×

মুক্তচিন্তা

ঈদ শপিং দৃশ্য কিসের সতর্কতা দিচ্ছে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ মে ২০২১, ১২:০২ এএম

সরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকানপাট খোলার অনুমতি দিয়েছে। দোকান মালিক সমিতিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে। কিন্তু দিন যতই গড়িয়ে যাচ্ছে ঈদের কেনাকাটায় কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ন্যূনতম দৃশ্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না। শপিংমল থেকে শুরু করে সাধারণ দোকানপাট ও ফুটপাতে মানুষ ঈদের জন্য কেনাকাটায় হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। এ দৃশ্য শুধু ঢাকাতেই নয় মফস্বল শহর, উপজেলা এবং গ্রামের বড় বড় বাজারেও দেখা যাচ্ছে। শুধু ক্রেতারাই নয়, বিক্রেতাদের বেশিরভাগই মাস্ক ঠিকমতো পরছেন না, দোকানে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখারও দৃশ্য চোখে পড়ে না, হাত ধুয়ে কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজ করে শপিংমলে প্রবেশ করার নিয়মও তেমন কেউ মানছেন না। বিক্রেতাদের নিয়ম ভঙ্গ করার কথা জিজ্ঞেস করলে তাদের সোজা উত্তর, তেমন দাবি ক্রেতাদের কাছে করা হলে তারা দোকান ছেড়ে চলে যান। পুঁজিবাদে একটি প্রবাদ আছে, ‘ঈঁংঃড়সবৎ রং ধষধিুং ৎরমযঃ’. এটি আমাদের দেশে বিক্রেতারাও ভালোই জানেন। সুতরাং তারা কোন সাহসে ক্রেতাকে ক্ষেপাতে যাবেন। তাদের দরকার পণ্য বিক্রি করা। কাস্টমারকে খুশি না করতে পারলে কাস্টমার পণ্য কেনেন না সেটি সবাই জানেন। ক্রেতারা অনেক সময়ই দোকানে পণ্য ক্রয় করতে গিয়ে লাটবাহাদুরের আচরণ করেন। কিন্তু বিক্রেতা সব বুঝেও মুখ বুজে থাকেন। তিনি পণ্য বিক্রি করতে পারলেই সন্তুষ্ট থাকেন। সুতরাং আমরা কি করে আশা করতে পারি যে, আমাদের দোকানিরা ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট থাকবেন। যেসব প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছেন সেগুলো বাস্তবায়ন তাদের দ্বারা যে সম্ভব নয় সেটি আমাদের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই। অতএব যা হওয়ার তাই হচ্ছে। ঈদের এখনো বেশ দেরি। তারপরও মানুষ এখনই ঈদের কেনাকাটায় যেভাবে নেমে পড়েছেন তা দেখে মনে হচ্ছে যে, গণপরিবহন চলার অনুমতি দেয়ার পর ঢাকা শহরে ঈদের কেনাকাটাতেই যত মানুষ নেমে পড়বে তাতে স্বাস্থ্যবিধি শব্দযুগল বাংলাদেশ থেকে আপনাআপনি পালিয়ে যাবে! বিভিন্ন দোকান মালিকরাও সরকারের কাছে গণপরিবহন চলাচল করার অনুমতি দেয়ার দাবি করছেন। কারণ তারা মনে করছেন এখনো পর্যাপ্ত ক্রেতা বাজারে আসতে পারছেন না গণপরিবহন চলাচল না করায়। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী সেই অনুমতি দেয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। তাহলে আশা করা যাচ্ছে ৬ তারিখ থেকে ক্রেতা-বিক্রেতাদের আশা পূরণ হবে। বিক্রেতাদের কেউ কেউ লকডাউন তুলে নেয়ার পর গণমাধ্যমের সম্মুখে দাবি করছিলেন যে, এ বছর তাদের বেচাকেনা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণ করবে না। এখন মনে হচ্ছে তাদের সেই দাবি যথার্থ নয়। বিশেষত এবার ঈদের কেনাকাটা করতে কেউই কলকাতা কিংবা অন্য দেশে যেতে পারছেন না। ফলে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঈদ শপিং উপলক্ষে বিদেশে চলে যেত। এবার সেটি হচ্ছে না। সেদিক থেকে আমাদের অর্থনীতির জন্য এটি ছোট হলেও ইতিবাচক সংবাদ। যারা ঈদের শপিং কলকাতায় করতেন তারা এবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বড় বড় শহরে করবেন এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। অতএব আমাদের দেশের বড় বড় শপিংমলের ঈদের পসরা সাজানো দোকানিরা ভালোই ক্রেতা পাচ্ছেন। তাদের যদি এসব ক্রেতার আকৃষ্ট করার মতো ঈদ পোশাক-সামগ্রী সংগ্রহে থাকে তাহলে তারা ভালোই বেচাকেনা করতে পারবেন। সুতরাং এবারের ঈদের কেনাবেচা নিয়ে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, হতাশা ও দুর্ভাবনা বোধহয় অনেকেরই কেটে যাচ্ছে। তবে যে বিষয়টি সবারই নজর কেড়ে নিচ্ছে তা হলো, দীর্ঘ দেড় বছর করোনা সংক্রমণে দেশের অর্থনীতি খারাপ হয়ে যাওয়া, মানুষের হাতে টাকা নেই, কষ্টে আছেনÑ এমন কথা গণমাধ্যমের সম্মুখে অনেককেই প্রায় বলতে শোনা যায়। কিন্তু তাদের এখন ঈদের কেনাকাটায় যেভাবে ছোটাছুটি করতে কিংবা পছন্দের পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে যে, মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তের বড় অংশই এখনো আর্থিকভাবে ভালোই আছেন। এমনকি মফস্বল এলাকায়ও কেনাকাটার দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীরা তাদের পরিজনদের জন্য যে টাকা পাঠাচ্ছেন তা ঈদের কেনাকাটায় তারাও বেশ উপভোগ করছেন। অবশ্য হতদরিদ্র এবং কর্মহারা পরিবারগুলোর হাতে ঈদের কেনাকাটায় খরচ করার মতো অর্থ আগের বছরগুলো মতো নেই তারপরও ফুটপাত থেকে তারাও কিছু না কিছু কেনার চেষ্টা করছে। সামগ্রিকভাবে দেখতে গেলে মনে হচ্ছে এখন বিরাটসংখ্যক মানুষ ঈদের কেনাকাটায় কিছুটা হলেও ব্যস্ত আছেন। সে কারণে রোজা এবং প্রচণ্ড দাবদাহ উপেক্ষা করেও বিপুলসংখ্যক মানুষ ঈদের কেনাকাটায় ব্যস্ত আছেন। দৃশ্যটি দেখতে মোটেও খারাপ লাগার নয়, বরং ভালোই লাগার কথা। কিন্তু আতঙ্কের বিষয়টি হচ্ছে করোনা নামক ভাইরাস গেল বছর থেকে সর্বত্রই ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ বছর মাস দুই আগে সেটি বন্য হাতির মতো আবার যেভাবে সবকিছু তছনছ করতে নেমে এসেছে সেটি তো এখনো নিজের জায়গায় ফিরে যায়নি। করোনা যদিও অতিক্ষুদ্র ভাইরাস, যা চোখে মানুষ দেখতে পারছে না। কিন্তু এর আগ্রাসন ও আক্রমণ বন্য হাতির চেয়ে কোনোভাবেই কম হৃদয়বিদারক নয়। যাকে এই ভাইরাস নাগালের মধ্যে পায়, তাকে কীভাবে পিষে ফেলে সেটি তো এখনো আমরা দেখছি। আমাদের খুব নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত গত কিছুদিন থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি করোনা সংক্রমিত দেশ হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। সেখানে দৈনিক মৃত্যু হিসাবমতে ৩ হাজার ৫০০, হিসাবের বাইরে অনেকেই রয়ে যাচ্ছেন বলে ভারতীয় গণমাধ্যম সংবাদ দিচ্ছে। প্রতিদিন সেখানে সংক্রমণে সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, হাসপাতালে রোগীরা বেড পাচ্ছে না, অক্সিজেনের জন্য হাহাকারের দৃশ্য, মানুষের মৃত্যুর খবর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যেভাবে প্রচারিত হচ্ছে, তাতে ভারতীয় করোনার স্বরূপ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সারা বিশ্ব থেকে ভারতকে এ মুহূর্তে নানাভাবে সহযোগিতা করার জন্য অক্সিজেনসহ নানা চিকিৎসাসামগ্রী নিয়ে পাশে দাঁড়াচ্ছে। ভারতের বিশেষজ্ঞরাই শুধু নয়, আন্তর্জাতিক সংস্থার বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন যে ভারতে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে মানুষ যেভাবে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান যেভাবে পালন করেছে, সরকার ভোট নিয়ে যেভাবে দেশকে করোনা সংক্রমিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে, তা নিয়ে সবাই ক্ষোভ প্রকাশ করেছে, সরকারের সমালোচনাও করছে। ভারতের গণমাধ্যমগুলোতে এই মুহূর্তে করোনায় আক্রান্ত মানুষের পরিবারের সদস্যরা যেভাবে কান্না ও ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছেন তা দেখে সারা বিশ্বের মতো আমরাও আতঙ্কিত বোধ করছি। কিছুদিন আগে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় মানুষ যাতায়াতের ওপর কঠোর নিয়মবিধি জারি করা হয়েছে। ভারতের সঙ্গে এখন আকাশ পথ বন্ধ, রেলও স্থগিত। খুবই সীমিতসংখ্যক আটকে পড়া মানুষ কোয়ারেন্টাইন করার শর্তে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশে যখন করোনার এমন দুর্যোগময় অবস্থা চলছে, তখন বাংলাদেশে বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিদিন বিশেষজ্ঞরা নানা ধরনের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও গোটা দেশের ঈদের শপিং দৃশ্য দেখে মনে হয় না আমাদের বেশিরভাগ মানুষ করোনার সংক্রমণের কোনো আতঙ্কে আছে। এপ্রিল মাসে আমাদের এখানে হাসপাতালে চিকিৎসা সংকট, অক্সিজেনের অভাবে বেশকিছু রোগী মৃত্যুবরণ করেছে। তখন ঢাকার সচেতন মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। গত কয়েকদিন সংক্রমণের হার কিছুটা কমে আসায় অনেকেই যেন এক ধরনের স্বস্তিতে আছে। গ্রামে-গঞ্জে অবশ্য করোনা সংক্রমণ সম্পর্কে আগে থেকেই উদাসীন। তারা কিছুতেই মাস্ক পরেন না। শহরেও অনেকই আছেন মাস্ক না পরা। আবার অনেকে মাস্ক পরার বৈজ্ঞানিক নিয়ম অনুসরণ করছেন না। পকেটে বা হাতে মাস্ক নিয়ে চলাফেরা করছেন। অনেকে টিকা গ্রহণেও উদাসীন, অনিচ্ছুকও। এমন পরিস্থিতিতে ঈদের কেনাকাটার যে দৃশ্য দেশব্যাপী পরিলক্ষিত হচ্ছে, কদিন পর ঈদ উদযাপন করতে ঢাকা শহর থেকেই লাখ লাখ মানুষ বাড়ি যাওয়ার জন্য রওনা দেবেন, যানবাহন না পেলেও তার ভেঙে ভেঙে বিপুল অর্থ খরচ করে গ্রামে ঈদ করতে ছুটবেনই। সুতরাং এই পরিস্থিতি শেষে করোনা সংক্রমণের অবস্থা কেমন হবে তা কেবল দুই-তিন সপ্তাহ পরই বোঝা যাবে। যদি কোনো কারণে আমাদের দেশে বিদ্যমান করোনা ভাইরাস তার রূপান্তরিত কোনো রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয় অথবা বিদেশ থেকে আসা কোনো ভ্যারিয়েন্ট আমাদের দেশে প্রবেশ করে তাহলে আমাদের কী দশা হবে সেটি হয়তো আমরা অনুমান করতে পারছি না। কিন্তু বিশাল ঘনবসতি এই দেশে যদি করোনার নতুন কোনো রূপ বন্য হাতির উগ্রতা নিয়ে আবির্ভূত হয় তাহলে এর জন্য কত মূল্য দিতে হবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। সরকার থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বারবার অনুরোধ করা হচ্ছে, গণমাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা প্রতিদিনই বলছেন। কিছু মানুষ আগে থেকেই সচেতন আছেন, প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছেন না, স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই স্বাভাবিক সময়ে অনেক কিছু মানেননি, এখন ঈদ উপলক্ষে শপিং, কেনাকাটা, ‘নাড়ির টানে বাড়ি যাওয়া’, ঈদ করা, ঈদের পর ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়ানো, সামাজিক নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা ইত্যাদি ঠেকিয়ে রাখার যথাযথ কর্তৃপক্ষ সব জায়গায় না থাকায় অবাধে চলবেই, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং আমরা জানি না এবারের ঈদ উৎসবের পর আমাদের দেশে কি হবে? করোনা মহামারির ১০ নম্বর বিপদ সংকেত জারি থাকা সত্ত্বেও এক নম্বরের গুরুত্বও মানুষ দিচ্ছেন না। ফলে আতঙ্ক, আশঙ্কা, হতাশা, নিরুপায় আমাদের অনেকের ওপরই ভর করে আছে। তবে এই সংখ্যাটি ১৭-১৮ কোটি মানুষের তুলনায় নগণ্য। অতএব সবকিছুই ভবিতব্যের ওপর ছেড়ে দেয়া ছাড়া বেশি কিছু বলার বা করার নেই।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App