থপর চিন্তায় অস্থির জীবনযাপনে অভ্যস্ত যে, কেবল দৃষ্টান্ত হাজির করে লকডাউন অমান্যের নানা অজুহাত খুঁজেছি। গত বৃহস্পতিবার ঢাকার গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে পরিবহন শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে এসেছেন। তাদের প্রশ্ন- শপিং মল ও দোকানপাট খোলা রেখে যানবাহন বন্ধ করে লকডাউন হয় কীভাবে? তাই প্রতিবাদে তারা রাস্তায় নেমেছেন! আমাদের মনে আছে, কিছু দিন আগে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও (!) রাস্তায় নেমে এসেছিলেন তাদের দোকানপাট খুলে দেয়ার দাবিতে। বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠী তাদের স্ব-স্ব পেশার স্বার্থচিন্তায় লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সরকারের যাবতীয় সিদ্ধান্তের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনেই তৎপর! কিন্তু একবার যদি আমরা বিপর্যস্ত ভারতের টালমাটাল অবস্থার দিকে তাকাই তবে উপলব্ধি করতে পারব, লকডাউনই হোক বা অন্য যে কোনো নামেই হোক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই! সময় থাকতে যদি আমরা সর্বোচ্চ সচেতনতা না দেখাই তবে অসময়ে দ্বিগুণ সচেতন হলেও তা কোনো কাজেই আসবে না- যেমনটি আমাদের দেশের প্রচলিত প্রবাদেও বলা হয়ে থাকে- ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়’! অর্থাৎ সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করলে দুঃসময়ে তা দশটি কাজের চেয়ে বেশি সুফল পাওয়া সম্ভব। সময়ের কাজ সময়ে না করলে বেলা শেষে আফসোসও করতে হয়, আফসোসের শেষও থাকে না! করোনার ভারতীয় ভেরিয়েন্ট অত্যন্ত শক্তিশালী। ভারতে প্রতিদিনই সংক্রমণ ও মৃত্যুর নতুন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে। দৈনিক সংক্রমণ প্রায় চার লাখ এবং মৃত্যুর সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের বেশি। সেখানকার কবরস্থান ও শ্মশানে মৃতদেহ সৎকারের বিলম্বিত দৃশ্য আমাদের বিমর্ষ করে! ভারতের করোনা পরিস্থিতি বর্তমানে বৈশ্বিক আতঙ্কে পরিণত। ভৌগোলিকভাবে ভারতের সঙ্গে তিন দিকে সীমান্তরেখা থাকায় আমাদের আতঙ্কই সবচেয়ে বেশি হওয়ার কথা! কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ভারতের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতিও আমাদের আতঙ্কিত করছে না! কী বেপরোয়া আমরা! ভারত অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সক্ষম হলেও মহামারি সামলাতে তাদের হিমশিম অবস্থা! আমাদের ছোট দেশ, ভারতের তুলনায় জনসংখ্যা কম হলেও জনঘনত্ব আমাদের কম নয়। তাই ভারতের মতো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি দেখা দিলে দৈনিক সংক্রমণ হার ও মৃত্যুর মিছিল সামাল দেয়া আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। উপরন্তু আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়বে তাও নিশ্চিত। তাই আমরা যারা স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করি না, যারা লকডাউনের বিরুদ্ধে সড়ক অবরোধ করি, স্বাস্থ্যবিষয়ক সরকারের নানা উদ্যোগকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাই তারা কি একবারও দেশের বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতার দিকে চোখ মেলে তাকিয়েছি? সপ্তাহ-দুয়েক আগে আমরা দেখেছি সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের হাসপাতালগুলোর নাজুক অবস্থা। আমরা দেখেছি অক্সিজেন সংকট, হাসপাতালের শয্যা সংকট এবং সর্বোপরি আইসিইউর সংকটে মরণাপন্ন রোগীর স্বজনদের আহাজারি ও আর্তনাদ! কিন্তু দুঃখজনক সত্যি হলো, আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে মানবিক বিবেচনাবোধ যতদিন জাগ্রত না হবে ততদিন এ দেশের মানুষ পরিপূর্ণরূপে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় উৎসাহী হবেন না। সে যে কোনো আকারের ব্যবসায়ী হোক, যে কোনো ধরনের ব্যবসায়ী হোক! ‘আদার ব্যাপারি থেকে জাহাজের ব্যবসায়ী’ পর্যন্ত সবাই লকডাউনের বিরুদ্ধে, সবাই স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে সব কিছু সচল রাখার পক্ষে! ব্যবসায়ীরাই সাধারণকে নানা প্রলোভনে বাজারমুখী করে থাকেন- যেখানে সামাজিক দূরত্বের বালাই থাকে না! ভৌগোলিকভাবে যেহেতু ভারত আমাদের তিন দিকের সীমান্তরেখা বেষ্টন করে আছে, তাই ভারতের চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আমাদের চলাচল ও জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। এই কঠিন সময়ে ভারতের সঙ্গে আমাদের সব সীমান্তপথ হওয়া উচিত কঠোর ও নিশ্চিদ্র! তাহলেই কেবল করোনার মহাগ্রাস এবং মহা-আতঙ্ক থেকে আমরা রেহাই পেতে পারি। করোনা থেকে রেহাই পেতে চাইলে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত করণীয়গুলো পালনের বিকল্প নেই। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে এবং সাম্প্রতিককালে কিছু সহিংস ঘটনায় উসকানি ও নেতৃত্ব দেয়ায় হেফাজতে ইসলামসহ উগ্রবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠীর নেতাদের আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। স্বাধীনতার সুুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে বিগত ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ দেশে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে ধর্মীয় একাধিক উগ্রবাদী সংগঠন! বিএনপি আকারে-ইঙ্গিতে এবং ভাবে-ভঙ্গিতে এদের সহিংসতায় সমর্থন জুগিয়েছিল। শুধু তাই নয়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব সৃষ্টিকারীদের গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া শুরু হলে বিএনপির মহাসচিব উগ্রবাদীদের পক্ষে সাফাই গেয়ে ‘আলেম-ওলামাদের’ মুক্তির দাবিতে বিবৃতিও দিয়েছেন! আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের সহিংসতা ও জ্বালাও-পোড়াও মামলার আসামি হিসেবে এদের গ্রেপ্তার করেছে। ২০১৩ সাল থেকে মামলাগুলো ঝুলে আছে! সে সময় যদি এসব মামলার প্রতিবিধান করা হতো পরবর্তী সময়ে হেফাজতে ইসলামের নেতারা এতটা ‘বাড়ার’ সাহস পেত না। শাপলা চত্বর ঘটনায় ‘ছাড়’ পাওয়ায় পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে হেফাজতের কিছু নেতা রাতারাতি ‘বিড়াল’ থেকে যেন ‘বাঘে’ পরিণত হয়ে যান! সরকারকে এই সমালোচনা মানতেই হয়, বিভিন্ন সময়ে তারা হেফাজতকে ‘ছাড়’ দিয়েছে! শাপলা চত্বর-কাণ্ডে ছাড়ের পরিণতি এত ভয়ংকর হবে তা অনেকে ভাবতেই পারেনি। সরকার যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষকে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করে, যখন স্বাধীনতার সুুবর্ণজয়ন্তী পালনে মনোযোগী হয় তখন হেফাজতের একেক নেতা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য ছড়িয়ে মাঠ উত্তপ্ত করেছেন। কিন্তু সে সময়ও সরকার কিংবা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়নি! ফলে নিত্যই নব-নব উদ্যমে তারা বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন! বঙ্গবন্ধুুর ভাস্কর্য নিয়ে বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তিও করেছেন অনবরত! সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন দিনের পর দিন। তবু তারা সরকারের দিক থেকে কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হননি। উপরন্তু এক ধরনের আস্কারা পেয়ে তারা হয়ে উঠেছেন লাগামহীন! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আজ যেন পরিপূর্ণরূপেই এই গোষ্ঠীর দখলে চলে গেছে! আফসোসের সঙ্গে তাই এ কথাই মনে হয়Ñ হায়, কার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কার হাতের মুঠোয় চলে গেল! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে আশ্রয় করে ধর্মীয় ওয়াজ-নসিহতের অন্তরালে সূক্ষ্ম চতুরতার সঙ্গে রাষ্ট্র দখলের জন্য তারা ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতি করে যাচ্ছেন! এরা ধর্মের নামে মূলত উগ্র জঙ্গিবাদ প্রচার, বাঙালির হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন এবং নারী বিদ্বেষী বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করে পরিকল্পিতভাবে ক্ষমতা দখলের দিকে অগ্রসরমান হয়ে উঠেছেন! ষড়যন্ত্রমূলক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে প্রকাশ্য ধর্মসভা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহায়তায় বিশাল জনগোষ্ঠীকে তাদের ফ্যান-ফলোয়ার করে তুলেছেন! এমনই ফ্যান-ফলোয়ার তারা তৈরি করেছেন যে, সাম্প্রতিককালের মামুনুল ঘটনায় আমরা দেখেছি বিএনপি-জামায়াতের ন্যায় আওয়ামী লীগের সদস্যরাও উগ্র মতবাদের দীক্ষা নিয়ে মামুনুলের মুক্তির দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন! এরূপ ঘটনায় বিগত কয়েক দিনে আওয়ামী লীগকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেশ কিছু নেতাকর্মীর নামে ‘কারণ দর্শানো নোটিস’ কিংবা ‘সাময়িক বহিষ্কার’ আদেশও জারি করতে হয়েছে! পাশাপাশি প্রগতিশীল কিছু নেতাকর্মীকেও হেফাজত থেকে আলাদা করা সাধারণের পক্ষে ইদানীং কঠিন হয়ে পড়েছে! সময়ের কাজ সময়ে না করলে পরে আফসোস করতে হয়! ২০১৩ সালে হেফাজতকে ‘বাড়তে’ দেয়া হয়েছিল! তারা সীমাহীনভাবে বেড়েছে! তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। কিন্তু সাম্প্রতিককালের ২৬ থেকে ২৮ মার্চ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনায় চিহ্নিতদের আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু হলেও আমাদের মনে হচ্ছে রাঘব-বোয়ালদের ধরতে সংশ্লিষ্টরা একটু বেশি সময় নিয়ে ফেলছেন! ‘ভিডিও ফুটেজ দেখে’ অপরাধী শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে এতটা সময় ক্ষেপণ যথার্থ সক্ষমতা-জ্ঞাপক নয়। রমজান, ঈদ, লকডাউন শেষে কিংবা কওমি মাদ্রাসার পরিবেশ স্বাভাবিক হলে যে কোনো সময় পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। পরিস্থিতি পাল্টে দেয়ার আগে উগ্রবাদের বিষদাঁত ভেঙে ফেলায় বেশি সময় নেয়া যাবে না। যারা রাতারাতি ‘জিরো’ থেকে ‘হিরো’ বনে গিয়েছিলেন তাদের দ্রুত পুনরায় জিরো বানানোর এটাই মোক্ষম সময়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশে আমাদের বক্তব্য তাই রবীন্দ্র্রনাথের মতোই : ‘সময় কোথা, সময় নষ্ট করবার?’ মনে রাখতে হবে সময়ের এক ফোঁড় কিন্তু অসময়ের দশ ফোঁড়ের সমান!

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App