×

মুক্তচিন্তা

যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের পক্ষে খানিকটা যুক্তি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২১, ১২:১০ এএম

দেশের মানুষের একটি বড় অংশই গ্রামে থাকেন। তাদের ভালো থাকার, সুস্থ থাকার অন্যতম জরুরি উপাদান হলো গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিকাঠামো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে গ্রামীণ স্বাস্থ্যের দায়িত্ব ন্যস্ত। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শহরে কিংবা গ্রামে কোথাও ভালো অবস্থায় নেই। তবে সরকার জেলায় জেলায় হাসপাতাল তৈরি করছে, রক্ষণাবেক্ষণ করছে, সংযোজন করছে। এগুলো শহরের চাহিদা পূরণে কিছুটা সাহায্য করলেও গ্রামীণ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তেমন ফলপ্রসূ কাজ করতে পারছে না। এতে গ্রামের মানুষের চিকিৎসার সুবিধা লাভ কতটা হয়েছে তার কোনো সুস্পষ্ট উত্তর জানা নেই কারো। কেননা গ্রাম কিংবা ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা বলতে কতটা বুঝে ঢাকার মন্ত্রণালয়ে বসা কর্মকর্তারা তা প্রশ্নের দাবি রাখে। গ্রামের স্বাস্থ্যসেবা ঠিক রাজধানী থেকে স্টিমরোলার চালিয়ে সুষ্ঠুভাবে করা যাবে না, এটা বুঝতে এখন আর বাকি নেই কারো। শহর এবং গ্রাম দুটিকেই সমানভাবে পরিচালনা করতে প্রয়োজন সিঙ্গেল ইঞ্জিনের পরিবর্তে ডাবল ইঞ্জিন। যুক্তরাষ্ট্রীয় রাষ্ট্র কাঠামোই পুরো বাংলাদেশের শহর আর গ্রামের হিসাব রাখতে বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। শুধু সমুদ্রের খবর রাখলেই চলবে না, খাল-বিলের চেহারাও দেখতে হবে। নয়া ইঞ্জিন নয়, প্রয়োজন ডাবল ইঞ্জিন। পরিবর্তন নয়, প্রয়োজন রূপান্তর। দেশের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আসা যাক। শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন কাজটি সহজ, কিন্তু রূপান্তরের কাজটি সহজ নয়। স্পর্শনসাধ্য শিক্ষার পরিকাঠামোর উন্নতি করার কাজটি বেশ সহজ হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের অভ্যাসগত ভেতরের পরিকাঠামো বদলিয়ে ফেলা সহজ নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের এবং নেতাদের আধিপত্যের অচলায়তন ভাঙা সহজসাধ্য নয়। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ থাকছে, মেধাভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতির প্রসার ঘটতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত উন্নতির স্বার্থে এখানে প্রয়োজন রূপান্তর, একেবারেই মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো। শিল্পায়নের পথে রূপান্তর বিষয়টিও শিক্ষাক্ষেত্রের মতো বেশ কঠিন উপলব্ধির একটি বিষয়। হার্ভার্ডের বিখ্যাত অধ্যাপক মাইকেল পোর্টার শ্রেণিকক্ষে পড়াতে গিয়ে এ বিষয়ে সুন্দর একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ধরা যাক তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে একটি অপূর্ব হোটেল নির্মাণ করা হলো। সারা বিশ্ব খুঁজে খুঁজে নামকরা শেফ ও বাবুর্চি নিয়োগ দেয়া হলো। হোটেল পরিচালনা করার দায়িত্ব দেয়া হলো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি সংস্থাকে। হোটেলটি সব মাপকাঠিতে হয়ে উঠল বিশ্বের একটি শ্রেষ্ঠ পাঁচতারা হোটেল। হোটেলের দরজা উন্মুক্ত করতেই অতিথিরা বিজ্ঞাপন আর হোটেলের আলোকচিত্র দেখে মুগ্ধ হয়ে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা থেকে দলে দলে আসতে শুরু করলেন। এবার গল্পের মোড় বদলাল। অতিথিরা বিমানবন্দরে পা দিয়েই দেখলেন, শুল্ক ও অভিবাসন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্ব্যবহার করছে, লাইনের অতিথিদের টপকে লাইন ভেঙে দুর্নীতির মাধ্যমে কাউকে কাউকে অগ্রাধিকার দিয়ে বের করে আনছে। বিমানবন্দর পার হতেই তাদের চোখে পড়ল রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা। খানাখন্দ, চারদিকে নোংরা আবর্জনার স্তূপ। গাড়ি চলতে চলতেই অতিথিরা টের পেলেন স্থানীয় মাস্তানদের দৌরাত্ম্য, চাঁদাবাজির জুলুম। হোটেলে অতিথিরা ঠিকই পেলেন অপূর্ব খানাপিনা। পাঁচতারা হোটেলের আতিথেয়তার কোনো ত্রুটি নেই। কিন্তু কিছুদিন পরই অতিথি আসা কমে গেল। তারপর হোটেলটি বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হলো। উদাহরণে স্পষ্ট যে, একটি সংস্থা কেন্দ্রীয়ভাবে এবং বিচ্ছিন্নভাবে সর্বাঙ্গ সুন্দর হতে পারে, কিন্তু সফল হতে গেলে তার পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলের সাহায্য পেতে হবে। অতিথিদের সার্বিক অভিজ্ঞতা নেতিবাচক হলে সেই সংস্থা প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে পারবে না। যারা শিল্পে লগ্নি করতে আসবেন, তাদের বিচারে এমন মানদণ্ড বড় করে ধরা দেবে। সরকার পরিবর্তন করে দেখা গিয়েছে বারবার। ফলাফল সেই একই থেকেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষমতার দলবদল হয়েছে; নতুন মুখ এসেছে। কিন্তু দেশের চেহারাটিতে আমূল পরিবর্তন ঘটেনি। বরং ক্ষমতার পালাবদল হয়ে ধীরে ধীরে ক্ষমতাটিকে কুক্ষিগত করার স্বপ্নে মশগুল রাজনৈতিক নেতা এক হাতে রেখে দিতে চেয়েছে ক্ষমতার সব চাবি। এক হাতে চলে গিয়েছে সব দরজার চাবি। দলের আর সরকারের সব ক্ষমতা গিয়ে আছড়ে পড়েছে এক হাতের মধ্যে। তার ইচ্ছায় সরকার চলছে, অফিস চলছে, অর্থ চলছে, রেল চলছে, লঞ্চ চলছে, সবকিছু চলছে। তার চোখে চোখ রেখে কথা বলার কেউ আর থাকছে না। তাই ব্যক্তি, দল, সরকার সবকিছু একাকার হয়ে যাচ্ছে। তাকে চ্যালেঞ্জ করা দূরে থাক, ভিন্ন মতের মন্তব্য জানাতেও কারো সুযোগ হচ্ছে না। এক দেশ, এক আইন, এক নির্বাচন, এক ব্যবস্থার পক্ষে চলে গিয়েছে বাংলাদেশ নামের স্বপ্নের দেশটি। কিন্তু এটা মানতেই হবে, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ আর ২০২১ সালের বাংলাদেশ এক জায়গায় নেই। সে সময়ের বাস্তবতায় এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত সবকিছু এক ছাতার নিচে আনার স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি। প্রতিটি জেলাকে উন্নীত করে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন গভর্নর পদ্ধতি। সে আশায় নিয়োগও করেছিলেন গভর্নরদের। ১৯৭৫-এর নির্মম ইতিহাসের হাত ধরে তার সেই প্রচেষ্টা অঙ্কুরেই ব্যর্থ হয়ে যায়। কালক্রমে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে, বাংলাদেশের লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে, সরকারের পরিধি বেড়েছে। সব মিলিয়ে একটি ছাতার নিচে তাকে রেখে দেয়ার কারণে দুর্নীতি, অন্যায় আর অবিচার বেড়ে চলছে। এখানে রাষ্ট্রনায়ক এসেছেন, নতুন নতুন কথা বলেছেন। কিন্তু সরকার পদ্ধতি পরিবর্তনের কোনো স্বপ্ন দেখেননি। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এইচএম এরশাদ অবশ্য এমন স্বপ্ন দেখতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বাস্তবতা এনে যেতে পারেননি। তিনি উপজেলাকে উন্নীত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার ক্ষমতার পর বেগম খালেদা জিয়া এসে তা আর বাস্তবায়িত করেননি। এক দেশ, এক সরকারÑ এই ব্যবস্থার বাইরে ভাবার যথেষ্ট কারণ আজ বাংলাদেশের সামনে উপস্থিত হয়েছে। গত দশ বছরে বাংলাদেশ উন্নয়নের চরম শিখরে উন্নীত হতে পেরেছে। কিন্তু এই একক ব্যবস্থার কারণে পাশাপাশি দুর্নীতির চরম বহিঃপ্রকাশও দৃশ্যমান হয়েছে। বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকলেও এক হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে সব ক্ষমতা। দলীয়প্রধান, সরকারপ্রধান এক ব্যক্তি হওয়ায় সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে কেন্দ্রীয় সূত্রে। উন্নয়নের সুষম বণ্টন দেশের প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছে দেয়ার পরিকাঠামো তৈরি হচ্ছে না। উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত সূত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় এমপি। এমপিরা আবার দায়ী তাদের সরকারপ্রধানের কাছে, দলের প্রধানের কাছে। দলের বিরুদ্ধে যেতে তাদের হাত-পা বেঁধে দেয়া হয়েছে। ডানা কাটা পাখির মতো তাদের অবস্থা। সুতরাং সরকার পরিবর্তন হলেও দেশের আমূল পরিবর্তনের সুযোগ ঘটছে না। বাংলাদেশে এ সময়ে সবচেয়ে প্রাধান্য পাওয়া উচিত একটি নতুন সরকার কাঠামো। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার কাঠামো। আমেরিকার মতো, ভারতের মতো বাংলাদেশেও আজ কেন্দ্রীয় সরকার আর প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন। প্রদেশের হাতে ভিন্ন ক্ষমতা, কেন্দ্রের হাতে ভিন্ন ক্ষমতা থাকলে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হওয়ার সুযোগ পাবে। কেন্দ্র এক দলের হাতে থাকতে পারে, প্রদেশ অন্য দলের হাতে থাকতে পারে। কিন্তু কেন্দ্র ইচ্ছে করলেও প্রদেশের ক্ষমতায় হাত দেয়ার সাংবিধানিক সুযোগ পাবে না। কেন্দ্রে ও প্রদেশে একই দলের সরকার থাকুক কিংবা ভিন্ন দলের সরকারই থাকুক, কোনো অঞ্চলের উন্নতির গতি তাতে ব্যাহত হওয়ার সুযোগ পাবে না। কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী থাকবেন, এমপি থাকবেন; ঠিক তেমনি প্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন, প্রাদেশিক এমপি থাকবেন। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হলে জবাবদিহিতা এবং ক্ষমতার ভারসাম্যের একটি রাস্তা বেরিয়ে আসবে। সুশাসনের অভাব আজ যেখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা, ডাবল ইঞ্জিনের যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থা সেখানে ভালো ফল দিতে পারে। ভারতে তা প্রমাণিত, যুক্তরাষ্ট্রে তা প্রমাণিত। বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর এবং সিলেটÑ এই ৮টি ডিভিশনকে প্রাদেশিক সরকারের মর্যাদা দেয়া যেতে পারে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি সারাদেশে ৮টি প্রাদেশিক সরকারের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকতে পারে। তাহলে অন্তত দেশের প্রধানমন্ত্রীকে পুরো দেশের সব চাপ এক হাতে নিতে হবে না। প্রদেশগুলোর উন্নয়নের চাবিকাঠি থাকবে প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ও প্রাদেশিক মন্ত্রীদের হাতে। কেন্দ্রীয় এমপিদের পাশাপাশি প্রাদেশিক এমপিদের অস্তিত্ব দেশে একনায়কতান্ত্রিক এমপি সিস্টেমের অবসান ঘটাতে সক্ষম হবে। ক্ষমতা ও দায়িত্ব ভাগাভাগি হওয়ায় জবাবদিহিতার বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হবে। প্রদেশের উন্নয়নের ভারটি থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে। পুরো দেশের পলিসি নিয়ে তখন কেন্দ্রীয় সরকার আরো সক্ষমতার সঙ্গে কাজ করতে পারবে। কেন্দ্র এবং প্রদেশ দেশের ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্যের সুযোগ করে দেবে। প্রত্যক্ষ শাসন, গণতন্ত্র ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ভাবনাটি মৌলিক হয়ে আসতে হবে সবার কাছে। শাসনকে জনদুয়ারে নিয়ে যেতে হবে। যখন এ দেশের লোকসংখ্যা কম ছিল, তখন সাধারণ মানুষ সরকারের উপস্থিতি টের পেতেন। পেয়াদা দুয়ারে কড়া নাড়ত, সমন ধরিয়ে দিত, হাজিরার নোটিস দিত। লোকসংখ্যার বৃদ্ধি এসবকে কেন্দ্রীভূত করেছেÑ জনদুয়ার থেকে সরিয়ে ফেলেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থা এসব আবার ফিরিয়ে দিতে পারে। জনকল্যাণ ও জননিরাপত্তার আশ্বাস আবার দুয়ারে চলে আসতে পারে। মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App