×

জাতীয়

দক্ষিণ এশিয়ায় ভ্যকসিন কূটনীতি নিয়ে খেলছে চীন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২১, ০৭:২২ পিএম

দক্ষিণ এশিয়ায় ভ্যকসিন কূটনীতি নিয়ে খেলছে চীন

গ্লোবাল টাইমস।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই মঙ্গলবার আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে যে বৈঠক করেছেন তাতে কোভিড-১৯ যুদ্ধ এবং মহামারী-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয়েই শুধু আলোচনা হয়নি, আলোচনায় ভ্যাকসিন কূটনীতি, ভারত-চীনের ভ্যাকসিন যুদ্ধ, চীনের তৈরি ভ্যাকসিন নিয়ে আমেরিকার অসহযোগিতার বিষয়ও স্থান পেয়েছে।  একইসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ভ্যাকসিন সহযোগিতা এবং সরবরাহ নিয়ে বড় উদ্বেগের কথাও আলোচনায় উঠে এসেছে। ‘চায়না ডিপেন্স এন্টি কোভিড-১৯ কোঅপারেশন উইথ সাউথ এশিয়ান ন্যাশন্স এমিড সার্জিং কেইসেস ইন ইনডিয়া’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে চায়নার দৈনিক গ্লোবাল টাইমস এসব কথা জানিয়েছে।

মঙ্গলবার চীনের নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়ায় ৫ দেশের মধ্যে কোভিড নিয়ে যে বৈঠক, তাতে ভারত যোগ দেয়নি। বৈঠকে নয়াদিল্লির অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বেইজিং এখনও মহামারি মোকাবিলায় চীনের এই উদ্যোগে অংশ নেয়ার জন্য ভারতকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং দেশটিকে সহায়তা করার জন্য ফের প্রতিশ্রুত দিয়েছে চীন।

বিশেষজ্ঞদের বরাতে বৈঠকে এও আলোচনা হয়েছে, ভারতে মারাত্মক মহামারি পরিস্থিতি বিবেচনা করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে ভারতের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা করা জরুরি কাজ হয়ে উঠেছে। এরফলে অনলাইন বৈঠকে অংশ নেওয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা চীন-দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলোর মধ্যে জরুরি সরবরাহের মজুদ তৈরির বিষয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে এটি সবচেয়ে জরুরি কাজ, কারণ ভারতবর্ষের প্রাদুর্ভাবও এই অঞ্চলে ভ্যাকসিন সরবরাহ ব্যাহত করেছে। কারণ, ভারত একটি বড় ভ্যাকসিন উৎপাদন কেন্দ্র।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং বৈঠকে পুনর্ব্যক্ত কওে বলেছেন যে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর সঙ্গে ইচ্ছাকৃত এবং অবৈধ হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে বা পক্ষকে বেছে নিতে অন্যকে জোর করে এবং একতরফা সুরক্ষাবাদী এবং হুমকির কৌশলগুলো এখনও অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব, সুরক্ষা এবং উন্নয়নের স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। আর এমন ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য চীন এবং দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশ জরুরি সরবরাহের জন্য একটি রিজার্ভ প্ল্যাটফর্ম তৈরির বিষয়ে একমত হয়েছে। এতে বিপুল জনস্বাস্থ্যের সঙ্কট মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়াবে। কোভিড -১৯ ভ্যাকসিন সহযোগিতা অন্বেষণ করার পাশাপাশি তৈরি হওয়া ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ যেকোনো রূপের বিরোধিতা করবে এবং অনাক্রম্যতা ব্যবধান বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা নিয়মিত মহামারি প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে জনগণের সঙ্গে জনগণের আদান-প্রদান পুনরায় চালু করার বিষয়ে আলোচনা করার সময় দুর্বল ব্যক্তিদের সুরক্ষা এবং সরবরাহ চেইনের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছেছেন।

ওয়াং বলেন, চীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক দিনগুলিতে তৃতীয়বারের মতো কোভিড-১৯ সংক্রমণ ও মৃত্যুর মধ্যে ভারতকে সহায়তা করার জন্য বলেছে এবং ওই বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

[caption id="attachment_281169" align="aligncenter" width="700"] গ্লোবাল টাইমস।[/caption]

গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোভিড নিয়ে ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশটির প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে সক্রমণ বাড়ার কারণ হতে পারে এবং এরপরে আরও এশীয় দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভারতে কিছু ধনী ব্যক্তি সুনামির মতো মহামারি এড়াতে অন্য দেশে চলে গিয়েছেন বলে জানা গেছে এবং ভয়ের আশঙ্কায় আরও বেশি ভারতীয় বিশেষত সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারীরা প্রতিবেশী দেশগুলিতে পালিয়েছে, যা সংক্রমণ বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে মনে করছেন সাংহাই ইনস্টিটিউটসের সেক্রেটারি-জেনারেল লিউ জঙ্গি।

আর এই ইস্যুকে সামনে এনে মঙ্গলবার বৈঠকে পাঁচটি দেশ ভারতে কোভিড-১৯-এর সংখ্যা বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মহামারি নিয়ন্ত্রণে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলোর জন্য আরও গুরুতর সমস্যা হল-ভ্যকসিন না পাওয়া। কীভাবে পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন পাওয়া যায় সেই নিয়েই আলোচনা চলছে? কারণ এসব দেশগুলোতে ভারত ভ্যকসিন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও যা দিয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। আরও বেশি ভ্যাকসিন সরবরাহের ক্ষেত্রে ভারত আগের প্রতিশ্রুতিগুলি রক্ষা করতে পারছে না। এছাড়াও কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় টিকাদান। তবে দক্ষিণ-এশিয়ার এই দেশগুলি যেখানে জনসংখ্যা বেশি সেখানে মার্কিন-উন্নত ভ্যাকসিনগুলো পাওয়াও শক্ত বলে বৈঠকে জানিয়েছেন ওয়াং।

এদিকে, ভারত থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ার পরে চীন থেকে ভ্যাকসিন চেয়েছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর জবাবে সাংহাই ইনস্টিটিউটসের সেক্রেটারি জেনারেল লিও বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভ্যাকসিন সরবরাহের ইচ্ছা রয়েছে যা কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চীন এশীয় দেশগুলোর সমর্থন এবং আঞ্চলিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা জোরদার করবে।

গ্লোবাল টাইমস সূত্রের কাছ থেকে আগে জানতে পেরেছিল যে চীনের প্রধান ভ্যাকসিন উৎপাদক সিনোভ্যাক বাংলাদেশে ভ্যাকসিন ট্রায়াল করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারত হস্তক্ষেপ করায় তা বাংলাদেশে করা যায়নি। তবে ভারতীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে যে সিনোভ্যাক বাংলাদেশ সরকারকে ক্লিনিকাল ট্রায়ালের জন্য টাকা চেয়েছিল এবং এরপরেই বাংলাদেশ চীনকে বাদ দিয়ে ভারতের দিকে চলে গেছে। ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচার হওয়া ‘চীন দক্ষিণ এশিয়ায় ভ্যাকসিন কূটনীতি খেলছে’ এমন দাবি অস্বীকার করে লিউ বলেছিলেন যে কোভিড-১৯ লড়াইয়ে প্রতিবেশী এবং অন্যান্য দেশগুলোতে চীনের সহায়তা কখনও থামেনি।

চীন নেপালকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছে এবং ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছে। দেশটি গত ২৭ জানুয়ারি ভারতে তৈরি অ্যাস্ট্রাজেনিকার কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন দিয়ে এই টিকাদান প্রচার শুরু করে। তবে এখন তাদের টিকার মজুত হ্রাস পেয়েছে এবং অতিরিক্ত ডোজ আবার কখন পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে অনিশ্চয়তার কারণে অ্যাস্ট্রাজেনিকা ভ্যাকসিন দিয়ে লোকদের টিকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল এবং অনুদান সহায়তায় চীন কর্তৃক সরবরাহিত কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ৮ লাখ ডোজ ব্যবহার করতে শুরু করে। তেমনি পাকিস্তানেও চীন সহায়তা করেছে।

গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদনে আলো বলা হয়েছে, চীনে যেমন ভ্যাকসিন উৎপাদনের সম্পূর্ণ শিল্প রয়েছে তেমনি ভারতে পশ্চিমা দেশগুলির দ্বারা নির্মিত ভ্যাকসিনগুলোর জন্য আউটসোর্সিং কারখানা রয়েছে বলে বলে গ্লোবাল টাইমসকে জানিয়েছেন চায়না ভ্যাকসিন শিল্প সংস্থার সভাপতি ফেং দুজিয়া। তিনি বলেন, চীনে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারে এমন সংস্থাগুলির সংখ্যা পাঁচ থেকে ১৮টি পর্যন্ত প্রসারিত হবে এবং তাতে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়বে। এর অর্থ হল ভ্যাকসিন নিয়ে চীনের সঙ্গে সহযোগিতা আরো স্থিতিশীল হবে এবং ভ্যাকসিন উৎপাদন স্থানীয়করণ করতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ফেং।

গ্লোবাল টাইমস তাদের প্রতিবেদনে এও বলেছে, চীনের তৈরি ভ্যাকসিনগুলো বিশ্বব্যাপী বিতর্ক সৃষ্টি করেছে কারণ এই ডোজগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়নি। মার্কিনিরা চীনের তৈরি টিকার বিষয়ে সহজ মনোভাব প্রদর্শন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সুরক্ষা পর্যালোচনা আরও সহজ করবে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে। এর সূত্র ধরে লিউ বলেছিলেন, এই ভ্যাকসিনগুলি ভারত বা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে বিতরণ করা হবে কিনা তা এখনও অজানা রয়ে গেছে কারণ আমেরিকা চীনের তৈরি ভ্যাকসিনগুলো অনুসরণকারীদের চিকিৎসার জন্য তাদের রাজনৈতিক সরঞ্জাম হিসাবে ব্যবহার করতে পারে। এরফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর খুব কম লোকই উপকৃত হতে পারে-বলছিলেন লিউ। তিনি বলেছেন, চীন সবসময় কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিয়ে জনসাধারণের জন্য ভাল কিছুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং পূরণ করেছে। সিনোফার্ম এবং সিনোভ্যাকের দ্বারা উৎপাদিত চীনের ভ্যাকসিনগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং একবার তারা জরুরি ব্যবহারের লাইসেন্স পেয়ে গেলে আরও উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশেষত এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলি উপকৃত হবে বলে জানান লিউ।

চীনের সিনোফার্ম ভ্যাকসিন বিদেশে এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর জন্য ৫০ মিলিয়ন ডোজ পাঠিয়েছে এবং বিশ্লেষকরা বলেছেন যে চীন ইতিমধ্যে অন্যান্য দেশগুলোতে সর্বাধিক ভ্যাকসিনের ডোজ সরবরাহ করেছে, এর মধ্যে অনেকগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তা বিতরণ করা হয়েছে।

একইসঙ্গে চীনা ভ্যাকসিন উৎপাদকরা ভ্যাকসিন উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে এবং সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য অন্যান্য দেশে প্রযুক্তিগত স্থানান্তর সরবরাহ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ক্যানসিনোর প্রতিষ্ঠাতা ইউ জিউফেং দক্ষিণ চীনের হাইনানের সাম্প্রতিক বায়ো ফোরামে বলেছেন যে উন্নয়নশীল দেশ ভ্যাকসিনগুলি অ্যাক্সেসের ক্ষেত্রে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App