×

সাময়িকী

প্রিয় মানুষ, সুস্থ হয়ে উঠুন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২১, ১২:০৬ এএম

প্রিয় মানুষ, সুস্থ হয়ে উঠুন
শাহমুব জুয়েল প্রবহমান জীবন ও অন্দর মহলের অনুষঙ্গ নির্মাতা বুলবুল চৌধুরী। মন ও মননে তিনি আপসহীন শিল্পী। সত্তর দশকে ‘টুকা কাহিনী’ গল্প দিয়ে সাহিত্যশিল্পে প্রবেশ করেন। নগর জীবনের সাথে গ্রাম বাংলার চিত্রকে বৈষয়িক করে উপস্থাপন করেছেন তিনি। চিন্তনে ও বয়ানে স্বকীয় ধারার পাশাপাশি আদর্শ ও চিত্রকলা প্রদর্শনে ছিলেন ভিন্নধারার মানুষ। সাহিত্য সাধারণত অনুষঙ্গনির্ভর। তার সাহিত্য সৃজনে সত্য ও বাস্তবতায় নির্মিত। সত্য ঘটনাকে কল্পনা ও রহস্যে মিশ্রিত করে উপস্থাপন করেন তিনি। সাহিত্যে সমকালীন বিষয়- ঘটনা প্রবাহের সাথে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের রেখাপাত বহুকালের। সেসব বিষয়ের সাথে প্রাচীন কাহন। মানব মানবীর প্রেম ও জীবন-জীবিকা কথাসাহিত্যে চিরায়ত সৌন্দর্য পেয়েছে। শিল্পীসত্তা না থাকলে তা সম্ভব ছিলো না। তিনি যথার্থ শিল্পী। কথাসাহিত্যের পরতে পরতে জীবনে দেখা, কল্পনা ও রহস্যের মেলবন্ধন করেছেন। বুননশিল্পের সাথে জীবন ও জীবন দর্শন এবং জীবনবোধের চিত্রায়ণও শিল্পসফল। সৃজনকর্মের মধ্যে গল্পই প্রধান। সদ্য স্বাধীন দেশে কবিতার প্রবাহ। তিনি কবিদের সান্নিধ্য পেয়েও গল্পের বুননে মনোনিবেশ করেন। উন্মুক্ত চিন্তাশক্তিতে অপরূপ গল্প চয়ন করেন। ঘোরের মধ্য থেকে বিচিত্র বাস্তব অভিজ্ঞতাকে ধারণ করে নতুন শিল্পের কারুকাজ  তৈরি করেন। তার সাড়া জাগানো প্রথম গল্প টুকা কাহিনী। কথাসাহিত্যে তিনি পারঙ্গম শিল্পী। বাস্তব কাহিনীবিন্যাসকে গল্পের অনুষঙ্গে তৈরি করা তার নেশা। দিগন্তমুখী ঘুরে বেড়ানো স্বভাবজাত শিল্পী তিনি। পুরান ঢাকার অলিগলি, বিউটি বোডিং ছিল আড্ডাস্থল। কবিদের সাথে থেকেও তিনি কবিতার রাজ্যে না ঢুকে গদ্যশিল্পের আশ্রয় লাভ করেন। স্বচক্ষে দেখে এবং উপলব্ধি করে ভাষারীতির সতর্কতা ও প্রযত্নে শিল্পিত লাবণ্যে সাবলীলভঙ্গিতে সাহিত্যচর্চা করেন। জীবনের অনুষঙ্গকে সরসতা ও প্রাণবন্ত গদ্যশিল্পের আদলে তুলেও ধরেন। তাতে তার গদ্যশিল্পকে দিয়েছে লক্ষ্যভেদী মাধুর্য ও প্রখর সৃষ্টিসুন্দর স্থিতি। লেখকদের ভাষারীতি জরিপ করলে দেখা যাবেÑ অধিকাংশ লেখকের ভাষা ও ঘটনার উৎস চলমান জীবন সংকট। যা লেখকের চারপাশের সমস্যা-সংকট এবং বিষয়বস্তুকে সৃজনী কায়দায় লিপিবদ্ধ করতে সাহায্য করে। গল্পের ভুবনে তার নিপুণ শিল্পকৌশলতা রয়েছে। বলাবাহুল, মেদহীন শিল্পের বুননই তার সৃষ্টিসফলতা। গভীরতর ভাবপ্রকাশ ও বাকভঙ্গি দেখলে তিয়াস জাগে। বারবার পড়তে আগ্রহ তৈরি হয়। লেখকের অন্তর্গত জীবনের রাশ থাকা স্বাভাবিক। তার গল্পেও তা বিদ্যমান। তিনি নাট্যশিল্প ও গায়েনশিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। নাট্যশিল্পে প্রধান হলো- নায়ক-নায়কী শরীরীশিল্প। যা দর্শক মনকে দোলায়িত করে এবং সাজসজ্জা দেখে অভিভূত হয় নিজেকে বেশভূষায় নিতে সচেষ্ট করে। নায়ক নায়িকা যেমন তাদের সংলাপ ও শরীরীভঙ্গি প্রদর্শনে দর্শককে আকৃষ্ট করে। তেমনি তারা কখনো কখনো নিজেরাও মজে যায়। তাই নিজেরা বাস্তবপ্রেমে প্রবেশ করে। ইলিয়াস মোল্লা ও আফিয়া চরিত্রে তা দৃশ্যমান। গভীর যতনের প্রকাশ দেখা মেলে ‘ভুল-বেভুলের খেলা’ গল্পে। তিনি চিকন, ফরসা বরণ এবং দীর্ঘ চুলের অধিকারী পুরুষ। গল্পের ইলিয়াস মোল্লাও তেমনি গঠনের। ইলিয়াস মোল্লা ও আফিয়া গল্পের প্রধান চরিত্র। নারী সৌন্দযের প্রধান হলো কেশ। ইলিয়াস মোল্লা আফিয়ার দীঘল চুল দেখে তাকে বউ করেছিল। সে বশ হয়েছে। আফিয়ার উক্তিÑ ‘ইস! মাইয়ালোকের চুলে আপনের যে কত্ত নেশা!’ বর্ণনা এ রকমÑ ‘ওর আছে কোমর ছাপিয়ে হাঁটু ছুঁইছুঁই ঠেক নেওয়া ঘন কালো দীঘল কেশ। এতে পুরুষের চোখ যেমন আটকে যেতে বাধ্য, মেয়েরাও কম কী তেমন ফিরে ফিরে চায়! গত রাতের বাসরশয্যায় ঢুকে স্বামীও কিন্তু ওই চুলে প্রথমেই নিজের মুখ ঘষে নিয়েছিল।’ গল্পে বিলাসী জীবন ভাবনার পাশাপাশি পতিতাবৃত্তি থেকে মুক্তির বয়ানও লক্ষণীয়। আফিয়া নাট্যকর্মী কিন্তু জীবনের বাঁকে নানান সময়ে সে খেলনা হয়েছে। জীবনভোগের বিষয়টি টের পাওয়া যায়। মেকাপম্যান ইলিয়াস মোল্লার সাথে সংসার পাতানোর সময়। তাকে জামাই হিসেবে পেয়ে আফিয়ার পরিবার উদ্বেলিত। রূপের জোরে এমন স্বামী বশ করেছে। সমাজ নারীর সম্ভ্রমকে নিখুঁত বিশ্লেষণ করে। আফিয়ার চরিত্র সম্পর্কে সবাই জ্ঞাত। সন্তানের খবর মা টের পাওয়ার কথা। সবাই জানে তবুও বিয়ের পর চেপে যাওয়া ইঙ্গিত দৃশ্যমান আফিয়ার মায়ের মধ্যে। সাহিত্য কালকে ছাপিয়ে করে তা দৃশ্যমান হয় সম্প্রতি মামুনুল হক রিসোর্ট কাণ্ডকেও ছুঁয়েছে। জীবন হলো নাট্যমঞ্চ। বাস্তব জীবনেও নাটকের মহড়া চলে। চলার পথে মানুষের বাহন সংলাপ। প্রচলিত কথাও আছেÑ ‘মুখের জোর থাকলে কত কী করে’ অভিনয় দক্ষতা যার যত বেশি সে ততবেশি সফল এবং জনপ্রিয়। অভিনয় দক্ষতা থাকা গুণও বটে। গুণের মাধ্যমে চাহিদামতো বশ করে নিজের আখের মেটানো সহজ এবং সম্ভব। নাম বদল করে শিল্পাঙ্গনে আত্মপ্রতিষ্ঠা হওয়ার দৃষ্টান্ত অনেক। বাজারে ট্রেন্ড শ্যামা সঙ্গীতের। শ্যামা সঙ্গীত গেয়ে সবাই বিখ্যাত হচ্ছে। স্রোতে গা ভাসাতে গিয়ে অনেক মুসলিম শিল্পীও হিন্দু নাম ধারণ করে। মুনশী মোহাম্মদ কাসেম ‘মল্লিক’, তালাত মাহমুদ ‘তপন কুমার’ নামে আখ্যায়িত হয়েছেন। মুসলিম শিল্পীরা শ্যামা সঙ্গীত গাইতে নাম পরিবর্তন করে হিন্দু নাম রাখে। এবার হিন্দু শিল্পীরা ইসলামি সঙ্গীত গাবার জন্য মুসলিম নাম রাখে। ধীরেন দাস-গণি মিয়া, চিত্ত রায়-দেলোয়ার হোসেন, গিরিন চক্রবর্তী- সোনা মিয়া, হরিমতি-সাকিনা বেগম, সীতা দেবী-দুলি বিবি, ঊষারানী-রওশন আরা বেগম। ‘ভুল-বেভুলের খেলা’ গল্পে ওয়ারেস মোল্লা বাংলা ফিল্মের আর্টিস্ট ছিলেন। হিন্দু আর্টিস্টরা মুসলিম নাম শুনলে নাক চিটকাতো তাই তিনি তার নামকরণ করেন বিশু দাস। এভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। গ্রামবাংলার মেঠোপথ এবং মানুষের জীবন-জীবিকার চিত্রকর তিনি। ‘টুকা কাহিনী’ গল্পে গুইচ্চা, বক, ঘুঘু, পেঙ্গাপেঙ্গি, এসেছে। গ্রামের মানুষ টোঁটা হাতে মাছ শিকারে চষে বেড়ায়। মাছ গল্পে গ্রামবাংলার জল ও স্থলের চিত্র আকর্ষণীয়। রাতে গভীর বিছানা ছেড়ে মাছ সন্ধানে ইদ্রিসের যাত্রা ও সিরাজের সঙ্গলাভ গল্পকে গ্রামীণ আবহের দৃশ্যে সমর্পণ করেছে। প্রজননই সৃষ্টি সুখ। পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে প্রাকৃতিক নিয়মেই প্রজনন হচ্ছে। প্রাণীর প্রজননে এক ধরণের কামনা ও কাতরতা রয়েছে। প্রাণীর দ্বৈত মেলামেশা ও স্রোতসঙ্গমে সৃষ্টি হয় প্রাণীর। সৃষ্টিগত নিয়মকে অস্বীকার করার সামর্থ্য কারো নেই। নিরবধিকাল তা প্রবহমান। গল্পকারের প্রজনন সৃষ্টিসুন্দর এবং আতিথেয়তার বিবরণ মেলে তার নিরবধিকাল গল্পের বয়ানে। স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন ও সন্তানসম্ভবনার ইঙ্গিত রয়েছে চন্দ্রবানু চরিত্রে। বিবাহের পর পড়শীদের মুখে সুখ শান্তি নিয়ে নানান গুঞ্জন থাকে। ঠাট্টা সম্পর্কীয়রা টিপ্পনী কাটে। চন্দ্রবানু স্বামীর সোহাগে তৃপ্ত কিন্তু সন্তান ধারণে বেদনায় কাতর তাই সইয়কে সে বিষয়ে সাবধান করে। সই আয়শার বিয়ে হয়নি চন্দ্রবানুর বিয়ে ও ভালোবাসা সম্পর্কে মনে নানান কৌতূহল রয়েছে। তার পেটে দশ মাসের বাচ্চা। আয়শা তার কথা মতো যে কোনো পুরুষ থেকে দূরে থাকবে। প্রেমিক জমিরের থেকেও দূরে থাকার ইচ্ছা পোষণ করে। কিন্তু প্রেম মানে মায়া। কাছে টানে তাই ভালোবাসাই শেষ কথা নয়। অন্ধকার নেমে আসে, জমির কড়ুইতলায় অপেক্ষা করছে। ভয় নিয়ে আয়শা জমিরের মুখোমুখি হয়। সেখানে জমিরের কামনার দৃশ্য এ রকমÑ ‘মানুষটা বেপরোয়া। কোনোদিন তা এমন হয়নি। ও অণুনয় জানায়, অহন যাইতে দেও। মইরা যামু, আতডা এমনে ধরেনি? জবর লাগে গো, উহ...। কাঠঠোকরা অন্ধকারে গাছ ঠোকে না। অথচ সবদিকেই কাঠ ঠুক ঠুক শব্দ হয় জমির আরও জটিল বাঁধন দেয় ওকে। তোমার দুইডা পায়ে ধরি ছাইড়া দেও। মাগো, তুমি বুঝ না কেরে সই কইছিল, সই না।’ বৃদ্ধ বয়সে জীবনের ভার সন্তানের ওপর। দাপিয়ে বেড়ানো মানুষও বয়সের ভারে নতজানু। সন্তানের সেবা ও যত্নে তাদের দিন কাটে। রাতদিন তাদের কাছে এক। আইনুল ও মাইনুলের বাবা বৃদ্ধ। জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তাদের বাবা। তার মৃত্যু অবধারিত। আপনজন মারা গেলে পাড়াপড়শীরা এগিয়ে আসে এবং স্মৃতি আওড়ায়। সংসারে কর্তার মৃত্যুর পর একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙন সৃষ্টি হয়। সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে প্রচলিত কথা হলেও নারীর কারণে ভাতৃত্বের বন্ধন বিনষ্ট এবং সংসারে ভাঙন ধরে। স্ত্রীদের কারণে চিরচেনা সাংসারিক বন্ধনে ভাটা পড়ে। ‘নান্দিবিনাশ’ গল্পে সংসারযাত্রার নানা সমস্যা ও উত্তরণের চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। মায়া বড়ই অদ্ভুত। মনের সাথে মনের সাঁকো তৈরি হয়। মন দিয়ে মনের আকুতি উপলব্ধি করা যায়। কখন কোথায় স্বপ্নরা মুড়ি দিয়ে মোহবন্ধনের ডাক দেয়। কেউ আগে থেকে জানে না। মানুষ প্রকৃতির প্রধান সম্পদ। মায়ার কারসাজি মানবের মাঝে তৈরি হয়। প্রকৃতির বদলের সাথে মানুষও বদলে যায়। শিরাবিন্দুতে অনুভূতি শিরশির করে। জোনকির আলো গল্পে জিনাতের সাথে জাহিদের মনোজাগতিক অনুভূতি সূক্ষ্মভাবে ধরা দেয়। বাসা থেকে তা তৈরি হয়। পরিবারে অন্য মানুষ কীভাবে মায়ায় বন্দি হয়। গল্পকার জোনাকির প্রবেশ এবং মীনা জেগে থাকলে ধরত। সে দৃশ্যের মধ্য দিয়ে তিনি আরেক মায়াকে দেখালেন। তা হলো জাহিদের প্রতি জিনাতের মায়া। জাহিদের প্রস্থান জিনাত মেনে নিতে অপারগ। জিনাতের চুলের অরণ্যে হাবুডুবু খেয়েছিল জাহিদ। মনে একমুঠো প্রেম জমা হয়েছিল। মনের আকাশে উড়ছিল তার চুল। সে তাতে সাঁতার কাটছিল। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে জাহিদ বাসা ত্যাগ করছে। জোনাকির মতো জিনাতের জীবনে জাহিদ এসেছিল। জোনাকির মতো মানুষের মায়াও কী ক্ষণস্থায়ী? দুটি জীবন চক্রের মননে দু’ধরনের মানসিকতা। তীক্ষè দৃষ্টি দিয়ে তা উপলব্ধি করে প্রকাশ করেছেন। ভক্তদের মাঝেও নানান রূপবৈচিত্র্য রয়েছে। বাৎসরিক উরস হলে দেশ-বিদেশ থেকে ভক্তরা ভিড় করে। মনের আশা পূরণের লক্ষ্যে প্রার্থনা করে। রোকেয়া মনের মানুষের খোঁজে আসে। চারদিকে শামিয়ানা টানানো। মাটির খেলনা, ভাজাপোড়া, তৈসজের দোকানে পরিপূর্ণ থাকে। অন্তরালে গাঁজাখোরের আড্ডাও রয়েছে। উন্মাতাল ভক্তের মাঝে ভক্তিরস সঞ্চার ঘটে। তাদের মুখে শোনা যায়- ‘আইছি লেংটা যামু লেংটা মাঝখানে ক্যান গণ্ডগোল...’ কথক চরিত্রও সেলিম খানের সঙ্গি তার মাঝেও মনখেলা দেখা দেয়। নাচের ইচ্ছা প্রকাশ করে। ভক্তিপ্রেমের খেলার মাঝে গুরু বাবার যুবতি শিষ্যের নাচ কথককে ভাবায়। ধর্মচর্চার পাশাপাশি নষ্টামিও রয়েছে পীরালী পাড়ায়। তা গল্পকার গাঁজাখোরের বর্ণনা, যুবতিদের নিয়ে পীরের হস্টিনস্টি, ছায়রার খদ্দেরের খোঁজ বহু বিষয় তিনি কাহিনীর ভেতরে বর্ণনা করেছেন। ভণ্ড পীরবাদের চালচরিত্র কাহিনীকে গতিসঞ্চার করেছে। পাঠক হৃদয়ে বাস্তব ধর্মচর্চা ও আত্মস্বীকৃতি স্বরূপ ফুটে উঠেছে। মানবপ্রেমের পাশাপাশি সচেনতার ইঙ্গিতও সুস্পষ্ট। গল্পকারের লক্ষ্য ছিল বাস্তবতাকে জানান দিয়ে জীবন ও সাধনতত্ত্বের মৌলিক চিন্তার জগৎ অনুসন্ধান করা। তাতে তৈরি হতে পারে মানবিক জগৎ ও মহৎপ্রেম। জীবনযাপনে সঙ্গী নির্ভরতার মানুষ। আরববিশ্বে একাধিক সঙ্গী এবং প্রাচ্যত্বে চুক্তিসঙ্গীর প্রচলন থাকলেও বাঙালি সমাজ ও সংসারে একাধিক সঙ্গী লাভকে ভালো চোখে দেখা হয় না। সামাজিক কাঠামো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। সঙ্গীর সাথে আজীবন ভ্রমণে দুয়ের চিন্তা-চেতনার জগৎ এক ও অভিন্ন। গণতান্ত্রিক অধিকার কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবতার রেশ ক্ষীণ। বাঙালি সমাজে তালাক বা সঙ্গীর মৃত্যুতে নিঃসঙ্গতা নেমে আসে। তাতে নতুন জীবনের স্বপ্ন বোনা শুরু হয়। প্রথম সংসারে সন্তান থাকলেও অনেকেই ভোগে সিদ্ধান্তহীনতায়। সন্তানের মায়ায় কাতর। জীবন তো একটাই, তাই পাড়াপড়শীর ঠোকরে দ্বিতীয় সঙ্গী লাভের দৃশ্য চোখে পড়ে। দ্বিতীয় বাসর গল্পে গালিব ও ঝোরার দ্বিতীয় জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত বাঙালি সমাজনীতির কথা পেশ করে। গালিবের আগের সংসারের ছেলে কুশল। তার মায়া তাকে আচ্ছন্ন করে। তাই সৎমায়ের চিন্তা মাথায় আনেনি কিন্তু বোন পাপিয়ার কড়াবচনে রাজি হয়েছিল। দ্বিতীয় বাসরের প্রথমরাতে কুশলের বিছানা আলাদা করার সিদ্ধান্ত স্বামী-স্ত্রী দুজনকে ভাবিয়ে তোলে। বাঙালি সংস্কৃতিতে সৎমা কর্তৃক সন্তান নিপীড়নের চিত্র অহরহ। গল্পকার সঙ্গী যাপনের সাথে মায়া কীভাবে মায়াকে বিচ্ছিন্ন করে তা দেখানো চেষ্টা করেছেন। বয়স ও শারীরিক বিষয়টিও বাদ পড়েনি। বাংলার গ্রামীণ নিম্নবর্গের জীবনযাত্রায় সমাধান সূত্র অন্বেষণ করেছেন এভাবেÑ ‘স্ত্রী আলাপে গালিব ভাবে নিজের ভালোবাসা ছিল মিলার জন্য। তবে আজ যেন সেই প্রেম ঝোরার জন্যে নবরূপে প্রথম প্রেম হয়েই দেখা দিল। তারই পরশে ঝোরাকে পলকের টানে নিজের বুকে টেনে আনে গালিব। পরমুহূর্তে স্ত্রীর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট রাখতেই উত্তাপ যেমন পারস্পরিক স্পন্দন তেমনেরও বেশি গড়ায়।’ দ্বিতীয় বাসর বেশি গড়ায়। মৃত্যুর স্বাদগ্রহণ হলো চিরন্তন ভাষ্য। জীবনের তেতো বা মিষ্ট অভিজ্ঞতার পর মৃত্যু ধেয়ে আসে। শতচেষ্টা ও আগলানোর মাধ্যম তৈরি হলেও রক্ষা পায়নি। যথানিয়মে হাতছানি দিয়ে আত্মাকে বিদায় করেছে। শারীরিক সৌন্দর্য ও ভালোবাসা, দৌরাত্ম্য ও সুখজীবন থেমে গেছে বা হেরে গেছে মৃত্যুভারে। পূর্বাভাস কারো জানা নেই, সিরিয়ালও নির্ধারিত নয়। আগে বা পরে চলে গেছে মেহনতি আত্মা। কীর্তি ছুঁয়েছে আকাশ ও জমিন। গল্পকার মৃত্যু সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। হাসপাতালের প্রকোষ্টে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। ভাবতেই শিউরে উঠে শরীর। গল্পের জগৎ ও অবয়বে দাপিয়ে বেড়ানো মানুষটি মৃত্যুরোগ ক্যান্সারের সাথে বসবাস করছেন। ক্ষীণ হয়ে গেছে তার শরীর। প্রিয়জনের চোখে জল টলমল করছে। যিনি মৃত্যুকে জীবন অস্তিত্ববোধে বহিঃসৌধ নির্মাণে অতন্দ্র প্রহরী ছিলেন। স্বাভাবিক স্বরে প্রস্থান তাকেও আলিঙ্গন করছে। গল্পকার হয়তো ভেবেছেন- মৃত্যুনিয়ম, পৃথিবীর সৃষ্টিসন্ধ্যা সম্মুখে উপস্থিত। সুখ ও শখের ঘোড়া রুগ্্ণ হয়ে পরিণতি হলো মৃত্যু। তার লেখা গল্প মৃত্যু। মৃত্যু গল্পে প্রিয়জন এবং মায়ের মৃত্যুর ইঙ্গিত ছিল স্পষ্টতর। জীবনাচরণের মহামণ্ডল তাহলে মৃত্যু। তাই চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে গল্পের বয়ানেও মৃত্যু বা গভীর ঘুমের কথাসাহিত্যের ঢঙে উপস্থাপন করেছেন। তিনি তাহলে অনুমান করেছেন পৃথিবী বিদায়ের অশ্রুসজল কথাÑ ‘কদিন ইবা বেঁচে আছি! আচ্ছা আমি কি বাবার মতো ভাত খেতে খেতে একদিন হঠাৎ চলে যাব পরপারে? অথবা এক ভোরে নিনা, ওরা দেখবে শীতল হয়ে পড়ে আছি বিছানায়? নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেই জানি না কীভাবে ঘটবে এসব কত নাজুক অবস্থাতেইবা ঘটবে।’ (মৃত্যু) সফল এবং বিফলের অঙ্ককষা প্লাটফর্ম হলো সাহিত্য। মানবজীবন ও যাপনের বন্ধন, প্রকৃতি সমস্যা সংকট, আন্দোলন সংগ্রাম, গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রা, বুলবুল চৌধুরীর গল্পে প্রতিভাত হয়েছে। নগ্ন সমাজ ও নিম্নবর্গের যাপনের অনুষঙ্গ গল্প ছকে মুড়িয়ে মুড়িয়ে এসেছে। তিনি বাস্তবতার মিশেলে কাল্পনিকতার মিশ্রণে লোক বিশ্বাস ও লোক সংস্কৃতিকে প্রচলিত স্রোতের বিপরীতে স্বতন্ত্র ঢেউ সৃষ্টি করেন। মনে হচ্ছে মাটি ও মমতায় ঘেরা তার চরিত্রায়ণ এবং অনুষঙ্গের শিল্পভঙ্গি। সমকালীন সাহিত্য ফিসফাস ও তৈলমর্দন থাকলেও তিনি তা থেকে বহুদূরে। মানুষটার জীবনাচরণেও শিল্পসত্তা বিরাজমান। সাদামাটা জীবনই তা প্রমাণ করে। দেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ, ভঙুর মানুষের জীবন বঞ্চনার ছবি এঁকেছেন দক্ষতার সঙ্গে। জীবনাভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তিনি সময়ের সফলতম শিল্পী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App