×

মুক্তচিন্তা

বিষধর সাপ ও সাপুড়ের লড়াই

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ মে ২০২১, ১২:০২ এএম

মানব চরিত্রের নানাবিধ গুণের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হচ্ছে চারিত্রিক দৃঢ়তা। অনেকে মেধাবী হতে পারেন, বড় প্রতিভাবানও হতে পারেন, কিন্তু চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবে তার মেধা ও প্রতিভা স্থায়ী কোনো অবদান রাখতে পারে না। চারিত্রিক দৃঢ়তাই একজন ব্যক্তিকে অনন্য করে তোলে। অপর দিক থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল করে রাখে, তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখে। বিশ্বের প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিদের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে আমরা এই সত্যতার প্রমাণ পাই। বাঙালির চরিত্রের মধ্যে এই গুণটির বড় অভাব থাকলেও তিন মহামানবের চরিত্রে আমরা এই গুণটির উজ্জ্বল উপস্থিতি দেখতে পাই। তারা হচ্ছেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর যার নাম আসে তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিদ্যাসাগর এমন এক সময়ে এ দেশে জন্মগ্রহণ করেন যখন বাঙালি হিন্দু সমাজ নানাবিধ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল। ধর্মের দোহাই দিয়ে হিন্দু নারীদের সতীদাহ প্রথার নামে মৃত স্বামীর সঙ্গে পুড়িয়ে মারা হতো। রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় এই প্রথার অবলুপ্তি ঘটে। হিন্দু বিধবাদের পুনঃবিবাহ ছিল নিষিদ্ধ। কৌলিন্য প্রথার নামে হিন্দু বিধবা নারীরা আশৈশব বৈধব্য জীবনযাপন করত। শৈশবে হিন্দু মেয়েদের বিবাহ ছিল বাধ্যতামূলক। জগতের যাবতীয় সুখ স্বচ্ছন্দ থেকে বিধবারা বঞ্চিত জীবনযাপন করত। মানবেতর জীবনযাপন করত। ধর্মের নামে এ সামাজিক অনাচার, অত্যাচার বিদ্যাসাগর মেনে নিতে পারেননি। সমাজপতিদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ইংরেজ সরকারের সহায়তায় তিনি বিধবা বিবাহ আইন পাস করান। এ জন্য তাকে অনেক বাধা বিপত্তি ও কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। নিজের ছেলেকে বিধবা রমণীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ‘বিধবা বিবাহের’ সূচনা করেন। বিদ্যাসাগরের এই চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণে আজ হিন্দু বিধবারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে। চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণে বিদ্যাসাগর অমরত্ব লাভ করেছেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বলিষ্ঠ কণ্ঠ ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। স্বাধীনতা অর্জনের ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ আপসহীন ছিলেন। এ কারণে তিনি গান্ধী, নেহরু এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আপসমূলক মনোভাবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন এবং কংগ্রেস ত্যাগ করেন। তিনি বিশ^াস করতেন, একমাত্র সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই এ দেশ থেকে ইংরেজ বিতাড়ন সম্ভব। এই লক্ষ্যে তিনি জাপানের সাহায্যে ভারতীয় মুক্তিফৌজ গঠন করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেন। দুঃখের বিষয়, যুদ্ধের সময় বিমান দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হন। ব্যর্থ হলেও তার চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণে আজো তিনি দেশবাসীর হৃদয়ে ‘নেতাজীর’ আসন দখল করে আছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বিদ্যাসাগর ও নেতাজীর আদর্শের উত্তরসূরি। দীর্ঘ ২৩ বছরের আপসহীন সংগ্রামের ফলে তার নেতৃত্বে অর্জিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক দৃঢ়তার প্রথম পরিচয় আমরা পাই ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনের সময়। তিনিসহ আরো কয়েকজন বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-কর্মচারীদের দাবি দাওয়ার সমর্থনে এগিয়ে আসেন। বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে ছাত্রদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসাবে অর্থ জরিমানা করে। ছাত্রদের প্রায় সবাই অর্থদণ্ড ও মুচলেকা দিয়ে শাস্তি থেকে রেহাই পেলেও বঙ্গবন্ধু মুচলেকা ও জরিমানা দিতে অস্বীকার করেন। ফলে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে সারাজীবনের জন্য বিশ^বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেন। বঙ্গবন্ধু তার প্রতিবাদে বলেছিলেন, আমি যাচ্ছি, কিন্তু আবার ফিরে আসব, কিন্তু অন্যভাবে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন তিনি কারাগারে আটক অবস্থায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেন। এরপর গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে একাধিকবার কারাবরণ করেন। অবশেষে স্বাধীনতা ঘোষণা করার অপরাধে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে তার বিচার শুরু হয়। বিচারে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু দৃঢ়চেতা বঙ্গবন্ধু তার দাবি থেকে সরে আসেননি। তাকে আপস করতে বলা হলে তিনি বলেছিলেন, মৃত্যুর পর তোমরা আমার লাশ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিও। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার এই চারিত্রিক দৃঢ়তার গুণ পেয়েছেন। ১৯৮১ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি বিধ্বস্ত আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করেন। ২০০৬ সালে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। শেখ হাসিনা খোন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের ‘দায়মুক্তি’ আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করেন এবং অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিলেন। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন জাতিসংঘ বন্ধ করে দেয়ায় তিনি নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করেন। যা এখন বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। বঙ্গবন্ধুকন্যাকে হত্যা করার জন্য ১৯ বার তার ওপর সশস্ত্র আক্রমণ হয়েছিল। তিনি গুরুতর আহত হয়েছিলেন। কিন্তু তার কর্তব্য থেকে তিনি বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। বিশ্বে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের ধারাকে ‘রোলমডেল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। জীবিতকালেই তিনি কিংবদন্তির মর্যাদা লাভ করেন। চারিত্রিক দৃঢ়তার গুণেই বঙ্গবন্ধু বাইরের শত্রু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করতে পেরেছিলেন, কিন্তু ভেতরের শত্রু ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে পরাজিত করতে পারেননি। ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত এই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তথা ধর্ম ব্যবসায়ীদের ‘বিষধর সাপ’ বলে অভিহিত করেছেন। (ভোরের কাগজ, ২০.০৪.২১)। এই বিষধর সাপের ছোবলেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। বিষধর সাপদের প্রতিনিধি খোন্দকার মোশতাক সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ বঙ্গবন্ধুকে সাবধান করেছিলেন। কিন্তু বিশাল হৃদয়ের অধিকারী বঙ্গবন্ধু এই সাবধান বাণীকে গুরুত্ব দেননি। পরবর্তীকালে খোন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান ও এরশাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে একাত্তরের পরাজিত শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবলুপ্তি ঘটায়। ‘বীর বাঙালি’ ‘ভীরু বাঙালি’ জাতিতে পরিণত হয়। শ্যামল দত্ত বর্ণিত এই ‘বিষধর সাপকে’ বঙ্গবন্ধু যেমন চিনতে পারেননি, তেমনি তাদের চিনতে ভুল করছেন তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পিতা-মাতার করুণ পরিণতি দেখা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা এই অপশক্তির সঙ্গে আপস করেছিলেন। সম্প্রতি সরকারের চাপের মুখে পড়ে এই অপশক্তি কিছুটা নমনীয় সুরে কথা বলছে। সংকট কেটে গেলে তারা আবার ছোবল মারতে দ্বিধা করবে না। প্রাণী জগতে একমাত্র সাপ কখনো পোষ মানে না। দুধ-কলা দিয়ে সাপ পুষলেও সে সুযোগ পেলেই ছোবল মারে। মানব সমাজে ধর্ম ব্যবসায়ীরা হচ্ছে সরিসৃপ জাতীয় প্রাণী, যারা কখনো পোষ মানে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা এই স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার সুযোগ পেয়েছিলাম, কিন্তু বাঙালি চরিত্রের আপসকামিতার জন্য সে সুযোগ আমাদের হাতছাড়া হয়। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধীদের সঙ্গে কোনো প্রকার নমনীয় হওয়া ৩০ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার শামিল। শুনেছি কোনো ব্যক্তি একই ভুল তিনবার করলে তার বিবি তালাক হয়ে যায়। অর্থাৎ ওই ব্যক্তি স্ত্রী রাখার যোগ্যতা হারায়। কোনো জাতি একই ভুল তিনবার করলে সে জাতি কী হারাবে? শত্রু বিনাশে যে চারিত্রিক দৃঢ়তা বিদ্যাসাগর, নেতাজী সুভাষ ও বঙ্গবন্ধু এমনকি শেখ হাসিনার চরিত্রেও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তার জোরে বাংলাদেশের বর্তমান ‘বিষধর সাপগুলো’ যেন নির্মূল হয় এটাই সবার কাম্য। শাহ্জাহান কিবরিয়া : শিশুসাহিত্যিক, সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App