×

মুক্তচিন্তা

মুজাফরাবাদ গণহত্যা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ মে ২০২১, ১২:০২ এএম

বর্তমান পটিয়া উপজেলায় অবস্থিত মুজাফরাবাদ একটি হিন্দু অধ্যুষিত স্বনির্ভর এবং আদর্শ গ্রাম। ’৭১-এর ৩ মে এ গ্রাম দগ্ধ হয়েছিল একজন রমিজ মিয়ার প্রতিহিংসার অনলে। তৎকালীন পটিয়া অঞ্চলের মুসলিম লীগের সভাপতি ও খরনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন এডভোকেট রমিজ আহমেদ চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্বে স্থানীয় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ স্বর্গীয় যাত্রামোহন চৌধুরী এবং ব্যবসায়ী আলহাজ নুরুজ্জামান সওদাগরের নামে ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মুজাফরাবাদ এন. জে. উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম সংশোধন নিয়ে মুজাফরাবাদবাসীর সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ০১-০৭-৬১ থেকে ৩১-১২-৬১ পর্যন্ত এ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি থাকাকালে তিনি স্কুলের নামের সঙ্গে তার নাম জুড়ে দেয়ার উদ্যোগ নিলে এলাকার যুবসমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ব্যর্থ হন। এরপর মুজাফরাবাদবাসীর প্রতি এ ব্যক্তির মনে তীব্র বিদ্বেষের জন্ম নেয়। এরপর রমিজ মিয়া সুযোগ খুঁজতে থাকেন। ১৬ এপ্রিল পটিয়ার পতন হলে সমস্ত দক্ষিণ চট্টগ্রাম পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে যায় এবং রমিজ মিয়ারও প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ এসে যায়। দোহাজারী ক্যাম্পে যাওয়ার সময় এ রমিজই মুজাফরাবাদ গ্রামটি পাকিস্তানি বাহিনীকে চিনিয়ে দেন এবং গ্রামটিতে হামলা চালানোর জন্য পাকিস্তানি কমান্ডারদের প্ররোচিত করেন। তিনি পাকিস্তানি কমান্ডারকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, এ গ্রামে প্রচুর ভারতীয় অস্ত্র নিয়ে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তা ছাড়া হিন্দু অধ্যুষিত এ গ্রামে অনেক সুন্দরী মেয়ে আছে, যা শুনে নারীলোভী পাকিস্তানি কমান্ডার হামলা চালাতে রাজি হয়। রমিজ মিয়ার পরিকল্পনায় ৩ মে মুজাফরাবাদে শুরু হয় ভয়াবহ, ইতিহাসের জঘন্য ও নৃশংসতম আক্রমণ। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, দোহাজারী ক্যাম্প থেকে মোট তিনটি জিপ নিয়ে শতাধিক পাঞ্জাবি ও বেলুচি বাহিনী স্থানীয় ৫০ জনের উপরে রাজাকারের সহায়তায় পুরো গ্রামটিকে তিন দিক থেকে ঘিরে পৈশাচিক অভিযান শুরু করে। গ্রামের পূর্বদিকে আরাকান সড়কে বসানো হয় ছয়টি ভারী কামান আর উত্তর সীমান্তে তমালতলা আশ্রমের সামনে দিয়ে পশ্চিমের শেষ সীমান্ত পর্যন্ত এমনভাবে মেশিনগান বসানো হয়, যেন গ্রাম থেকে কেউ পালাতে না পারে। সারা গ্রাম যেন বিকট শব্দে কাঁপতে লাগল। নারী-শিশুর কান্নার রোল আর মেশিনগানের বিকট শব্দ যেন সব একাকার। ভোর ৬টা বা সাড়ে ৬টা থেকে শুরু হওয়া এ অভিযান চলে প্রায় দুপুর ২টা পর্যন্ত। প্রায় ৮ ঘণ্টার এ নৃশংসতম হামলায় পাকিস্তানি বাহিনী ৩০০-এর বেশি সাধারণ মানুষ হত্যা করে জ্বালিয়ে দেয় প্রায় ৬০০-এর বেশি ঘরবাড়ি এবং ধর্ষিত হন প্রায় ২০০-এর মতো নারী। সেদিন নরপশুরা কাউকে রেহাই দেয়নি। খাল-বিল-পুকুর, ঝোপ-ঝাড় বা খড়ের গাদায়, গোয়ালঘর কিংবা পবিত্র উপাসনালয়, যেখানে মানুষকে লুকিয়ে থাকতে দেখেছে, রাজাকারদের সহায়তায় তাদের খোঁজে বের করে হত্যা করেছে নির্মমভাবে। গ্রেনেড ফাটিয়ে, জ্বলন্ত ঘর ও খড়ের গাদায় জীবন্ত মানুষ নিক্ষেপ করে, মুখে এবং মলদ্বারে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে এমনকি আগুনের জ্বলন্ত মশাল ঢুকিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। অনেকে ঘরের ভেতরে থাকা অবস্থায় আগুনে সিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। মানুষকে জীবন্ত জবাই করতেও পিছপা হয়নি বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী। অমানবিক নির্যাতনের পর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় বহু মানুষকে। রক্তের খাল হয়ে যায় পুরো গ্রামটি। বার বার ধর্ষিত হওয়া নারীদের আর্তচিৎকার, সন্তান হারা মায়ের কান্না, পিতার সামনে মেয়েকে পাশবিক নির্যাতন, ভাইয়ের সামনে বোনকে, সন্তানের সামনে মাকে ধর্ষণ, শৃগালে টেনে নেয়া লাশের বিকৃত রূপ, স্বামী হারা নারী, সন্তান হারা মা, পিতা হারা সন্তানের কান্নায় ভারি হয়ে উঠে পুরো গ্রাম। লাশের গন্ধে নিশ্বাস নেয়ার অনুপযোগী হয়ে উঠে মুজাফরাবাদের নির্মল বাতাস। এমন বিভীষিকাময় ক্ষণে নরপশুদের উল্লাস এবং নারী সম্ভোগ যেন সৃষ্টিকর্তার অন্তরকে বেদনাময় করে তুলে। জীবন্মৃত ও অর্ধমৃত মানুষগুলোর ওপর পরদিন রাত পোহাতেই পার্শ্ববর্তী গ্রামের রাজাকার নুরু বক্স, রমিজ মিয়া ও তাদের সহকারী সুলতানের শত শত পাণ্ডার দ্বারা শুরু হয় পুনরায় হত্যাযজ্ঞ। তারা জীবন্মৃত মানুষগুলোকে জবাই করে, কাউকে পিটিয়ে, কাউকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। লাঞ্ছিত, অপমানিত, ক্লান্ত-শ্রান্ত নারীদের পুনরায় দফায় দফায় ধর্ষণ ও লুটপাট করতে থাকে। পুকুরের মাছ, ঘরের টিন, সোনা-রুপা, তামা-পিতল, পাতিল, কাঠ, ফার্নিচার, ঘরের দরজা-জানালা, কাঁঠাল, সুপারি, মরিচ বাটার পাটা থেকে ঝাড়ু এমনকি ঘটি-বাটি পর্যন্ত লুট করতে থাকে। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে মুখোমুখি হওয়া, চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়া মানুষগুলো যে এত নির্মম ও নিচু হতে পারে, তা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিল। এভাবে তাদের অত্যাচার চরমে পৌঁছালে নিরুপায় গ্রামবাসী অবশেষে পূর্ব পুরুষদের ভিটা, সহায়-সম্পদ সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়। সেই যাত্রায়ও অনাহারে, অর্ধাহারে, পথশ্রমে, রোগে ভুগে অনেকে পথিমধ্যে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ে। গোপালনাথ বাবুল দোহাজারী, চট্টগ্রাম। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App