উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ এবং মোকাবিলার কৌশল
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২১, ১২:১০ এএম
২০১৪ সালের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল কর্তৃক প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক রিপোর্টে উন্নয়নশীল দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের নাম প্রথম অন্তর্ভুক্ত হয়। বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় বাংলাদেশ ২০১৫ সালের জুলাইয়ে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। এখন জাতিসংঘের মাপকাঠিতেও বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটল। জাতিসংঘ তার সদস্য দেশগুলোকে স্বল্পোন্নত (এলডিসি), উন্নয়নশীল ও উন্নতÑ এই তিন পর্যায়ে বিবেচনা করে।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদণ্ড অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে ১ হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার, জাতিসংঘের হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ২৭৪ ডলার। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ৬১০ ডলার। তবে আরেকটি রিপোর্ট মোতাবেক ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৮২৭ ডলার।
ইকোসকের মানবসম্পদ সূচকে উন্নয়নশীল দেশ হতে ৬৪ পয়েন্টের প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশের আছে ৭২। অর্থনৈতিক ঝুঁকির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ২৫ দশমিক ২। এই পয়েন্ট ৩৬-এর বেশি হলে এলডিসিভুক্ত হয়, ৩২-এ এলে উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জিত হয়।
মাথাপিছু জাতীয় আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতাÑ এই তিন সূচকে বিচার করা হয় একটি দেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল ধাপে উত্তরণ করবে কি না। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে হলে অন্তত দুটি সূচক পূরণ করতে হয় একটি দেশকে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম দেশ যে তিনটি সূচকের সব কটি পূরণ করে পরবর্তী ধাপে উন্নীত হয়েছে। চলতি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের চূড়ান্ত সুপারিশ পায় এবং আশা করা যাচ্ছে ২০২৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে বাংলাদেশ।
উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য অনেক ইতিবাচক খবর। এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়বে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। ফলে আরো বেশি হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথ সুগম হবে।
উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠলে সস্তা ঋণ পাওয়া এবং বিভিন্ন রপ্তানি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। ফলে সেই সুবিধাগুলো উত্তরণের প্রস্তুতি পর্বে সময় চেয়েছে বাংলাদেশ। প্রস্তুতির এই সময়ে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে প্রাপ্ত সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে। একটি বিষয় বিবেচনার রাখতে হবে তা হলো, উত্তরণের সব পর্যায়েই কিছু না কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে। এগুলোর মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে। যেমনÑ ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপি সুবিধা থাকবে না। উন্নয়নশীল দেশগুলো ইইউতে জিএসপি প্লাস সুবিধা পায়। বাংলাদেশকে এ জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। এলডিসি না থাকলে অন্যান্য দেশের রপ্তানিতে বাংলাদেশের এখনকার মতো শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে না। এ জন্য বিমসটেক, বিবিআইএনের মতো আঞ্চলিক উদ্যোগের সুবিধা কীভাবে কার্যকরভাবে নেয়া যায়, তার জন্য প্রস্তুতি থাকতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। কেননা শুল্কমুক্ত সুবিধা না থাকলে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে ২০২৯ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ উদ্যোগের আওতায় পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। বাংলাদেশ মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার, পরিবেশ ও সুশাসন বিষয়ে ইইউর শর্ত পূরণ করলে জিএসপি প্লাস নামে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা পাবে। অর্জন ধরে রাখাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও আমাদের ৫০ বছর লেগে গেছে উন্নয়নশীল দেশে কাতারে পৌঁছার সুপারিশ পেতে। তাই দ্রুতগতিতে আঞ্চলিক বাণিজ্যে জোর দিতে হবে। চীন, ভারতের মতো দেশগুলো সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। আমাদের পেছনে তাকানোর সুযোগ নেই। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ওষুধ শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে, তাই এই শিল্পের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। ভ্যাকসিন উৎপাদনে এক সময় বাংলাদেশের বেশ নামডাক ছিল। বর্তমান মহামারি কত দিন চলেবে তা কেউ বলতে পারে না এবং সামনে আরো যে মহামারি আসবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, তাই ভ্যাকসিন উৎপাদন, মাস্ক, পিপিইসহ বিভিন্ন সামগ্রী তৈরিতে ব্যাপকভাবে কাজ করতে পারলে বাংলাদেশ একধাপ এগিয়ে যাবে এবং ২০৪১ সালের আগেই উন্নত দেশের স্বপ্ন ধরা দেবে।
আনোয়ার ফারুক তালুকদার
ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।
[email protected]