ছিনতাই আতঙ্কে সদরঘাট, বেপরোয়া কুলি ও কিশোর গ্যাং
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২১, ১১:৪৫ এএম
সদরঘাট। ফাইল ছবি
দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহনের প্রধান কেন্দ্র রাজধানীর সদরঘাট। এ নৌবন্দর দিয়ে যাতায়াত করে দেশের দক্ষিণবঙ্গের প্রায় সবকটি জেলার মানুষ। তাই বিভিন্ন অপরাধচক্র, নামধারী নেতাদের টার্গেট এ এলাকার উপর। তাই সদরঘাট ও এর সংলগ্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে চাঁদাবাজি ও ছিনতাই রাজত্ব। সন্ধ্যার পর বিভিন্ন চক্রের ছিনতাই রাজত্বে পরিণত হয় এ এলাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সদরঘাটের 'লাল বাহিনী, হলুদ বাহিনী, আকাশী বাহিনী' ( লাল, হলুদ, আকাশী পোশাক পরিহিত কুলি) নামে পরিচিত বিভিন্ন ঘাটের কুলিরা নৌপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকায় এখন এ এলাকায় ছিনতাই রাজত্ব কায়েম করছে। এর আগে তারা লঞ্চ চলাচলের সময় যাত্রীদের থেকে জোর করে মালামাল পরিবহন বাবদ অতিরিক্ত চাঁদা আদায় করত। কোন কোন যাত্রী নিজেদের পরিবহনযোগ্য কম মাল কুলিদের দিয়ে বহন না করতে চাইলে ইজারা বাবদ ৫০-১০০ টাকা চাঁদা দাবি করত তারা। না দিতে চাইলে লাঞ্চিত ও হেনস্তা করার মাধ্যমে আদায় করা হতো চাঁদা। কিন্তু বর্তমানে এ কাজ না থাকায় তারা ছিনতাইয়ে নিয়োজিত। বিভিন্ন গলিতে দাঁড়িয়ে ছুরি দেখিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নেয় পথচারীদের। সর্বস্ব খোয়ায় রিক্সা চালকরাও।
এসব কুলি 'বাহিনী' চালায় ঘাট শ্রমিক লীগের কিছু নেতারা। 'লাল বাহিনী'র নেতা ও ঘাট শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাভেদ হোসেন মিঠু বলেন, এখানে কোন ছিনতাই দেখা যায় না। এখন ঘাট নিয়ন্ত্রন করে কেরানীগঞ্জের নেতারা। কুলিরা লকডাউনে একেবারে বেকার হয়ে পড়েছে। অনেকে রিক্সা চালাচ্ছে।
এছাড়া সদরঘাট ও পার্শবর্তী লালকুঠি, শ্যামবাজার, ইসলামপুর, বাবুবাজার, কেরানীগঞ্জে ফেরদৌস গ্রুপ, সাজু গ্রুপ, সিনিয়র গ্রুপ, জুনিয়র গ্রুপ, টাইগার গ্রুপসহ অংসখ্য কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। ছিনতাই কর্মকান্ডে এসকল গ্যাং সদস্যরা বেশি বেপরোয়া। প্রত্যেকটি গ্যাং এ ২০ থেকে ৩০ অধিক কিশোর রয়েছে। এদের কেউ স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে। কেউ এখনো পড়ছে। কেউ মাদকের মামলার আসামী। সন্ধ্যার পরে তারা এসব এলাকায় জড় হয়ে আড্ডা দেয়। আড্ডার সময় কোন পথচারী, মেয়ে বা বৃদ্ধ রিকশা চালক সামনে পড়লে রেহায় নেই। কেউ হারায় নিজেদের অর্থ-সম্পদ সর্বস্ব। কেউ হারায় সম্মান।
হাতিয়ার হিসেবে তারা ব্যবহার করে ছুরি, চাইনিজ চাকু ও ব্লেড। বীরত্ব দেখাতে তুচ্ছ ঘটনায় প্রকাশ্যে রাস্তায় খুনোখুনি করতেও তাদের হাত কাঁপে না। সর্বশেষ শবে বরাতের রাতে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিহত হয় অন্তর নামে এক কিশোর। প্রথম তারাবির রাতেও একজন জখম হয়। এছাড়া ধর্ষণ ও ইভটিজিং এর মতো ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। আর এসব কিশোর গ্যাং যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের পদধারী বা নামধারী কোন না কোন 'বড় ভাই' এর শেল্টারে গড়ে উঠেছে। কিশোরদের ছিনতাই এর ভাগ মাদক কেনাসহ এসব বড় ভাই ও নেতাদের দিতে হয় বলে সূত্র জানায়।
অন্যদিকে সরকারি কবি নজরুল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কিছু গ্রুপ কর্মীরা ছিনতাই কাজের সাথে জড়িত বলে সদরঘাট এলাকার ব্যবসায়ীরা জানান। তারা বলেন, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রলীগের কিছু গ্রুপ পথচারী মানুষ ও ছোট ছোট পরিবহনের চালকদের থেকে ছুরি ও পিস্তল দেখিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। কিন্তু ভয়ে অন্য কেউ কিছু বলে না।
রফিকুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ঈদের সময় ছিনতাই বেশি দেখা যায়। তবে লকডাউনে সন্ধ্যার পর সদরঘাট এলাকা ছিনতাই আতঙ্কে অনিরাপদ হয়ে উঠে।
এবিষয়ে সদরঘাট এলাকাধীন ৩৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুর রহমান মিয়াজী চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অতীতে এসব এলাকায় ছিনতাই, পকেটমার ছিল। কিন্তু সেই অতীতের তুলনায় এখন অনেকটাই কম। আর আমাদের কাছে এ ধরনের কোন অভিযোগ বর্তমানে নেই।
ছিনতাই এর বিষয়ে ডিএমপির লালবাগ ডিভিশনের কোতোয়ালি জোনের এডিসি মুহিত কবীর সেরনিয়াবাত ভোরের কাগজকে বলেন, আগে ছিনতাই ছিল। এখন কমে গেছে। অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাং সদস্যদের আমরা আটক করেছি। তবে কিছু কিছু জায়গায় নতুন করে আবার খবর পাচ্ছি। বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে সদরঘাট পর্যন্ত প্রতিটি পয়েন্টে আমাদের পুশিল মোতায়েন রয়েছে।