×

সারাদেশ

কৃষকের গলার কাঁটা টাংগন ব্যারেজ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২১, ০৯:০৪ পিএম

কৃষকের গলার কাঁটা টাংগন ব্যারেজ

এক সময়ে বর্ষা মৌসুমে ঠাকুরগাঁও পঞ্চগড়ের কৃষকদের সেচ সুবিধা দেয়ার জন্য ঠাকুরগাঁও জেলার রাজাগাঁও ইউনিয়নের চাঁপাতি এলাকায় টাংগন নদীর উপর নির্মাণ করা হয় ব্যারেজ। ব্যারেজ নির্মাণ হওয়ার পর ঠাকুরগাঁয়ের উঁচু এলাকার চাষিরা বর্ষাকালে সেচ সুবিধা পেলেও উজানে পঞ্চগড়ের চাষিরা চরম বিপাকে পড়েছেন। ব্যারেজ দেয়ায় প্রতি বছর বর্ষায় নদীটির সামনের অংশে পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। এখন তাদের জমি বর্ষাকালে ডুবে থাকছে আর শুষ্ক মৌসুমেও মিলছে না কাখিত সেচ সুবিধা। চাষাবাদের ব্যারেজ এখন চাষীদের গলার কাটা হয়ে দাড়িয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তারা। প্রতি বছরই সেচ সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছেন পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার রাধাঁনগড় ইউনিয়নের সহস্রাধিক কৃষক। নিরুপায় চাষিরা এখন নিজেরাই শেলো মেশিনের সাহায্যে সেচ দিয়ে বোরা চাষাবাদ করছেন। এতে তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। পানি উন্নয়ন বোর্ডে অভিযোগ করেও পাচ্ছেন না কোন প্রতিকার। ফলে ভাঙ্গা রাস্তা-ঘাট আর সেচ বঞ্চিত হয়ে দিন কাটছে তাদের।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রে জানা যায়, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা রাজাগাঁও ইউনিয়নের চাপাতি এলাকায় টাংগন নদী থেকে কৃষকদের সেচ সুবিধা দেয়ার জন্য ব্যারেজ নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। ১৯৯০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ ব্যারেজটি উদ্বোধন করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিনে প্রায় ১৪ কোটি ৮২ লাখ ৭৭ হাজার টাকা ব্যয়ে ব্যারেজটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৯৩ সালে। প্রকল্পের আওতাভূক্ত জমি ৬ হাজার ৭০ হেক্টর জমি থাকলেও ওই বছরেই সেচ সুবিধার আওতায় আসে সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমি।

সরেজমিনে চাষীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্ষাকালে ব্যারেজে বৃষ্টির পানি আটকে ব্যারেজ এলাকার উঁচু জমিতে সেচ দিয়ে আমন চাষাবাদ করা হয়। এই সময়টুকুতে নদীর উজানের দিকে কয়েক কিলোমিটার এলাকা ডুবে থাকে। আবার শুষ্ক মৌসুমে বাঁধের গেট আটকে দিয়ে উজানের জমিগুলোতে বোরো চাষ করা হতো। ব্যারেজ তৈরীর দুই-তিন বছর সবকিছু ভালভাবে চললেও তারপর থেকেই শুরু হয় সংকট। বিশেষ করে বাঁধের উজানে চরম দুর্ভোগে পড়েন পঞ্চগড়ের চাষিরা। বাঁধের কারণে উজানের প্রায় ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার এলাকা ভরাট হয়ে যায়। তাই শুষ্ক মৌসুমে এই নদীতে পানি না থাকায় সেচ থেকে বঞ্চিত হন তারা। আবার বর্ষকালে ব্যারেজের সবগুলো দরজা বন্ধ রাখায় ডুবে থাকে রাধানগর ইউনিয়নের দক্ষিণ দুর্গাপুর, সাতপাখি দক্ষিণ দুর্গাপুর, দুহশুহ সহ কয়েকটি গ্রামের জমিজমা পথঘাট। বছরে কেবল বোরো আবাদ ছাড়া অন্য কোন ফসল চাষাবাদ করতে পারেন না তারা। বর্তমানে ব্যারেজের সেচ সুবিধা না পাওয়ায় চাষিরা শেলো মেশিন দিয়েই জমিতে সেচ দিচ্ছেন। এতে তাদের উৎপাদন খরচ মারাত্মকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। প্রতি বিঘা জমিতে সেচ দিতেই খরচ হচ্ছে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। চাষাবাদ,বীজ-কীটনাশক সহ সব মিলিয়ে এক বিঘা বোরো ধান চাষাবাদে তাদের খরচ হচ্ছে প্রায় ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা।

গত কয়েক বছরের মধ্যে এ বছরই নদীটির পানি মারাত্মকভাবে শুকিয়ে গেছে। আগে নদীর বুকে কিছুটা পানি থাকলেও এখন খাঁ খাঁ বালু মাটি। কোথাও কোথাও মাটি ফেঁটে চৌচির হয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে স্থানীয়রা ঘের দিয়ে মাছ চাষ করলেও এ বছর পানি না থাকায় সেই সুযোগ পাচ্ছেন না তারা। সব মিলিয়ে ব্যারেজটির কারণে উজানের কয়েক হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলেই তাদের অভিযোগ। ব্যারেজটি তাদের কোন কাজেই আসছে না বরং দুর্ভোগ বাড়াচ্ছে। একদিকে একটি ফসলের বেশি ফসল চাষাবাদ করতে পারছেন না অন্যদিকে সেচ সুবিধাও পাচ্ছেন না। তাই তারা নদীটি পুনঃখননের দাবি তুলেছেন।

আটোয়ারী উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের দক্ষিণ দুর্গাপুর গ্রামের নীতিশ চন্দ্র বর্মন বলেন, এই ব্যারেজ হওয়ার আগে আমরা বোরো চাষাবাদের পাশাপাশি আমন ধানও চাষাবাদ করতে পারতাম। এখন ব্যারেজের কারণে নদী ভরাট হয়ে গেছে। বর্ষাকালে আমাদের জমিতে কোন ফসল চাষ করতে পারি না। অন্যদিকে বোরো মৌসুমেও সেচ সুবিধা পাই না। আমরা নিজেরাই শেলো মেশিন দিয়ে ক্ষেতে সেচ দিচ্ছি।

রবিউল ইসলাম নামে এক চাষী জানান, আগে আমরা এই টাঙ্গন নদীতে দুইটি ফসলের আবাদ করতাম। ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখে দিন কাটাইতাম। আর এখন এই ব্যারেজের কারণে বর্ষায় আমরা ডুবে থাকি আর শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদের পানি পাইনা। বর্ষায় ব্যারেজের লোকজন গেট আটকে দিয়ে ঠাঁকুরগাঁওয়ের চাষীদের উঁচু জমিতে আমন আবাদের সুবিধা করে দেয় আর আমাদের রাস্তা-ঘাট, ফসলি জমি পানির নিচে ডুবে থাকে। এ নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাইনি। উপকারের ব্যারেজ এখন আমাদের গলার কাটা হয়ে দাড়িয়েছে।

ওই এলাকার গণি মিয়া বলেন, ব্যারেজ দেয়ার প্রথম কয়েক বছর আমরা সুযোগ সুবিধা পাইছিলাম। কিন্ তারপর থেকেই সংকট শুরু। এই ব্যারেজ এখন আমাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন ধরণের সুযোগ সুবিধা আমরা পাচ্ছি না। বরং ক্ষতি হচ্ছে। বোরো ছাড়া আমরা কোন ফসল চাষ করতে পারছি না। তাও আবার নিজেরাই সেচ দিচ্ছি। নদীতো শুকিয়ে গেছে। বর্ষাকালে আমাদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। ক্ষেত ডুবে থাকে জলে। রাস্তাঘাট ভেঙে আছে। কিন্ পানি উন্নয়ন বোর্ডে আমরা বার বার অভিযোগ করেও কোন সমাধান পাই নি।

কৃষক হাবিব হোসেন বলেন, টাংগন নদীটি ছিলো খরস্রোতা। ব্যারেজ দেয়ার পর থেকে বাঁধের সামনের অংশ ভরাট হয়ে গেছে। এখন নদী সমতলে মিশে গেছে। আমরা এখন কোন সুবিধাই পাচ্ছি না। বর্ষায় ডুবে থাকতে হচ্ছে আর খড়ায় শুকাতে হচ্ছে। আমাদের তিন ফসলি জমিতে আমরা কেবল বোরো চাষ করতে পারছি। বাকি সময় পানিতে ডুবে থাকছে।

বোরো চাষী জাকির হোসেন বলেন, নদীটি মারাত্মকভাবে শুকিয়ে গেছে। শেলো মেশিন দিয়ে চাষাবাদ করছি। তারপরও একদিন পর পর জমিতে সেচ দিতে হচ্ছে। পানি থাকছে না। এভাবে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। মূলত পানি উন্নয়ন বোর্ড কৃষকের সেচ সুবিধার জন্য এই ব্যারেজটি করলেও এখন তা আসলেও আমাদের অংশের কৃষকদের কোন কাজে আসছে না।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস সোবহান বলেন, নদীটিতে প্রচুর মাছ হতো। হাজার হাজার কেজি দেশি মাছ উৎপাদন হতো এই এলাকা থেকে। অনেকে মাছের ঘের দিয়ে মাছ চাষ করতো। এখন নদীটিতে পানিও নেই মাছও নেই। এখনটি প্রদক্ষেপ না নেয়া গেলে এই এলাকার পরিবেশ প্রকৃতিতে এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।

দুহশুহ গ্রামের নজরুল ইসলাম বলেন, ব্যারেজের কারণে নদীটি মারাত্মকভাবে শুকিয়ে গেছে। নদীর বুকে পানি শুকিয়ে ফাটল ধরেছে। নদীর এমন অবস্থা আগে আমরা দেখিনি। নদীতে শুষ্ক মৌসুমেও পানি থাকতো। দেশি মাছে ভরপুর ছিলো। এখন পানিও নেই মাছও নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো শুষ্ক মৌসুমে আমরা ব্যারেজের মাধ্যমে কোন সেচ সুবিধা পাচ্ছি না। পানি উন্নয়ন বোর্ড আমাদের ৫ জনে মিলে একটি করে মেশিন দিয়েছিল সেটি কয়েক বছরেই নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা চাই নদীটির যেন পুনঃখনন করা হয়। না হলে আমাদের এই এলাকার জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়বে।

পঞ্চগড় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদদৌলা বলেন, টাংগন নদীতে আমাদের একটি সেচ প্রকল্প রয়েছে। এটি ঠাকুরগাঁও পানি উন্নয়ন বোর্ড দেখভাল করে। বর্তমানে নদীটির সামনের অংশে পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। ব্যারেজের ঠাকুরগাঁও অংশে ৩৫ কিলোমিটার পুনঃখনন করা হচ্ছে। পঞ্চগড় অংশের ১০ কিলোমিটার পুনঃখননের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সেটি শিগগিরই অনুমোদন হবে বলে আমরা আশা করছি। ওই ১০ কিলোমিটার খনন করলে চাষিরা আবারো সেচ সুবিধা পাবেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App