×

মুক্তচিন্তা

শহীদজননী জাহানারা ইমামের প্রতিকৃতি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২১, ১২:১১ এএম

শহীদজননী জাহানারা ইমামের প্রতিকৃতি
শহীদজননী জাহানারা ইমামের জন্ম হয়েছিল ১৯২৯ সালের ৩ মে। জন্মেছিলেন মুর্শিদাবাদের এক রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবারে। ছাত্রজীবনে বামপন্থি রাজনীতির সংস্পর্শে এলেও প্রেম ও দাম্পত্য জীবন তাকে সরিয়ে এনেছিল রাজনীতির অঙ্গন থেকে, যদিও তার চেতনা থেকে সমাজের প্রতি অঙ্গীকার কখনো অপসৃত হয়নি। স্বামী ও দুই পুত্রকে নিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন এক সুখী প্রেমময় জগৎ। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল তার বৈদগ্ধ, মার্জিত রুচি এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা। লেখালেখি শুরু করেছেন ষাটের দশকে। সংগঠন ও আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তিও তখন থেকে। জাহানারা ইমাম বেঁচেছিলেন ৬৫ বছর। ’২৯ থেকে ’৯৪ সালÑ ইতিহাসের রথের বহু গতি পরিবর্তন তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন এই সময়ে। তিনি দেখেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের করাল রূপ, মন্বন্তর, ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ও ভারত বিভক্তি, বঙ্গভঙ্গ, বায়ান্নার ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সবশেষে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তর তিনি দূর থেকে দেখেননি, নিজেই ছিলেন ইতিহাসের এই মহান অধ্যায়ের অন্যতম চরিত্র। তার ৬৫ বছরের জীবনকে আমি দুভাবে দেখি। পথম পর্ব শেষ হয়েছে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের আগে, যে জীবন ছিল একান্তভাবে তার নিজস্ব, রুচিশোভন, পরিশীলিত এক আনন্দের জগৎ। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ তাকে নির্বাসিত করেছে পরিপূর্ণ আনন্দের এই সপ্রেম জীবন থেকে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন ৩০ লাখ মানুষ, জাহানারা ইমাম হারিয়েছেন তার পুত্র এবং স্বামীকে। ’৭১-এর পর শুরু হয়েছে এই শহীদজননীর জীবনের সেই গৌরবময় অধ্যায়, যা তাকে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত করেছে বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূর্ত প্রতীকে। তার জীবনের ঘটনাবহুল শেষ আটশ ষাট দিন তাকে পরিণত করেছে ইতিহাসের এক বিশেষ অধ্যায়ের অমোঘ চালিকা শক্তিতে। মুক্তিযুদ্ধের পর জাহানারা ইমাম ভেবেছিলেন নিজেকে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবেন কিন্তু সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের প্রথম নাগরিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের বিচার ও শাস্তির দাবিতে আমরা শহীদ পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় সমাবেশ ও মিছিলের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলাম ’৭২-এর ১৭ মার্চ। স্বামীহারা, সন্তানহারা, পিতা-মাতাহারা সহস্র, লাখো বিপর্যস্ত শহীদ পরিবারের সদস্যরা তখন দুঃসহ বেদনার মহাসমুদ্রে নিমজ্জমান। এই বিক্ষোভ সংগঠিত করতে গিয়ে জাহানারা ইমামকে কাছে দেখে জেনেছি। পরিচয় পেয়েছি তার দুর্লভ সাংগঠনিক ক্ষমতার। মুক্তিযুদ্ধের পর নিজেকে তিনি প্রথম যে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করেন সেটা আমরা গঠন করেছিলাম ১৯৮০ সালে, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমের বহিষ্কারের দাবিতে। এর আগের বছর অসুস্থ মাকে দেখার কথা বলে তিন মাসের ভিসা নিয়ে গোলাম আযম বাংলাদেশে এসে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও অবৈধভাবে অবস্থান করছিলেন। তাকে বহিষ্কারের দাবিতে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী নাগরিক কমিটি’র ব্যানারে আমরা একটা জনসভাও করেছিলাম। সেই জনসভায় জাহানারা ইমাম প্রথম প্রকাশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ছিল সেই ভাষণ। তার ভাষণের মাঝখানে মুক্তিযোদ্ধারা মুহুর্মুহু সেøাগান দিয়েছেনÑ ‘মাগো তোমায় কথা দিলাম, অস্ত্র আবার হাতে নেব’, ‘মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’। এরপর থেকে সামরিক স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে যত নাগরিক সংগঠন ও আমরা আন্দোলন করেছি জাহানারা ইমাম ছিলেন আমাদের সহযাত্রী, যার চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে ১৯৯২-এর জানুয়ারিতে গঠিত ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। এর তিন সপ্তাহ পরে আন্দোলনের বৃহত্তর প্রয়োজনে নির্মূল কমিটিসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ৭২টি রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন নিয়ে গঠিত হয়েছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি।’ জাহানারা ইমাম দুটি সংগঠনেরই আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৯২-এর ২৬ মার্চ জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালত বসে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার প্রত্যক্ষ করার জন্য পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষের সমাগম হয়েছিল। একজন গৃহবধূ, শহীদের মা, ‘একাত্তরের দিনগুলি’র লেখক জাহানারা ইমাম এভাবেই নেতৃত্ব দিয়েছেন এক অবিস্মরণীয় নাগরিক আন্দোলনে, যা বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়া কিংবা এশিয়া নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। শেষ জীবনে ক্যান্সারে আক্রান্ত জাহানারা ইমামের শেষ দিনগুলোÑ বিশেষ করে ’৯২-এ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনে নেতৃত্বদানের পর থেকে সময় কেটেছে প্রচণ্ড ব্যস্ততার ভেতর। এই কর্মব্যস্ততা, আন্দোলনের পর্যায়ক্রমিক বিকাশ, তার প্রতি দেশবাসীর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা তাকে যেমন আনন্দ দিয়েছে, বিনিময়ে বেদনাও তাকে কম সইতে হয়নি। জীবনের শেষ ১৩ বছর তিনি ক্যান্সারের নির্মম আক্রমণে জর্জরিত হয়েছেন, বাইরে প্রকাশ করেননি। মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে তাদের পত্রপত্রিকার দ্বারা, তাদের জনসভা ও অন্যান্য প্রচারের দ্বারা তিনি কম আক্রান্ত হননি। এতে তিনি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, সংকল্প আরো দৃঢ় হয়েছে। কিন্তু যখন আঘাত এসেছে আন্দোলনের ভেতর থেকে, তিনি ব্যথিত হয়েছেন, বাইরে প্রকাশ করেননি। আন্দোলনের কর্মীরা কখনো জানতে পারেননি কী প্রচণ্ড প্রতিকূলতার ভেতর কাজ করতে হয়েছে তাকে। জাহানারা ইমামের আন্দোলন এই উপমহাদেশে শুধু নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য এক অনুকরণযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি একটি ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক সমাজ নির্মাণের প্রয়োজনে ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের এই আন্দোলন ছিল জীবন-জীবিকার প্রাত্যহিক সমস্যার ঊর্ধ্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের প্রত্যয়। একটি অনুন্নত পশ্চাৎপদ দেশে সিভিল সমাজের এই আন্দোলন সূচনাপর্ব থেকে এ কারণেই উন্নত দেশের গণমাধ্যমের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। গণআদালতের সাফল্যের পর জাপান থেকে শুরু করে আমেরিকা ও ইউরোপের বহু সাংবাদিক তার সম্পর্কে লেখার জন্য, সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য এবং প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ঢাকা এসেছিলেন। এই বৈচিত্র্যধর্মী আদর্শ আশ্রয়ী আন্দোলন তাকে নির্বাসিত করেছিল তার একান্ত নিজস্ব জগৎ থেকে, যে জগৎ নতুনভাবে তিনি তৈরি করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে সন্তান ও স্বামী হারাবার পর। তার একান্ত আপনার এই জগতে তিনি ব্যস্ত ছিলেন লেখালেখি নিয়ে, নিয়মিত যেতেন বাংলা একাডেমির বইমেলায়, বিজয়মেলায়, নববর্ষের অনুষ্ঠানে। কবি সুফিয়া কামালের মহিলা পরিষদের সহসভানেত্রী হিসেবে সাংগঠনিক কার্যক্রমেও অংশ নিতেন। খোঁজ নিতেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পরিবার কে কোথায় আছে, কার কী প্রয়োজন। কখনো সারাদিন কাটাতেন তার কোনো মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের পরিবারের সঙ্গে। তার শখ ছিল বাগান করার, গান শোনার আর রান্না করার। বেলি ছিল তার প্রিয় ফুল। তার প্রিয় গানের শিল্পীদের ভেতর ছিলেনÑ আঙ্গুরবালা, কমলা ঝরিয়া, যুথিকা রায়, কেএল সায়গল, পঙ্কজ মল্লিক ও শচীনদেব বর্মণ। হেমন্ত ও সন্ধ্যাও তার প্রিয় শিল্পীদের তালিকায় ছিলেন। একবার আমার বাসায় জিম রিভসের গান শুনে তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন। রুমীর প্রিয় গায়ক ছিল জিম রিভস। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা তার জন্মদিন উদযাপন করত এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে। তিনি খুশি হতেন ফুল আর গানের ক্যাসেট উপহার পেলে। সকাল থেকে তার ছেলেরা আসত সপরিবারে ফুল আর নানারকম উপহার নিয়ে। আত্মীয়স্বজনও আসতেন। কেউ রান্না করা খাবার আনত, কেউ মিষ্টির প্যাকেট আনত। তিনি নিজেও রান্না করতেন। সব কিছু ছিল ঘরোয়া। ’৯২-এর পর থেকে তার আন্দোলনের সহযোদ্ধারা যখন তার জন্মদিনের তারিখ জেনেছেন তখন আর আগের ঘরোয়া পরিবেশ ছিল না। তার পাঠক আর গুণগ্রাহীর সংখ্যাও অনেক বেড়ে গিয়েছিল ’৯২ আর ’৯৩-এর জন্মদিনে। ব্যতিক্রম ছিল ’৯৪-এর জন্মদিন। তখন তিনি ডেট্রয়েটের হাসপাতালে মৃত্যুর দিন গুনছিলেন। ২১ এপ্রিল (১৯৯৪) তার পুত্র জামীর চিঠিতে জেনেছিলাম তার শেষ অপারেশন এবং চিকিৎসকদের সংশয়ের কথা। আমাকে লেখা তার শেষ চিঠিতে আন্দোলনের নেতৃত্ব ও পরিস্থিতি সম্পর্কে চাপা ক্ষোভ ছিল, যা নিরসনের জন্য ভাবলাম তাকে জানানো প্রয়োজন আমরা সবাই একসঙ্গে আছি, আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সমন্বয়ের স্টিয়ারিং কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করলাম ৩ মে তার জন্মদিনে আমরা সবাই মিলে তাকে শুভেচ্ছা জানাব। নেতাদের অনেকে আলাদাভাবে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠালেও সবাই মিলে ৩ মে ’৯৪ তারিখে তার ৬৫তম জন্মবার্ষিকীতে ‘দেশজননী জাহানারা ইমামের শুভ জন্মদিনে সশ্রদ্ধ অভিবাদন’ শিরোনামে নিম্নোক্ত বার্তা পাঠিয়েছিলাম ফ্যাক্সেÑ ‘শ্রদ্ধেয়া জাহানারা ইমাম, আজ আপনার শুভ জন্মদিন। আপনার জন্মদিন গোটা জাতির জন্য আনন্দের দিন, অথচ এবার এমন এক সময়ে আপনার জন্মদিন পালন করছি যখন সুদূর প্রবাসে আপনি হাসপাতালের রোগশয্যায় শায়িত; সকল প্রিয়জন, আত্মীয়, শুভানুধ্যায়ী আপনার জন্য গভীর উদ্বেগ ও শঙ্কায় কালযাপন করছেন, ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে আপনার দীর্ঘ বারো বছরের যুদ্ধ যখন আরো তীব্র হয়েছে। এ যুদ্ধ আপনার একার হলেও আমাদের সকলের গভীর সমবেদনা ও সহমর্মিতা এ সুযোগে আবারো জ্ঞাপন করতে চাই। আমাদের জাতীয় জীবনের এক চরম সংকট মুহূর্তে, রাজনৈতিক দলসমূহের ঔদাসীন্য ও প্রশ্রয়ে যখন মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় অর্জন একাত্তরের ঘাতকদের দ্বারা লাঞ্ছিত ও পর্যুদস্ত হচ্ছিল তখন আপনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। আপনার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল রাজনৈতিক দল, গণ ও সামাজিক সংগঠনসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আপনার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে এক অভাবনীয় আন্দোলন, যা বাংলাদেশের ভৌগোলিক গণ্ডি অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলা ভাষাভাষী অধ্যুষিত সমগ্র বিশ্বে। শহীদ রুমীর জননীকে দেশবাসী অভিষিক্ত করেছেন দেশজননীর মর্যাদায়। আমরা জানি যতবার আপনি চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়েছেন, হাসপাতালের রোগশয্যা থেকেও আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছেন, কখনো দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখে দেশে ফিরে এসেছেন। আপনার এই কর্মোদ্দীপনা, ত্যাগ, নিষ্ঠা এবং আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকা আমাদের সকলের জন্য প্রেরণার এক অফুরন্ত উৎস। এই প্রেরণা আমাদের ঐক্যের পূর্বশর্ত এবং লক্ষ্য অর্জনের প্রধান শক্তি। আমরা আপনাকে কথা দিচ্ছি, যতদিন আপনি আমাদের ভেতর ফিরে না আসছেন আপনার নির্দেশিত পথে আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যাব এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রতি নিবেদিত থাকব। পরম করুণাময়ের নিকট প্রার্থনা করি তিনি আপনাকে ঘাতকব্যাধির চরম যন্ত্রণার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি দিন। আপনি দ্রুত আরোগ্য লাভ করে আমাদের কাছে ফিরে আসুন। জন্মদিনের এই শুভ মুহূর্তে আপনার প্রতি আমাদের ও দেশবাসীর সশ্রদ্ধ অভিবাদন গ্রহণ করুন।’ এতে যাদের স্বাক্ষর ছিল তারা হলেনÑ  কবি সুফিয়া কামাল, কথাশিল্পী শওকত ওসমান, বিচারপতি দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, সংগীতশিল্পী কলিম শরাফী, ব্যারিস্টার শওকত আলী খান, লে. কর্নেল (অব.) কাজী নূর-উজ্জামান, কবি শামসুর রাহমান, অধ্যাপক আবদুল খালেক, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, অধ্যাপক অনুপম সেন, মাওলানা আবদুল আউয়াল, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) সদরুদ্দীন, এডভোকেট গাজীউল হক, সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ, এডভোকেট সালাহউদ্দিন ইউসুফ এমপি, লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী, সৈয়দ হাসান ইমাম, কাজী আরেফ আহমেদ, অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী, নূরুল ইসলাম নাহিদ, অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরী ও শাহরিয়ার কবির। জাতীয় গণতদন্ত কমিশন ও জাতীয় সমন্বয় কমিটির সব নেতার স্বাক্ষর ছিল এতে, শুধু সমন্বয়ের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক দেশের বাইরে থাকায় তার স্বাক্ষর এতে ছিল না। তিনি লন্ডন থেকে পৃথক বার্তা পাঠিয়েছিলেন। তখনো তার জ্ঞান ছিল। জামী লিখেছে, জন্মদিনে আমাদের সবার মিলিত শুভেচ্ছা বার্তা পেয়ে তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন। তবু সংশয় ছিল তার মৃত্যুর পর এই নেতৃত্ব হয়তো ঐক্যবদ্ধ থাকবে না। যে কারণে মৃত্যুর পূর্বে তার অন্তিম বাণীতে তিনি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনের ভার তিনি জনগণের হাতে অর্পণ করে গেছেন। প্রথমে ‘একাত্তরের দিনগুলি’র লেখক হিসেবে, পরে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে নিজেকে তিনি অধিষ্ঠিত করেছেন লাখো কোটি মানুষের হৃদয়ে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, কিংবা কোনো পার্থিব প্রাপ্তির আশায় নয়, শুধু দেশপ্রেমের কারণে, দেশের মানুষকে ভালোবাসার কারণেÑ ৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা বাংলাদেশকে তিনি আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে রেখে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে তিনি সর্বোতভাবে নিয়োজিত রেখেছিলেন। আমাদের পরম সৌভাগ্য, দেশ ও জাতির এক কঠিন সংকট মুহূর্তে যোগ্য নেত্রী হিসেবে আমরা তাকে পেয়েছিলাম। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য, সংকটমুক্ত হওয়ার আগেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। মানুষের জীবন কত অর্থপূর্ণ হতে পারে, কত গরীয়ান হতে পারে, নিজের জীবন দিয়ে আমাদের শিখিয়ে গিয়েছেন জাহানারা ইমাম। শাহরিয়ার কবির : লেখক ও সাংবাদিক; সভাপতি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App