×

মুক্তচিন্তা

বঙ্গবন্ধুর ১ মে’র ভাষণ ও প্রাসঙ্গিক কথা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ মে ২০২১, ১২:২১ এএম

১৯৭২ সালের মহান মে দিবসে জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর প্রতি তার অঙ্গীকারের অনন্য দৃষ্টান্ত। স্বাধীন বাংলার মুক্ত মাটিতে সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক মে দিবস পালিত হওয়ার দিনটিতে বাংলার মেহনতি মানুষ শৃঙ্খলমুক্ত পরিবেশে স্মরণ করেছিল অধিকার অর্জন করতে গিয়ে মহান মে দিবসে শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের। বঙ্গবন্ধুর কাছে মহান মে দিবস ছিল শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের এক জ্বলন্ত প্রতীক। সারা বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। যেহেতু তিনি শোষিতের গণতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন এবং তার অজীবনের লড়াই ছিল সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সেজন্য মে দিবস হয়ে উঠেছিল অনুপ্রেরণার অনন্য উদাহরণ। এজন্য তিনি ভাষণে বলেছেন- ‘বাংলার মেহনতি মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিক-কৃষক ছাত্র যুবক যারা সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের জুলুম এবং ঔপনিবেশিক জালেমদের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতার ইতিহাস লিখে গেলেন, তাদের ত্যাগ ও তিতিক্ষার কথা বাংলাদেশের মানুষ কোনোদিন ভুলবে না। তারা আর কোনোদিন আমাদের কাছে কোনো দাবিদাওয়া নিয়ে আসবেন না। কিন্তু এই লাখ লাখ শহীদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এ দেশের ইতিহাসে। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের মানুষ দেশ গড়ার সংগ্রামে। তাদের কাছ থেকে পাবে প্রেরণা। তাই আজকের এই মহান দিনে আমার দেশের শ্রমজীবী মানুষদেরকে আমি শোষণহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকায় নেমে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।’ দেশের শ্রমজীবী মানুষদের শোষণহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বানে তিনি মে দিবসের পেছনে থাকা ইতিহাসকে বাঙালির সংগ্রামের সঙ্গে একীভূত করেছেন। বঙ্গবন্ধু পুঁজিবাদী বিশ্বের শোষণকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে অধিকার আদায়ে সেই শোষণের বিরুদ্ধে ছিল তার আপসহীন সংগ্রাম। তিনি জানতেন অতীতে আমরা একটি মর্মান্তিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিগড়ে বাধা পড়ে গিয়েছিলাম। গুটিকয়েক সুবিধাবাদী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী জাতীয় সম্পদ ও শ্রমজীবী মানুষে উৎপাদন নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছিল। মহান মে দিবসের ইতিহাসেও সেই একই কাহিনী লিপিবদ্ধ রয়েছে। বাংলাদেশের শ্রম আইনে আছে- সপ্তাহে ছয় দিন শ্রমিকরা কাজ করবেন, প্রতিদিন আট ঘণ্টার বেশি নয়। দুই ঘণ্টা ওভারটাইম কাজ করানো যেতে পারে, কিন্তু কোনোক্রমেই তার বেশি নয়, অর্থাৎ কোনো অবস্থাতেই ১০ ঘণ্টার অতিরিক্ত একজন শ্রমিকের কর্মঘণ্টা হতে পারবে না। এই অতিরিক্ত দুই ঘণ্টার জন্য শ্রমিককে দ্বিগুণ মজুরি দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই মিল কর্তৃপক্ষ জোর করে অর্থাৎ শ্রমিকের সম্মতি ব্যতিরেকে ওভারটাইম কাজ করাতে পারবে না। শ্রমিককে জোর করে ১৬-১৮ ঘণ্টা কাজ করানো কিংবা ওভারটাইমে দ্বিগুণ মজুরি না দেয়া অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। শ্রম আইনে আছে, কারখানার পরিবেশ স্বাস্থ্যকর ও মানবিক হতে হবে। দৈহিক নির্যাতন, গালিগালাজ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা যেন সেখানে না থাকে। শ্রম আইন লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিধানও রয়েছে। বাংলাদেশে শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে এই আইন অনুসরণ করা শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে। তিনি ১৯৭২ সালের ১ মে’র ভাষণে বলেছিলেন, সম্পদের মালিক জনগণ। তাই কোনো শ্রেণিবিশেষের ভোগ-লালসার জন্য এবং লোভ চরিতার্থ করার নিমিত্তে- সম্পদকে অপচয় করতে দেয়া হবে না। তার লক্ষ্য ছিল সামাজিক বৈষম্য দূর করা। দেশের সমুদয় উৎপাদিত ও প্রাকৃতিক সম্পদ যেহেতু কৃষক-শ্রমিক ও সর্বশ্রেণির মানুষের সেজন্য দারিদ্র্যপীড়িত ও দুঃখী মানুষকে দেশের উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সাল থেকেই সুদসহ কৃষকদের সমস্ত বকেয়া খাজনা ও ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির কর চিরদিনের জন্য বিলোপ করা হয়। লবণ উৎপাদককে আবগারি শুল্ক দিতে হবে না বলে জানানো হয়। নির্যাতনমূলক ইজারাদারি বিলুপ্ত করা হয়। সমবায়ের মাধ্যমে ৪ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু ১ মে’র ভাষণে আরো জানান, বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অতীতে কতিপয় সুবিধাভোগী দেশের সমুদয় সম্পদের সিংহভাগ ভোগ করত। বর্তমান ব্যবস্থার চূড়ান্ত পর্যায়ে কৃষক, শ্রমিক, দরিদ্র ও বঞ্চিত লোকরা উপকৃত হবেন। বঙ্গবন্ধু মহান দিবসে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শ্রমিকদের বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হলে তাদের বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ হবে। পুঁজিপতি প্রভুদের ভোগের জন্য শ্রমজীবীরা সম্পদ উৎপাদন করবে না বরং সব মানুষের মঙ্গলে লাগবে যা তাতেই তারা নিবেদিত থাকবে। এ কারণে শ্রমিকরা সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করবে। আর সমাজতন্ত্রের শত্রুদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষত পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অতীতে শ্রমিকরা যে ভূমিকা পালন করেছে, সে দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের আমূল পরিবর্তন আনা জরুরি। তাদের অবশ্যই উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে এবং সম্পদকে রক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে শিল্পোৎপাদনের সুফল সমাজের সব শ্রেণির মানুষ বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ চাষিদের ভোগ করতে দিতে হবে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু চেয়েছেন শ্রমিকরা যাতে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। সেজন্য শিল্প-কারখানা পরিচালনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে একটি স্কিম প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। তিনি মনে করতেন, নতুন ভূমিকা পালনের জন্য শ্রমিকদের যেমন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হচ্ছে, তেমনি সরকারি প্রশাসনযন্ত্রকে নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার। বঙ্গবন্ধু মহান মে দিবসে বাংলাদেশের জনগণের জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন তার পূর্ণ বিবরণ পেশ করেন। সেই বিবরণে সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে স্থায়ী, অস্থায়ী, বদলি ও চা বাগানের শ্রমিকদের সাময়িক সহায়তা মঞ্জুর করার কথা জানান। তবে তিনি স্বাধীনতার পর ভঙ্গুর অর্থনীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সবার সাহায্য কামনা করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনে জনগণের প্রতি তার অঙ্গীকারের কথাও তিনি সেদিন প্রকাশ করেন এবং বলেন- ‘আজকের এই দিবসে আসুন আমরা এই শপথ গ্রহণ করি যে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য আমরা অবিরাম সংগ্রাম করে যাব। এ দেশের চাষি, তাঁতি, কামার, কুমার, শ্রমিক ও মজলুম জনতার জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা কাজ করব।... এই বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্য জনগণের সাহায্য ও সহযোগিতা নিয়ে আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করব।... সমৃদ্ধির পথে কোন সংক্ষিপ্ত রাস্তা আমার নেই। শতাব্দীর শোষণের পুঞ্জীভূত সমস্যা আমাদের সামনে জড়ো হয়ে রয়েছে। এগুলো সমাধানের উদ্দেশ্যে কঠোর পরিশ্রম ও আরো আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তাহলেই আমরা আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার ভিত্তি গড়ে যেতে পারব।’ আজ ২০২১ সালের করোনা ভাইরাসের মহামারির আতঙ্কের মধ্যে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুর ১ মে’র ভাষণ থেকে শিক্ষা নেয়ার আছে অনেক কিছু। তিনি সোনার বাংলা গড়ার জন্য আত্মত্যাগ ও কঠোর পরিশ্রমের কথা বলেছিলেন- বর্তমান পরিস্থিতিতে তার পথই অনুসরণ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে।

ড. মিল্টন বিশ্বাস : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App