অক্সিজেন ব্যবসা রমরমা
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২১, ০৯:৫৮ এএম
অক্সিজেন।
বেসরকারি হাসপাতালগুলো রোগীদের কাছ থেকে দাম নিচ্ছে কয়েকগুণ বেশি।
হাসপাতালে বছরজুড়েই রোগীদের অক্সিজেন চাহিদা রয়েছে। অপারেশন টেবিলে রোগী মানেই অক্সিজেন প্রস্তুত রাখতে হয়। বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বর্তমানে দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে অক্সিজেনের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে গেছে। হাসপাতালের পাশাপাশি বাসায় অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছেন হাজার হাজার করোনা রোগী। এমনিতেই যারা শ্বাসকষ্টের রোগী তারাও সিলিন্ডার কিনে নিচ্ছেন বাড়তি প্রস্তুতি হিসেবে। রোগী বাড়তে থাকায় বড় বড় অনেক হাসপাতাল চাহিদামতো অক্সিজেন সরবরাহে হিমশিম খাচ্ছে। এই সুযোগে বেসরকারি হাসপাতালগুলো অক্সিজেন সরবরাহের নামে রোগীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো টাকা আদায় করছে- যা ক্রয়মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। তাছাড়া দেশজুড়ে চাহিদা থাকায় সারাবছরই হাসপাতালগুলোতে রোগীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো আদায় করা হচ্ছে অক্সিজেন বিল।
এদিকে পাশের দেশ ভারতের কয়েকটি রাজ্যে করোনা পরিস্থিতিতে অক্সিজেন সংকট দেখা দিয়েছে। সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশ থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে এখনো সংকটের আশঙ্কা না থাকলেও অক্সিজেন কারখানা মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ডা. রোবেদ আমিন গতকাল সোমবার বিকালে ভোরের কাগজকে জানান, এখন পর্যন্ত অক্সিজেন সংকটের কোনো কারণ তারা দেখছেন না। তবে ঘাটতি হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে আগাম প্রস্তুতির অংশ হিসাবে অক্সিজেন প্রস্তুতকারী কোম্পানি মালিকদের সঙ্গে তারা একবার বৈঠক করেছেন। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে রোগীদের কাছ থেকে প্রতিঘণ্টায় ইচ্ছেমতো অক্সিজেন বিল নেয়া হয়- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এজন্য কোনো নীতিমালা বা সরকারি নির্দেশনা নেই। তাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের মতো করে বিল নিয়ে আসছে। তবে রোগীদের বিপাকে ফেলে অতিরিক্ত টাকা নেয়া উচিত নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকার মগবাজার এলাকার একাধিক অক্সিজেন ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ১ দশমিক ৩৬ পয়েন্ট বা ১০ লিটার সাইজের একটি সিলিন্ডারে দুই হাজার ঘনমিটার অক্সিজেন ভরা যায়। এছাড়া রয়েছে ৬ দশমিক ৮ বা ৭ পয়েন্ট, ৯ দশমিক ৮ বা ১০ পয়েন্টের সিলিন্ডার। আগে এসব সিলিন্ডার ভরতে প্রতি পয়েন্টের জন্য ২৮/৩০ টাকা ব্যয় হলেও এখন তা বেড়ে ৪৫-৫০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। তবে হাসপাতালগুলোতে রোগীদের কাছ থেকে প্রতিঘণ্টার জন্য নেয়া হচ্ছে ২০০ টাকা। সবচেয়ে ছোট সাইজের ১০ লিটারের একটি সিলিন্ডার থেকে একজন রোগীকে যদি ১ লিটার করে প্রেসার দিয়ে অক্সিজেন দেওয়া হয়; তাহলে তা থেকে ১২-১৫ ঘণ্টা অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব (রোগীর অবস্থা ও চাহিদা বিবেচনা করে এর প্রেসার বাড়ানো কমানো হয়)। এতে অন্য সেবা ছাড়াই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শুধু অক্সিজেন সরবরাহ করেই রোগীর কাছ থেকে টাকা হাতাচ্ছেন ইচ্ছেমতো। হাসপাতাল মালিকরা মাত্র ১৫০ টাকায় ছোট একটি সিলিন্ডার ভর্তি অক্সিজেন কিনে প্রতিঘণ্টায় রোগীর কাছ থেকে ২০০ টাকা করে নিয়ে কী পরিমাণ ব্যবসা করছে তা উল্লেখ করে ঢাকার একজন অক্সিজেন ব্যবসায়ী জানান, ঘণ্টার সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই। রোগীরমুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো হলেই ২০০ টাকা নেয়া হয়। এতে আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টার বিলের হিসাব একই। অনেক রোগীর টানা কয়েক দিন পর্যন্ত অক্সিজেন প্রয়োজন হয়ে থাকে।
সূত্র মতে, অনেক বড় হাসপাতালে উৎপাদনের জন্য নিজস্ব অক্সিজেন কনসেনটেটর মেশিন রয়েছে। আছে লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংকও। চলমান করোনা পরিস্থিতিতে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন করেও পেরে উঠছে না। চাহিদা মেটাতে তারা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অক্সিজেনভর্তি সিলিন্ডার সংগ্রহ করছেন দৈনিক চুক্তিতে। ঢাকার পাশে নারায়ণগঞ্জে ডিআর, ইসলাম, ইউনিয়ন, ফ্রেশসহ বেশ কয়েকটি অক্সিজেন কারখানা রয়েছে। আশুলিয়ার কাঠগড়ায় এসেঞ্জ, কুমকুমারীতে এসএস, মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ায় স্প্রেক্টা, টাঙ্গাইলে নাসির অক্সিজেন কারখানা রয়েছে। যারা ঢাকার অক্সিজেন চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। অনেক স্থানে নকল সিলিন্ডারে অক্সিজেন ভরে সরবরাহের অভিযোগও রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে এমন সিলিন্ডার আটকও হয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ অক্সিজেন কোম্পানি (বিওসি) ছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান। যা এখন বদলে গেছে। বহুজাতিক অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লিন্ডে এখন সরকারিভাবে অক্সিজেন সরবরাহ করছে। দেশে বর্তমানে দৈনিক চাহিদা ১৮০ টন অক্সিজেন। দ্রুত চাহিদা বাড়ায় ঘাটতি থাকছে দৈনিক প্রায় ৬৫ টন। এর মধ্যে বহুজাতিক অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লিন্ডে বাংলাদেশ উৎপাদন ও সরবরাহ করছে ৯০ টন এবং স্পেক্ট্রা নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান দৈনিক গড়ে সরবরাহ করছে ২৪ দশমিক ৫ টন।
এদিকে বহুজাতিক অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড নতুন অক্সিজেন প্ল্যান্ট করার প্রস্তাব দিয়েছে। যা অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে প্ল্যান্টটি করতে কমপক্ষে নয় মাস সময় লাগবে। তবে নারায়ণগঞ্জে তাদের একটি ট্যাংক রয়েছে যেটিতে নয় টন অক্সিজেন মজুদ রাখা সম্ভব। বর্তমান ঘাটতি মেটাতে তারা লিন্ডে ভারতের কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহে ৫০ থেকে ৮০ টন অক্সিজেন এনেছে। তবে তা ভারতের নিজস্ব চাহিদার কারণে এখন বন্ধ রয়েছে। যে ট্যাংকারের মাধ্যমে অক্সিজেন আনা হয় তার প্রত্যেকটি ধারণ ক্ষমতা সাড়ে চার টন থেকে ১৪ টন। লিন্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাদের নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামে দুটি অক্সিজেন উৎপাদন প্ল্যান্ট রয়েছে। এই দুটি প্ল্যান্টে প্রতিদিন যথাক্রমে ৭০ টন এবং ২০ টন করে মোট ৯০ টন অক্সিজেন উৎপাদন করা হয়। এছাড়া স্পেক্ট্রা আমদানি ও উৎপাদনের মাধ্যমে ২৪ দশমিক ৫ টন অক্সিজেন উৎপাদন করে থাকে। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দৈনিক অক্সিজেনের চাহিদা ১০ থেকে ১৫ টন। বাকি অক্সিজেনের বেশিরভাগ চাহিদা কোভিড চিকিৎসায় যুক্ত হাসপাতালগুলোতে। পাশাপাশি অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালেও সরবরাহ করা হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, ভারত থেকে আমদানির পাশাপাশি দেশের আট বিভাগে অক্সিজেন প্ল্যান্ট নির্মাণের নতুন পরিকল্পনা করা হবে। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, এখন পর্যন্ত চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। আশা করছি কোনো বড় ধরনের সংকট হবে না।
প্রসঙ্গত, দেশে মোট ২৯টি বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবার অনুমতি দিয়েছে সরকার। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে ১৬টি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল রয়েছে। চট্টগ্রাম জেলায় চারটি সরকারি ও চারটি বেসরকারি হাসপাতালে এই চিকিৎসা চলছে। চাহিদা বিবেচনায় এর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানা গেছে।