×

মুক্তচিন্তা

কিছু মানুষ কেন ভাইরাসের পক্ষে?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২১, ১২:১২ এএম

আমরা এখন রীতিমতো একটা যুদ্ধে আছি। যুদ্ধটা মানুষ বনাম ভাইরাসের। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ প্রকৃতির নানান প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে প্রকৃতির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ বসবাসের ফর্মুলা তৈরি করার সক্ষমতার কারণে সৃষ্ট প্রাণিকুলের মধ্যে সবচেয়ে অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন জীব হিসেবে পৃথিবীতে টিকে আছে। ডারউইনের তত্ত্বানুযায়ী ‘যোগ্যরাই টিকে থাকে’। নানান ধরনের দুর্যোগ, মহামারি, সমস্যা, সংকটকে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করে মানুষ প্রাণিকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে এবং প্রাণ ও প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে মানুষ নিজেকে অভিযোজন করে একটা সুন্দর জীবন-যাপনের পদ্ধতি গড়ে নিয়েছে। মানুষ শত শত বছরের পরিশ্রমে অর্জন করেছে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর সাফল্য এবং প্রযুক্তির অভাবনীয় উৎকর্ষ, যা দিয়ে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের এবং সহবাসের ব্যাকরণ তৈরি করেছে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষ এখনো যুদ্ধে লিপ্ত এবং কোনোভাবেই তাকে বাগে আনা যাচ্ছে না। যে যুদ্ধে মানুষ এখন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বাংলাদেশের মানুষও ‘মানুষ বনাম ভাইরাসের যুদ্ধে’ মানুষের দলভুক্ত কিন্তু কেন কিছু মানুষ ভাইরাসের পক্ষে কাজ করছে, সেটা এক বিরাট বিস্ময়। এটা সন্দেহাতীতভাবে স্বীকার্য যে, আমরা একটা অত্যন্ত কঠিন সময় পার করছি। কেবল বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্ব করোনার সঙ্গে লড়ছে। ভাইরাস আর মানুষের এ লড়াই চলছে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে। কিন্তু এ লড়াইয়ে ভাইরাস এখনো ড্রাইভিং সিটে। ইউরোপ-আমেরিকাকে কাঁপিয়ে এখন দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া (বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশ) এবং লাতিন আমেরিকাতে (বিশেষ করে ব্রাজিলে)। বিশ্বব্যাপী করোনার প্রবল প্রতাপ আমরা বিগত এক বছরের বেশি সময় ধরে আতঙ্কের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছি। আমরা অনেক আত্মীয়, স্বজন, বন্ধু, পরিজনের মৃত্যু দেখেছি, করোনাক্রান্ত মানুষের অসহায় আত্মসমর্পণ দেখেছি কিংবা প্রবল যুদ্ধ করে করোনাকে পরাজিত করতেও দেখেছি। মানুষ এবং ভাইরাসের যুদ্ধে ইতোমধ্যে করোনা কেড়ে নিয়েছে প্রায় ৩১ লাখ মানুষের জীবন। বাংলাদেশেও সে সংখ্যা ইতোমধ্যে ১১ হাজার ছাড়িয়েছে। ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছেন। ভ্যাকসিনেশন শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অসংখ্য দেশে। কিন্তু করোনা যেন কাবু হতে চাচ্ছে না। নিত্য নিজের চরিত্র পরিবর্তন করে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাকে দুর্বল করে দেয়ার চেষ্টায় আছে এ ভাইরাস কিন্তু মানুষও হাল ছাড়বার পাত্র নন। ফাইজার, মডার্না, এস্ট্রোজেনেকা, জনসন এন্ড জনসন, সিনোফার্ম, স্পুটনিক-ভি প্রভৃতিসহ নানা ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে মানুষ করোনাকে বিজ্ঞান দিয়ে মোকাবিলা করে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছে। ফলে মানুষ আর ভাইরাসের যুদ্ধ চলছে। আরো কতদিন এ যুদ্ধ চলবে সেটা দেখার বিষয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, খোদ কিছু মানুষই ভাইরাস বনাম মানুষের যুদ্ধে ভাইরাসে পক্ষে কাজ করছে। মানুষ হয়ে ভাইরাসে পক্ষে কাজ করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেবল কয়েকটা সামান্য বিষয়ও মানুষ মানে না যেমনÑ নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরা, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া বা সেনিটাইজ করা, সামাজিক (শারীরিক) দূরত্ব বজায় রাখা বা জনসমাগম/ভিড় এড়িয়ে চলা প্রভৃতি। এতটুকু যথাযথভাবে না করার কারণে মানুষ বনাম ভাইরাসের যুদ্ধে কিছু মানুষ ভাইরাসের সহোদর হিসেবে কাজ করছে। এতে করে একদিকে যেমন মানুষের যুদ্ধ কঠিন হয়ে উঠছে, অন্যদিকে ভাইরাস টিকে থাকার ঠিকানা পেয়ে যাচ্ছে। ফলে মানুষের জীবন এখনো করোনা ভাইরাসের হুমকির মুখে। ভারতে দিন-রাত জ্বলছে শ্মশান। বাংলাদেশে কবর খুঁড়তে খুঁড়তে গোরখোদকরা কাহিল। ব্রাজিলে ক্রমে লম্বা হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ করোনা ভাইরাসের হাতে আত্মসমর্পণ করছে। তবুও কেন আমাদের বোধোদয় হয় না, সেটাই বড় প্রশ্ন। আমি আমার এ কলামে লিখেছিলাম, লকডাউনের একটা মর্মার্থ হচ্ছে, মানুষ যেহেতু করোনা ভাইরাসের বাহক, সেহেতু ভাইরাস বাহককে ‘লক’ করতে পারলে সংক্রমণ ‘ডাউন’ হবে। আর এটাই মূলত লকডাউনের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু মানুষকে কোনোভাবেই লক করা যাচ্ছে না। মার্চের শেষের দিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সংক্রমণের মাত্রা কমানোর জন্য সরকার মার্চের ২৯ তারিখ ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করে। কিন্তু কিছু মানুষ কিছুই মানে না। সংক্রমণের হারের ঊর্ধ্বগতি দেখে সরকার এপ্রিলের ৫ তারিখ থেকে লকডাউন ঘোষণা করে। সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়। বাংলা একাডেমির বইমেলা বন্ধ করে দেয়া হয়। আন্তঃজেলা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। জরুরি সেবা প্রদান ছাড়া প্রায় সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু তৈরি পোশাক কারখানা খোলা রাখার কারণে মানুষকে রাস্তায় নামতে হয়েছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকার কারণে রিকশা, ভ্যান, সিএনজি-স্কুটারসহ অন্য গাড়িগুলোকে রাস্তার রাজা হয়েছিল। এতেও সংক্রমণের মাত্রা না কমায় ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত সর্বাত্মক লকডাউনের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু কিছুতেই কাজ হয় না। মানুষ যেন ঘরে থাকতে চায়। কারণে-অকারণে বাইরে ঘোরাঘুরি একেবারেই বন্ধ হয় না। মাঝখান দিয়ে বিপণিবিতানসহ দোকানপাট খুলে দেয়ার দাবি উঠল এবং দোকানপাট খুলে দেয়া হলো। ফলে সর্বাত্মক কিংবা কঠোর লকডাউন আর সঠিকভাবে কাজ করল না। ফলে প্রথম দফা লকডাউনের পর সংক্রমণের হার কিছুটা কমলেও মৃত্যুর সংখ্যা এখনো আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছে। সার্বিক বিবেচনায়, ২৮ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত পুনরায় লকডাউন বলবৎ রাখা হয়। কিন্তু বিপণিবিতানগুলো খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হলো সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে রীতিমতো আহাজারি করা হচ্ছে কিন্তু কিছু মানুষ কানেই তুলছেন না। বিপণিবিতানগুলোতে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। রাস্তায় অসংখ্য গাড়ি আর অসংখ্য মানুষ। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী মানুষের যাতায়াত এবং বাইরে বের হওয়ার প্রবণতা কমানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রচুর পরিশ্রম করছে কিন্তু মানুষকে বাগে আনা যাচ্ছে না। ফলে মৃত্যুর সংখ্যা সমান্তরালে আছে। একদিন সামান্য কমলেও আবার বেড়ে যায়। সংক্রমণের হারও সামান্য কমলেও এখনো বিপদসীমার উপরে আছে। করোনা ভাইরাসকে আমরা কেন কাবু করতে পারছি না, তার অন্যতম একটি প্রধান কারণ হচ্ছে মানুষ বনাম ভাইরাসের যুদ্ধে কিছু মানুষ ভাইরাসের পক্ষে কাজ করছে। এটা বন্ধ না করলে সত্যিকার অর্থে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-জয় অত সহজ হবে না। এখান যে বিষয়টা জরুরি সেটা হচ্ছে, সমাজের শ্রমজীবী, নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন এবং নিঃস্ব মানুষ যখন জীবিকার সন্ধানে ঘরের বাইরে হন, তখন তাদের দোষ দেয়া যাবে না। কেননা যদি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না দেয়া হয়, তাহলে তারা করোনা ভাইরাস নয় এমনিই না খেয়ে মরে যাবে। তাই লকডাউন দিয়ে যদি একজন বিত্তহীন মানুষকে, দিনমজুরকে, শ্রমজীবী মানুষ আমরা লক করে রাখি তাহলে তার জীবিকা আসবে কোথা থেকে। জীবন এবং জীবিকার দ্বৈরথ নিম্নবিত্ত, শ্রমজীবী, নিঃস্ব এবং বিত্তহীন মানুষের নিত্য চলমান। তাই নিম্নবিত্তের মানুষ, সমাজের বিত্তহীন মানুষ কিংবা শ্রমজীবী মানুষ যদি জীবিকার তাগিদে লকডাউনের মধ্যেও লক ভেঙে ‘কিছু করে খাওয়া’র চিন্তা করে তাকে খুব ‘লক’ ভাঙার জন্য কোনোভাবেই দায়ী করা যাবে না। আবার লকডাউনের মধ্যেও তৈরি পোশাক কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত থাকায় পোশাক-শ্রমিকদের লক ভেঙে বেরোতে হয়েছে। ফলে জীবিকার সংস্থান যেখানে জীবনের চেয়ে বড় সেখানে লকডাউনের লক ভাঙার দায় তাদের দেয়া যাবে না। তাই লকডাউনকে সঠিকভাবে কার্যকর করতে হলে সমাজের বিত্তহীন, দরিদ্র, নিঃস্ব, দুস্থ এবং শ্রমজীবী মানুষের জীবিকার নিশ্চয়তা দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কেবল প্রজ্ঞাপন জারি করে সমাজের বিত্তহীন, দুস্থ এবং শ্রমজীবী মানুষকে লকডাউন মানতে বাধ্য করা যাবে না। কিন্তু শ্রমজীবী, দুস্থ এবং বিত্তহীন মানুষ ছাড়াও একটা বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী লকডাউনকে কোনো পাত্তা না দিয়ে ‘লক’ ভেঙে অযথা ঘোরাঘুরি করছেন, ‘লকডাউন কেমন’ তা দেখতে বের হচ্ছেন, যেখানে-সেখানে আড্ডা দিচ্ছেন এবং অকারণে বাইরে বের হচ্ছেন, কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না, এমনকি মাস্কটাও ঠিকমতো পরেন না, তারা হচ্ছেন প্রকৃতপক্ষে মানুষ বনাম ভাইরাসের যুদ্ধে ভাইরাসের সহযোগী। সমাজের এ অংশটাই করোনা ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি, বিস্তার এবং মিউটেশনের সহযোগী। সমাজের এ অংশটার জন্য সমাজের বৃহত্তর অংশের মানুষের জীবন আজ ঝুঁকির মধ্যে। সমাজের এ অংশটাকেই প্রকৃতপক্ষে ‘লক’ করতে হবে। তাতেই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা যাবে এবং মৃত্যুর সংখ্যা কমানো যাবে। অন্যথায় মানুষ এবং ভাইরাসের যুদ্ধে মানুষের বিজয় খুব সহজে হওয়ার নয়। যদিও মানুষ এবং ভাইরাসের যুদ্ধের অতীত ইতিহাস আমাদের সাক্ষ্য দেয় যে, শেষ পর্যন্ত ভাইরাস ও মানুষের যুদ্ধে মানুষেরই জয় হয়। মানুষের জয় অবশ্যম্ভাবী। ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App