×

সাময়িকী

পারমিতার জগৎ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২১, ১২:০৭ এএম

ফরিদ আহমদ দুলাল খেয়াল করে দেখি রিক্সা ততক্ষণে হোস্টেলের গেট পেরিয়ে গেছে। বললাম, “একটু ব্যাক করে গেটে দাঁড়াও ভাই।” ব্যাগপত্র রাখতে গিয়ে দেখি রুমে তালা দেয়া। তালা বদলে গেছে, আমার কাছে যে চাবি আছে, তাতে তো কাজ হবে না। পাশের রুমে লাগেজ রেখে কলেজে গেলাম। বন্ধুদের কেউ কেউ আমায় দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। পারভিনকে পাওয়া গেল না; ও না-কি আজ ক্লাসে আসেনি। কোথায় গেছে কেউ জানে না। প্রশ্ন করলাম, “বাড়ি যায়নি তো?” হোস্টেলে আমাদের পাশের রুমে থাকে দিলতাজ, নান্দাইলের মেয়ে, বললো, “আজ সকালেও তো দেখা হলো, বাড়ি যাবার কথা তো কিছু বলেনি? তবে পারভিনের মনটা খুব খারাপ দেখলাম। ভাবলাম ক্লাসে আসবে, আসলো না।” আমি একটু চিন্তায় পড়লাম। দিলতাজ প্রশ্ন করলো, “কেনো কিছু হয়েছে না-কি?” বললাম, “না তেমন কিছু না। তা ছাড়া আমি কী করে বলবো কী হয়েছে; আমি তো এই এলাম বিশদিন পর। আমাদের রুমের তালাটা দেখলাম বদলে ফেলেছে। আমি রুমে ঢুকতে পারলাম না।” দিলতাজ বললো, “হ্যাঁ, ওর চাবিটা খোয়া গেছে, তাই নতুন তালা কিনে লাগিয়েছে। তুই আমার সাথে চল। আপাতত আমার রুমে থাক, ও নিশ্চয়ই এসে যাবে। আজ আর ক্লাস নেই, আমি রুমেই যাবো।” বললাম, “ঠিক আছে তুই এগো, আমি একটু হাসপাতাল হয়ে আসছি।” দিলতাজ ঠোঁটে রহস্যের হাসি মেখে বললো, “হাসপাতালে কেনো? তোর রুগী তো রিলিজ নিয়ে চলে গেছে। তুই বরং একবার অফিসে গিয়ে দেখা করে আয়। তোর নামে মনে হয় চিঠি তৈরি হয়ে গেছে।” দিলতাজের কথায় আমার বুকে যুগল বজ্রপাত হলো একসাথে। পা দু’টি যেন অসার হয়ে গেল, মাথা টলছে তখন। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “ঠিক আছে তুই হোস্টেলে যা, আমি অফিস হয়ে আসছি।” দিলতাজ হোস্টেলের দিকে পা বাড়ালো, আমি অফিসের দিকে হাঁটলাম। অফিসে গিয়ে জানলাম, আমার নামে শোকজ নোটিশ ইস্যু হয়ে গেছে। চিঠিটা চাইলাম, পাওয়া গেল না, বললো, “গার্ডিয়ান লাগবে!” ওরে বাবা! এতো কড়াকড়ি! সবুজ নেই হাসপাতালে শুনলাম, তারপরও একবার নিউ কেবিনের দিকে গেলাম। ভাবলাম, আমার কেয়ারঅবে সবুজের জন্য কেবিন নিয়েছিলাম, আমার এ্যাবসেন্সে রিলিজ নিয়ে গেলো, কোনো সমস্যা হলো কি-না খোঁজ নেয়া দরকার। মনে মনে কিছুটা লজ্জিতও হচ্ছিলাম সবুজের পরিবারের কাছে, কী ভাববে ওরা আমাকে? খোঁজ নিয়ে জানলাম, সমস্যা একটু হয়েছিলো বটে, পারভিন ম্যানেজ করেছে সব। মনে মনে পারভিনের প্রতি কৃতজ্ঞ হলাম। সবুজকে ও ওর আত্মীয় বলেছে, আমার নাম কেটে ওর নাম বসানো হয়েছে। অফিস থেকে বেরুতেই মাথায় একটা প্রশ্ন উঁকি দিলো, কেনো? আমার নাম কেটে ওর নাম কেনো বসাতে হলো। আমি অনুপস্থিত থাকলেই আমার মানুষ ওর হয়ে যাবে? মুহূর্তের মধ্যে মনটা বিগড়ে গেলো পারভিনের উপর; আমার কবিকে কেনো সে ওর করে নেবে? মাথায় যেনো রক্ত উঠে গেলো। হাতের কাছে পেলে ওকে চুলের মুঠি ধরে জিজ্ঞাসা করতাম, কেনো তুই আমার কবিকে নিয়ে টানাটানি করছিস? তুই না আমার বন্ধু! এই কি তোর বন্ধুত্ব? দ্রুত পা বাড়ালাম হোস্টেলের দিকে।   হোস্টেলে গিয়ে দেখলাম, পারভিন ফিরে আসেনি। অগত্যা দিলতাজের রুমে সাময়িক আশ্রয় নিলাম। সন্ধ্যায় দিলতাজ এসে জানালো, পারভিন এসেছে। আমি ব্যাগপত্র নিয়ে রুমে গেলাম। দরোজা বন্ধ। মৃদু ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। নিজের বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে পারভিন। দরোজার মৃদু আওয়াজে মুখ বের করলো চাদরের নিচ থেকে। ওকে দেখে চমকে উঠলাম আমি, “এ-কি চেহারা হয়েছে তোর!” এগিয়ে গেলাম ওর বিছানার কাছে। উঠে বসবার তাড়া নেই ওর। আমি বিছানায় বসে দু’হাতে ওকে টেনে বসালাম। “কী হয়েছে তোর?”” পারভিন কোনো কথা বললো না, দু-হাত বাড়িয়ে আমায় বুকে জড়িয়ে ধরলো, আর কান্নায় ভেঙে পড়লো। একটু আগেই যে আমি ওর উপর রেগে ছিলাম, কিছুই আর মনে থাকলো না। জড়াজড়ি করে দু’জন কাঁদলাম কিছুক্ষণ। কোন কথাই হলো না দু’জনার, তবুও দু’জন যেনো জেনে নিলাম দু’জনার ব্যথা। সত্যি কি আমরা দু’জন আবিষ্কার করেছিলাম দু’জনের যন্ত্রণা? রাতে খেতে বসে বুঝলাম, আমি মোটেই আবিষ্কার করিনি পারভিনের কষ্ট। খেতে খেতে হঠাৎ লক্ষ করলাম পারভিন ওর ওড়নার আঁচলে মুছে ফেলছে ওর গোপন অশ্রু। টের পেলাম আমি, কিন্তু ওকে বুঝতে দিলাম না কিছু। ঘরে ফিরে আমি ওর কাছে কলেজ-পড়াশোনা সম্পর্কে খোঁজ নিতে চাইলাম, পারভিন বললো, “আজ বড্ড মাথা ধরেছে। আমি শুয়ে পড়বো। কালকে কথা বলবো পড়ালেখা সম্পর্কে।” কিছুটা অবাক হলেও কিছু বললাম না। সত্যি পারভিন শুয়ে পড়লো। আমার খুব অস্থির লাগছিলো ওর আচরণে। আমি গায়ে একটা ওড়না জড়িয়ে ওর পাশে গিয়ে বসলাম। আমার উপস্থিতি টের পেয়েই পারভিন বললো, “কীরে ঘুমাবি না? জার্নি করে এলি শুয়ে পড়।” আমি কিছুই বললাম না। ওর একটা হাত নিয়ে ধীরে ধীরে আঙুলগুলো টানলাম, তারপর অন্য হাত, তারপর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, “আচ্ছা রে পারভিন, আমি আজ এতোদিন পর ফিরলাম। তোর জানতে ইচ্ছা হলো না, কী হয়েছিলো আমার? তোর কাছে আমি আমার কবিকে রেখে গেলাম; অতঃপর কী হলো, কবি কবে রিলিজ নিয়ে চলে গেলো? এসবের কিছুই জানালি না আমায়! তোর কি একবারও মনে হলো না, এসব সবই অস্বাভাবিক? আমার বাস্তবতা না জেনেই কি তুই আমার উপর রাগ করতে পারিস? অভিমান করতে পারিস? আমার কষ্টটা তুই একঠুও বুঝতে চাইবি না? এতোটা নির্দয় তো তুই ছিলি না আমার প্রতি! আমি তোকে বন্ধু বলেই বিশ্বাস করেছিলাম! আমার কবিকে তোর কাছে গচ্ছিত রেখে গিয়েছিলাম! তবুও তুই চুপ করেই থাকবি? কিছুই কি বলার নেই আমাকে তোর?” কথাগুলো বলতে বলতে আমার কণ্ঠ আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো, কখন নিজের অজান্তে দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিলো। পারভিন উঠে বসলো, হঠাৎ আমায় জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কাঁদতে শুরু করলো। অনেক্ষণ দু’জন কাঁদলাম দু’জনকে জড়িয়ে ধরে; একসময় আমিই কথা বললাম, “কী হয়েছে তোর? আমাকে খুলে বল! সারাক্ষণ কাঁদছিস কেনো?” পারভিন এবার যেনো কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললো, “সত্যি রে পারমিতা তুই খুবই ভালো একটা মেয়ে। তোর কবি তারচেয়েও অনেক ভালো। ও তোকে সত্যি অনেক ভালোবাসে। এতোগুলো দিন তুই নেই, আমি ওর সেবাযত্নে সামান্য ত্রুটি করিনি। বিশ্বাস কর, এ ক’দিনে কবি একটি বারের জন্য তোর কথা বলেনি। একবারও জানতে চায়নি তোর খবর; কিন্তু সে একমুহূর্তের জন্যেও তোকে ভুলে থাকে নি। আমি বুঝেছি কবির বুক জুড়ে ছড়িয়ে আছিস শুধু তুই।” পারভিনের কথা শুনতে আমার ভালোই লাগছিলো। মন চাইছিলো সারারাত ধরে ও কেবল সবুজের কথাই বলুক। তবু আমি বিষয়টি সহজ করতে মৃদু হেসে বললাম, “এতোদিনে যে একবারও আমার কথা জানতে চাইলো না, তবু তুই বুঝে গেলি, ওর বুক জুড়ে শুধু আমিই আছি?” এবার পারভিন কিছুটা সহজ হলো, “সব কথা কি মুখে বলে বোঝাতে হয়? কিছু না বলেও অনেক কথা বলা যায়; এ সত্যিটা আমার এতোদিন জানা ছিলো না, কবির সেবা করতে গিয়ে জানলাম নৈঃশব্দ্যের শক্তি। ওর প্রজ্ঞার কাছে আমি তো তুচ্ছ মানুষ। পৃথিবী-মানুষ-প্রকৃতি-জীবন সম্পর্কে কী গভীর জ্ঞান তার, আমি অবাক বিস্ময়ে এ ক’দিন তাই জানলাম।” হঠাৎ পারভিন আবার হু-হু করে কেঁদে উঠলো, “তুই আমায় ক্ষমা করে দে। আমি তোর দেয়া দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে পালন করতে পারিনি।” আবার ও আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলো। কলেজে গিয়েই বুঝলাম আমি দণ্ডিত হতে পারি। সবাই আমার হঠাৎ অনুপস্থিতি নিয়ে নানান প্রশ্ন করে আমায় অস্থির করে তুললো। প্রথম ঘণ্টার স্যার তো আমায় বলেই দিলেন, “তুমি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রী হবার যোগ্যতা হারিয়েছো! কাউকে কিছু না জানিয়ে এভাবে চলে যাওয়ার সুযোগ এখানে নেই!” আমি কোন উত্তর না দিয়ে নিশ্চুপ থাকার কৌশল অবলম্বন করলাম। দুপুর পর্যন্ত ক্লাস চললো। এনাটমির মির্জা স্যার আমায় খুবই স্নেহ করেন। তিনি বললেন, “ক্লাস শেষে আমার সাথে দেখা করবে।” আমি শুধু মাথা কাৎ করে সম্মতি জানালাম। ক্লাস শেষে পারভিনকে নিয়ে মির্জা স্যারের অফিসে গেলাম। পারভিন বাইরে অপেক্ষায় থাকলো।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App