×

আন্তর্জাতিক

বিজ্ঞানীদের সতর্কতায় পাত্তা না দেওয়ায় ভারতে করোনা বিপর্যয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ মে ২০২১, ০৫:৪২ পিএম

বিজ্ঞানীদের সতর্কতায় পাত্তা না দেওয়ায় ভারতে করোনা বিপর্যয়

ভারতে করোনায় মৃতদের নেওয়া হচ্ছে চিতায়। ফাইল ছবি

করোনার নতুন একটি ধরন ছড়িয়ে পড়ায় ভারতে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতির বিষয়ে মার্চের শুরুতেই সতর্ক করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু দেশটির সরকার তা ‘উপেক্ষা’ করেছে। ফলে করোনা বিপর্য়ের মধ্যে পড়েছে ভারত। এমন অভিযোগ করেছেন সরকারের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ফোরাম ইন্ডিয়ান সার্স-কোভ-২ জেনেটিকস কনসোর্টিয়ামের (আইএনএসএসিওজি) পাঁচ বিজ্ঞানী। খবর রয়টার্সের।

বিজ্ঞানীরা বলেন, তাদের এই সতর্কবার্তা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে কঠোর বিধিনিষেধ দিতে আগ্রহী হয়নি।

বিজ্ঞানীরা সতর্ক করার কয়েক সপ্তাহ পরও দেশটির লাখ লাখ মানুষকে মাস্ক ছাড়াই কুম্ভমেলার মতো বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও বিরোধী দলগুলোর নেতারাও সভা-সমাবেশ থেকে বিরত থাকেননি। মোদী সরকারের করা ৩টি কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে রাজধানী নয়া দিল্লির প্রান্তে লাখো কৃষকের কয়েক মাসের অবস্থান কর্মসূচিও চলছে। এসবের ধারাবাহিকতা ও সরকারের উদাসীনতায় বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশটি এখন সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত। দেশটির শ্মশানে এখন জায়গা হচ্ছে না লাশের। দাউ দাউ করে দিনরাত জ্বলছে চিতার আগুন। করোনা নিয়ন্ত্রণ এখন সবচেয়ে বড়ো দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

অন্য দেশগুলোর তুলনায় ভারত দেশব্যাপী দুই মাসের কঠোর লকডাউন দিয়ে মহামারীর প্রথম ঢেউ বেশ ভালোভাবেই সামাল দিয়েছিল। তবে দ্বিতীয় ঢেউয়ে শনাক্ত রোগীর ঊর্ধ্বগতি দেশটির অনেক রাজ্যেই হাসপাতালে শয্যা ও অক্সিজেনের সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। বাজারে ওষুধও দুর্লভ হয়ে ওঠেছে।

বিজ্ঞানীদের অনেকেই এ পরিস্থিতির জন্য ভারতে শনাক্ত করোনার নতুন ধরন ও যুক্তরাজ্যে শনাক্ত আরেকটি বেশি সংক্রামক ধরনকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, এ দুটি ধরনের আধিপত্যের কারণেই ভারতের একাধিক রাজ্যে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

গত বছরের ডিসেম্বরের শেষদিকে ভারত সরকার করোনাভাইরাসের কোন ধরনটি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে তা শনাক্ত করতে বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টাদের ফোরাম আইএনএসএসিওজি গঠন করেছিল। ফোরামটি ভাইরাসের ধরন নিয়ে গবেষণায় সক্ষম এমন ১০টি গবেষণাগারকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসে। ভারতের রাষ্ট্র-পরিচালিত ইনস্টিটিউট অব লাইফ সায়েন্সের পরিচালক ও আইএনএসএসিওজ ‘র সদস্য অজয় পারিদা বলেন, এ ফোরামের গবেষকরাই গত ফেব্রুয়ারিতে প্রথম করোনার ভারতীয় ধরন নামে পরিচিত বি.১.৬১৭ ধরনটি শনাক্ত করেন।

উত্তর ভারতের একটি গবেষণাকেন্দ্রের পরিচালক অভিযোগ করেন, আইএনএসএসিওজির বিজ্ঞানীরা ১০ মার্চের আগেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলকে নতুন ধরনটির ব্যাপারে জানায়। ভারতজুড়ে শিগগিরই সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখা যেতে পারে বলে সতর্কও করা হয়। এ সতর্কবার্তা পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয়। একই সময়ে গণমাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত একটি বিবৃতির খসড়ার কাজও শুরু করে আইএনএসএসিওজি। সেখানে গবেষকদের পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভারতীয় ধরনটির দুটি মিউটেশন ই৪৮৪কিউ ও এল৪৫২আর নিয়ে ‘ব্যাপক উদ্বেগ’ জানানো হয়।

ওই খসড়া বিবৃতিতে মিউটেশনগুলো তুলনামূলক সহজেই মানবকোষে প্রবেশ করতে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়তে সক্ষম বলে ধারণা দেওয়া হয়েছিল। দুই সপ্তাহ পর, ২৪ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গবেষকদের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে বিবৃতি দিলেও তাতে ‘ব্যাপক উদ্বেগের’ বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়। বেশি সংক্রামক ধরনের মোকাবেলায় যে যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেগুলো নেওয়া হচ্ছে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়। শনাক্তকরণ পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টিনের পরিমাণ বাড়ে। আইএনএসএসিওজি’র প্রধান শহীদ জামিল বলেন, এমন সতর্কতার পরও সরকার বড় জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো কঠোর সব ব্যবস্থা নেয়নি। সেরকার করোনা মোকাবেলার নীতি ঠিক করার সময় ওইসব তথ্য উপাত্তের দিকে পর্যাপ্ত নজর দেয়নি। তিনি আরও বলেন, করোনা মোকাবেলার নীতি হওয়া উচিত তথ্যউপাত্তের উপর ভিত্তি করে, অন্য কোনোকিছুর ভিত্তিতে নয়। এ ক্ষেত্রে যে বিজ্ঞানকে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না তাতে আমি উদ্বিগ্ন। কিন্তু আমি জানি আমার সীমা কতটুকু। বিজ্ঞানী হিসেবে আমরা তথ্যউপাত্ত হাজির করতে পারি, নীতি তৈরি করা সরকারের কাজ।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উত্তর ভারতের গবেষণা কেন্দ্রের ওই পরিচালক জানান, গণমাধ্যমের জন্য বানানো তাদের খসড়া বিবৃতিটি ভারতের মন্ত্রিপরিষদ সচিব রাজিব গওবাকেও পাঠানো হয়েছিল।

তবে প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি জানানোর এখতিয়ার এই ঊর্ধ্বতন আমলার থাকলেও আইএনএসএসিওজ ‘র ওই সতর্কবার্তাটি মোদীর কাছে কিংবা তার কার্যালয়ে পৌঁছেছিল কিনা তা নিশ্চিত নয়। এ বিষয়ে গওবা ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, আইএনএসএসিওজি‘র পক্ষ থেকে ভারত সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সতর্ক করা হলেও তারা ভারতীয় ধরনটির বিস্তার রোধে পর্যাপ্ত কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে এপ্রিলের ১ তারিখেই এক মাস আগের তুলনায় ৪ গুণ বেশি করোনা রোগী মেলে।

অনেক বিজ্ঞানী অবশ্য বলছেন, ভারতের সংক্রমণ পরিস্থিতি এতটা খারাপ হবে তা তারাও ধারণা করতে পারেননি। তাই কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দোষারোপ করাটা ঠিক হবে না বলেও মত তাদের। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিকেল জেনোমিকসের পরিচালক সৌমিত্র দাস বলেন সরকারকে দোষ দেওয়ার কোনো মানেই নেই। তবে সরকারের অনেক কর্মকর্তা এপ্রিলেই সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনের মতো কঠোর পদক্ষেপের পক্ষে মত দিয়েছিলেন।

আইএনএসএসিওজি নয়াদিল্লির যে ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলকে (এনসিডিসি) প্রতিবেদন পাঠায়, তাদের পরিচালক সুরজিৎ সিং এক অনলাইন বৈঠকে এপ্রিলের শুরুতেই কঠোর লকডাউন দেওয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন। তিনি ১৯ এপ্রিলের ওই অনলাইন বৈঠকে বলেন, “আমাদের ভাবনা অনুযায়ী, আরও ১৫ দিন আগে (লকডাউন) দেওয়া উচিত ছিল। সুরজিৎ তার আগের দিন ১৮ এপ্রিলের এক বৈঠকে সরকারি কর্মকর্তাদেরকে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ও বিপুল মৃত্যু রুখতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে মত জানিয়েছিলেন বলেও ওই অনলাইনে উপস্থিত অন্যদের বলেন ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App