×

জাতীয়

বুকফাটা হাহাকারে ভিন্ন অন্তিমশয্যার আয়োজন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২১, ০৯:৩৭ এএম

বুকফাটা হাহাকারে ভিন্ন অন্তিমশয্যার আয়োজন

ফাইল ছবি

দীর্ঘ হচ্ছে কবরের সারি দাফনের চাপ এড়াতে খুঁড়ে রাখা হচ্ছে অগ্রিম কবর ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন গোরখোদকরা, নেই সুরক্ষাসামগ্রী

সূর্যটা তখন ঠিক মাথার উপর লাম্বিক অবস্থানে। এমনই মাঝদুপুরে মায়ের কবরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আহাজারি করছিলেন রেদোয়ান। তার চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছিল কবরের ঘাস ও মাটি। হাসপাতালের আইসিইউতে রেখে ঘরে ফিরেই মায়ের মৃত্যুর সংবাদ পায়। মায়ের কাছ থেকে শেষ বিদায়টাও নেয়া হয়নি তার। এই আক্ষেপ যেন ছিঁড়ে-কুড়ে খাচ্ছে রেদোয়ানের বুকের ভেতরটাকে। কবরের উপরে গজিয়ে ওঠা সবুজ ঘাসের গায়ে হাত বুলাতে গিয়ে মা মা বলে চিৎকার করে উঠছিলেন বারবার। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর রায়েররাজার কবরস্থান ঘুরে দেখা মিলল এমন দৃশ্যের। স্বজনহারা প্রিয়জনদের বুকফাটা বিলাপ আর আর্তনাতে ভারি হয়ে উঠেছে কবরস্থানের বাতাস।

একটু কাছে যেতেই উঠে দাঁড়ায় রেদোয়ান। কীভাবে ছেড়ে গেলেন মা? প্রশ্ন করতেই ফের ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। বলেন, গত বছরের ২ জুন মা চলে যায়। এরপর থেকে সপ্তাহে অন্তত তিন দিন এখানে আসি। নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। রেদোয়ান বলেন, ছয় দিনের জ¦রে মা চলে গেলেন। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। প্রথম দিন হালকা জ¦র ছিল, এরপরের দিন থেকে মা কিছু খেতে পারছিলেন না। পঞ্চম দিন মাকে ভর্তি করি আনোয়ার খান মডেল হাসপতালে। অবস্থা খারাপ বুঝে ওই দিন রাতেই নেয়া হয় আইসিইউতে। রাতে মাকে

হাসপাতালে রেখে বাসায় ফিরে আসি। কারণ তখন হাসপাতালে কাউকে থাকতে দেয়া হচ্ছিল না। ভোর ৫টায় হাসপাতাল থেকে ফোন আসে মা আর নেই। এটা বলেই চুপ হয়ে যান রেদোয়ান। আর কিছুই বের হয় না তার কণ্ঠ থেকে। চোখের পানি ঝরঝর করে পড়তে থাকে কেবল। বিমানচালক রুসলান এসেছেন খিলগাঁও থেকে। তিনিও করোনায় মাকে হারিয়েছেন। মায়ের শেষ চিহ্নের কাছে ছুটে আসেন দুদিন পরপরই। দীর্ঘক্ষণ ধরে কবরে বসে দোয়া ও মোনাজাত করলেন। নিজে করোনা আক্রান্ত হওয়ায় মৃত্যুর সময় মায়ের সঙ্গে থাকতে পারেননি। রুসলানের আক্ষেপ পাইলটের চাকরি করতে গিয়ে মাকে সময় দিতে পারেননি তিনি। তাইতো মায়ের মৃত্যুর পর চাকরিটাই ছেড়ে দিয়েছেন। একদিন পরপরই এখানে ছুটে আসেন মায়ের কবরে।

রাজধানীর এই কবরস্থানটি যেন এক ভিন্ন অন্তিমশয্যার আয়োজন। মায়া আর ভালোবাসার সঙ্গে প্রিয়জনদের অনেক নিষ্ঠুরতারও সাক্ষী এই কবরস্থানটি। অনেকেই করোনা ভয়ে কাছের মানুষের লাশ দাফন না করে ফেলে পালিয়ে চলে যান। আবার অনেকে নাম-ঠিকানা আর খরচা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে পাঠিয়ে দেন মরদেহটিকে। যিনি বেঁচে থাকতে ছিল তার সবচেয়ে কাছের মানুষ। নিষ্ঠুরতা চিহ্ন বয়ে নিয়ে আসা এই মৃতদেহগুলো তুলে নিয়ে মাটি দেন এখানকার গোরখোদকরা। জানতে চাইলে গোরখোদক প্রধান লিয়াকত আলী ভোরের কাগজকে বলেন, এই দুইদিন আগেই এক ছেলে তার বাবার লাশ গেট থেকে আমার কাছে বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেছে। আমি তুলে নিয়ে গিয়ে মাটি দিয়েছি। অ্যাম্বুলেন্সে পরিবারের লাশ পাঠিয়ে দেয় অনেকে। বলতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে যান লিয়াকত আলী।

তিনি বলেন, দাফনের সংখ্যা বাড়তে থাকায় পরিস্থিতি সামাল দিতে অগ্রিম ৩০টা কবর খুঁড়ে রাখা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৭৮ জনকে দাফন করা হয়েছে এখনে। তিনি জানান, এমনো হচ্ছে একজনের দাফর শেষ হতেই আসছে আরেকজন। দাফন কাজে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসির) দেয়া খননযন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। ২৭ জন গোরখোদক শুধু করোনা দাফনের কাজ করেন আলাদাভাবে। দাফনের কাজে নিয়োজিতদের সুরক্ষাসামগ্রী দেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত বছর তাদের করোনা সুরক্ষাসামগ্রী দেয়া হলেও এ বছর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে তাদের জন্য কিছুই হয়নি। যার ফলে স্বাস্থ্যবিধির দিক-নির্দেশনাগুলো সঠিকভাবে না মেনেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলোজি (ভাইরাস বিদ্যা) বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সুলতানা শাহানা বানু জানান, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত মরদেহ দাফন করার সময় পিপিই পরা এবং অন্য সুরক্ষাসামগ্রী বাধ্যতামূলক। যদিও মরদেহ থেকে ভাইরাস ছড়ায় না। তবে একজন মানুষ মারা যাওয়ার পর কয়েক ঘণ্টা ভাইরাসটি বহন করতে পারে। তাই ঝুঁকি থেকেই যায়।

করোনা সংক্রমণে মৃত্যু বাড়তে থাকায় রাজধানীর করোনা ডেডিকেটেড একমাত্র কবরস্থান রায়েরবাজার। এখানে বাড়ছে কবরের সংখ্যা। কবরস্থানের ৮ নম্বর সারিটি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মরদেহ দাফনের জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে। এখানো ফাঁকা রয়েছে অনেক জায়গা। ৮নং এই সারির সামনের দিকে সারি সারি নতুন কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছে। দেখে মনে হবে যেন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত কোনো দেশের চিত্র। গোরখোদকরা যেন নীরব যুদ্ধের সৈনিক। যুদ্ধের মাঠে পরাজিত মানুষদের মাটি দেয়াই তাদের কাজ। তারা জানান, প্রতিটি মরদেহ দাফনের জন্য ৫০০ টাকা নেয়া হলেও করোনা ভাইরাসে মারা যাওয়াদের জন্য কোনো টাকা নেয়া হয় না। কবরস্থানটিতে দুই শিফটে ৩২ জন কাজ করেন।

গোরখোদকরা বলছেন, এমন মৃত্যুর দীর্ঘ মিছিল তারা কখনই দেখেননি। রোজ অন্তত খোঁড়া হচ্ছে ১৫-২০ জনের কবর। তারা জানান, সনাতন পদ্ধতিতে কবর খুঁড়ে আর কুলাচ্ছিল না। তাই আনতে হয়েছে আধুনিক মাটিকাটা যন্ত্র, যা দিয়ে অল্প সময়ে অনেক কবর খুঁড়তে পারছেন তারা। তবে যন্ত্র শুধু গর্তটা করে দেয় বাকি কাজগুলো তাদেরই করতে হয়।

কবরস্থানের তত্ত্বাবধায়ক আবদুল আজিজ বলেন, চলতি মাসের তিন সপ্তাহে এখানে দাফন করা হয়েছে দেড়শর বেশি মরদেহ। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত আসতে থাকে লাশ। মহামারি শুরু হওয়ার পর গত বছরের এপ্রিল ও জুন মাসে মরদেহ আসা বেড়েছিল। এখন সেবারের তুলনায় অনেক বেশি মরদেহ আসছে। কারণ সাধারণ ছুটির কারণে মানুষ ঢাকার বাইরে মরদেহ নিয়ে যেতে পারছেন না।

প্রসঙ্গত, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের পেছনে রায়েরবাজার করবস্থানটি নির্মাণ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। ডিএনসিসির সূত্র জানায়, দেশের বৃহৎ কবরস্থানটির আয়তন প্রায় ৯৬ একর। মূল কবরস্থান ৮১ দশমিক ৩০ একরের। এখানে সাড়ে ৮৫ হাজার লোকের কবর দেয়ার জায়গা রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App