×

সাময়িকী

আশ্রয়

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২১, ১২:০৫ এএম

আশ্রয়
অমিত গোস্বামী অদ্ভুত বিপন্নতার মধ্য দিয়ে দিন কাটছে পৃথিবীর। সারা বিশ্ব আজ গৃহে স্বেচ্ছাবন্দি। ভয়ানক ভাইরাসে ভীত প্রত্যেকেই। মুহুর্মুহু খবর আসছে অনলাইনে কতজন এই ভাইরাসে আক্রান্ত, কতজন পরপারে। মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রেখে সংখ্যাটা দেখে নিল ঋক। ভোর হচ্ছে। ঘুম ভাঙছে কলকাতার। দুধ আর পাউরুটি দিয়ে যাবে একটু বাদে। ডিমের স্টক আছে। মাসখানেক চালানোর মতো ভাতের চাল, মেশানোর ডাল, নুন, মসলা আর দু-চারদিনের সবজি আছে। আপাতত ঝামেলা নেই। ঋক এই অ্যাপার্টমেন্টে একাই থাকে। তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। বাবা-মা ঘাটশিলায়। বারবার ফোনে বলেছেন চলে আসতে। স্বাস্থ্যকর জায়গা। ভাইরাসের উৎপাত নেই। প্রাণ থাকলে ভবিষ্যতে চাকরি করা যাবে। কিন্তু ঋক পারেনি। সংস্থার দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকে পালিয়ে যাওয়া ওর চরিত্রে নেই। কাজেই আপাতত ওয়ার্ক ফ্রম হোম। এপাশ-ওপাশ করে উঠে পড়ল সে। কফি বানিয়ে ব্যালকনিতে বসবে। কাজের মাসি নেই, কাগজ নেই- আপাতত এদের আসতে ‘না’ বলে দিয়েছে। অফিসের তাড়াও নেইÑ তবু আজকাল কাকভোরে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। বিছানা ছাড়তেই কলিংবেলটা বেজে উঠল। এত সকালে কে? ঋক দরজার দিকে এগোল। - সে কি তুই? এত ভোরে? - আমাকে একটু থাকতে দিবি? আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। - কে তোকে তাড়াল? কেন? আচ্ছা, ভেতরে আয় আগে। বিরাট গাবদা সুটকেস কোনোক্রমে টেনে ভেতরে নিয়ে এলো টুপুর। তারপরে ধপ করে বসে পড়ল সোফায়। বোঝা গেল অনেক ঝড় বয়ে গেছে। ঘুমোয়ওনি সারারাত। ঋক বললÑ তুই একটু ফ্রেস হয়ে নে। আমি কফি করছি। তারপরে তোর পুরো কাহিনী শুনব। এই যে বাথরুম। টুপুর উত্তর দিলÑ না, না, আগে শুনে নে, তারপর ডিসাইড কর আমাকে থাকতে দিবি কি না! ঋক বললÑ এই ক’দিনে করোনা নিয়ে যা জ্ঞান হয়েছে তাতে মনে হয় না পাঁচ মিনিট বাদে শুনলে আমার মাথায় কোনো আকাশ ভেঙে পড়বে। তোর জ্বর-টর নেই তো? টুপুর দুদিকে মাথা নেড়ে ‘না’ বলল। ঋক বললÑ তাহলে বাথরুমে যা, ফ্রেস হ, আর জামা কাপড় বিনস ব্যাগে রেখে আমার পাজামা পাঞ্জাবি পরে নে। পাজামা-পাঞ্জাবি বের করে দিচ্ছি। দু’কাপ কফি ও কিছু কুকিজ নিয়ে ব্যালকনিতে আসতেই ঋক দেখল টুপুর স্নান সেরে ব্যালকনিতে বসে আকাশ দেখছে। মুখোমুখি বসে কফি এগিয়ে দিয়ে বললÑ নে, এবারে কফি খেতে খেতে বল তোর স্টোরি। - তুই তো জানিস যে আমি ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিলাম মাস ছয়েক আগে। - হুঁ, জানি। ভাবছিলাম তুই এসে গেছিস কিনা! না কি ওখানেই... - নাহ। ওখানকার অবস্থা খারাপ হতেই আমায় তল্পিতল্পা গোটাতে হলো। আসলে ব্রিটিশরা প্রথমে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে কালোরা করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছে। আমাকে রাতারাতি লন্ডন ছাড়তে হলো। - তারপর? - কুড়ি দিন আগে আমি নামলাম মুম্বাইয়ে। কোনোমতে টিকিট জোগাড় করে এসেছি। বিরাট কিছু পয়সাও নেই। মুম্বাইয়ে এসেই ঝামেলা। বলল যে কোয়ারান্টাইনে থাকতে হবে। - কোথায়? মুম্বাইয়েই? - হ্যাঁ। ওরা একটা গেস্ট হাউসকে কোয়ারান্টাইন সেন্টার বানিয়েছে। আমাকে নিয়ে গেল সেখানে। - তুই কাউকে ফোন করিসনি? প্রতীককে? - করেছিলাম। কিন্তু ও বলল কলকাতার অবস্থা খুব খারাপ। ও আসতে পারবে না। আমি যেন সবার স্বার্থে চৌদ্দ দিন ওখানে থাকি। আমি ভাবলাম ঠিকই আছে। দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে সেটা আমার কর্তব্য। থাকলাম। কিন্তু মুশকিল হলো অন্য জায়গায়। আমাদের লালারস পরীক্ষা হলো। হায়দ্রাবাদ থেকে রিপোর্ট এলো আমরা তিনজন পজেটিভ। - ও গড! তারপরে? - আমাদের তোলা হলো নানাবতী হাসপাতালে। আইসোলেশন ওয়ার্ডে। পুরোপুরি অচ্ছুৎ। - স্বাভাবিক। - আমি খুব একটা ভয় পাইনি। আমার উপসর্গ তেমন ছিল না। সর্দি, কাশি শুধু। আমি প্রতীককে জানিয়েছিলাম। আশা করেছিলাম যে ও অন্তত যাবে। নাহ, ও গেল না। - ভয় পেয়েছিল হয়তো অথবা বাবা-মায়ের চাপ। একটু তো ভীতু প্রকৃতির ও চিরদিনের। তোর গল্পটার আন্দাজ এবারে পাচ্ছি। রিকভারির স্টোরিটা বল। - দেখ, আমার তো বাবা-মা নেই। আত্মীয়স্বজনও তেমন নেই। মুম্বাইয়ে হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ডে থাকার সময় নিজেকে একা উপেক্ষিত ও মানুষ বর্জিত মনে হতো। হতাশ লাগত খুব। তবে সব অপেক্ষার শেষ তো আছে। পনেরো দিনের মাথায় আবার লালারস পরীক্ষা করা হলো। আমরা তিনজনই রোগমুক্ত। বাকি দুজনের বাড়ির লোকের সে কি আনন্দ, হৈ চৈ। কিন্তু আমি একা হাসপাতাল ছাড়লাম। - তারপরে সোজা এয়ারপোর্ট, প্রতীকের বাড়ি এবং ওরা তোকে থাকতে দিতে চাইল না? এই তো বাকি গল্পটা? - সব গল্পই কি এত সোজা পথে এগোয় রে ঋক? আমি হাসপাতাল থেকে এয়ারপোর্টে এসেছিলাম ঠিকই। তারপরে কলকাতায় এসে নিজের ফ্ল্যাটে না নেমে ওদের বাড়ি গেলাম। আসলে আমি মানুষের, পরিচিতদের, নিজের লোকদের সান্নিধ্য চাইছিলাম ভীষণভাবে। - সেটাই তো স্বাভাবিক। পনের দিন বন্দি থাকার পরে... - কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কি হলো জানিস? ওদের বাড়িতে ওরা আমাকে প্রায় বন্দি করে ফেলল। - মানে? বন্দি করল কী কারণে? - আমাকে প্রথমে কিছু বুঝতে দেয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যে সবকিছু আমার স্বাভাবিক মনে হলো না। আমি প্রতীককে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল যে মা গুনিন ডাকতে গেছে। - হোয়াট? গুনিন? প্রতীকের মা? ভদ্রমহিলা কলেজে বিজ্ঞান পড়ান না? - হ্যাঁ। ওর বাবাও পড়াতেন। তিনিও দেখলাম কোনো প্রতিবাদে নেই। আমি সরাসরি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম ব্যাপারটা কী! তিনি বললেন, সব কিছুই প্রতীকের আর তোমার ভালোর জন্য। আমি বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলাম। - তারপর? - প্রতীকের মা গুনিন সাথে করে ফিরলেন। গুনিন নাকি ঝাড়ফুঁক করে আমার শরীরে লাগা বদহাওয়া তাড়িয়ে দেবেন। তারপরে আমি ওদের ছুঁতে পারব। সব ঘরে যেতে পারব। - তুই কি করলি? - আমি দেখলাম যে গুনিন সব সাজাচ্ছে। সিনেমায় যেমন সাজায়। দেখিসনি? আমাকে বলে যে শেষে নাকি গোমূত্র খেয়ে সব দোষ কাটাতে হবে। ততক্ষণে আমি কি করব ঠিক করে নিয়েছি। - কি করলি? - আমাদের সোসাইটিতে একজন প্যাথলজিস্ট থাকেন, আমি তাকে বললাম দ্রুত চলে আসতে। তিনি এলেন। আমি প্রতীকের মাকে বললাম যে আপনি আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে গুনিন এনেছেন, আমি তার কথা মতো সব কিছু করব। কিন্তু তার আগে আপনার ছেলের ব্লাড টেস্ট ও ইম্পোটেন্সি টেস্ট এই ডাক্তার বাবুর কাছে করাতে হবে। কারণ বিয়ের যোগ্যতা হিসেবে এই টেস্ট করানো সভ্য দেশের নিয়ম। - তারপর ভদ্রমহিলার রি-অ্যাকশন কী হলো? - কী আশা করিস? তেলে-বেগুনে চটে গেলেন। বললেন, ব্লাড টেস্ট না হয় বুঝলাম, ইম্পোটেন্সি টেস্ট কিসের? আমি বললাম যে আপনার ছেলের সাথে আমার বাবা আমাদের বিয়ের ব্যাপার ঠিক করে ওপরে চলে গেছেন তিন বছরের বেশি, আপনার ছেলে আজ অবধি আমাকে একটা চুমু খেয়েছে? আপনার যদি আজ মনে হয় আমার করোনা অ্যাটাক একটা বদ হাওয়া, তাহলে আমার আপনার ছেলের ইম্পোটেন্সি নিয়ে যে সন্দেহ আছে, তার নিরসন আজই করব না কেন? - তুই তো বিপ্লব করেছিস। তারপরে কী হলো? - কী আর হবে? তুমুল গালাগাল দিলেন। ডাইনি-টাইনি বললেন। আমি সেই প্যাথলজিস্ট আঙ্কলের গাড়িতে চলে গেলাম নিজের ফ্ল্যাটে। - তারপর? - তারপর আর কী? সারারাত ঘুমোতে পারলাম না। বুঝলাম যে ম্যারেজ ইজ আ কন্ট্রাক্ট কথাটা ভীষণ রকমের সত্যি। কিন্তু তাতে তো অ্যাট লিস্ট কিছুটা ভালোবাসা থাকবে। আরো অদ্ভুত কি মনে হলো জানিস? - কী মনে হলো? - সেই প্যাথলজিস্ট আঙ্কল যে বাবার অত বন্ধু ছিলেন তিনিও বললেন যে আমার সোসাইটিতে না থাকাই ভালো, তাতে নাকি সোসাইটির শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে। - তুই তোর পেপার্স দেখাসনি? - বলেছিলাম। তা উনি বললেন যে এর জেনুইনিটি কী! অদ্ভুত! তাই না? একটা ভাইরাস আমাদের মধ্যকার পারস্পরিক বন্ধন, বিশ্বাস, সম্পর্ককে একলহমায় একটা জটিল অবিশ্বাসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। এমন কি কাছাকাছি বসাও যেন কেমন অপরাধ হয়ে উঠেছে। সবাই ভাবছে সে বাদে অন্য সবাই ভাইরাস আক্রান্ত। সাবধানতার নামে কী ভয়ঙ্কর ছুতমার্গে বিচরণ। - সেটা ঠিক। কিন্তু তোর হঠাৎ আমার এখানে আসার কথা মনে হলো কেন? আমি এখানে আছি না নেই... তার ওপরে কোনো ফোন না করে... - কাল সারারাত ভেবে বুঝলাম মানুষ জীবনে শুধু আশ্রয় খোঁজে। অন্য কিছু নয়। আমি যতবার আশ্রয় শব্দটা ভেবেছি বারেবারে তোর মুখ ভেসে এসেছে। বাবা-মায়েরা এখানেই ভুল করে। তোর মতো ডাকাবুকো রাস্তায় মারধর করা ছেলে যে আমার আশ্রয় হতে পারে আমার বাবা তোকে এত দেখার পরে কখনো ভাবেনি। কিন্তু আমার মনে হতো। বলিনি বাবার ইচ্ছের কথা ভেবে। কিন্তু আজ... - বুঝেছি। আগে ব্রেকফাস্ট করি। খেয়ে তুই ঘুমো। অনেক দিন ঘুমোসনি। - হ্যাঁ রে, খাইওনি কতদিন ভালো করে। - তার আগে দাঁড়া, আয় আমার কাছে। আমি যে সাধুপুরুষ নই সেই টেস্টটা আগে দিয়ে নেই। - ঋক দ্রুত টুপুরকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে ঠোঁট নামল ওর ঠোঁটে। খোলা ব্যালকনিতে সে অবশেষে ডুবে গেল টুপুরের মধ্যে। ডুবে যেতে যেতে টুপুর অনুভব করল যে এই নিমজ্জন এক পরম আশ্রয়, যা তাকে দিল করোনা। দিনের প্রথম রোদ্দুরের আলো পড়ল দুজনের মুখে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App