×

সাময়িকী

মানুষকে আপন করে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল শাহরিয়ার ভাইয়ের

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২১, ১২:০৮ এএম

শ্যামল দত্ত শাহরিয়ার ভাই অর্থাৎ আমাদের সবার প্রিয় সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার, যিনি আজীবন অকৃতদার এবং একজন আপাদমস্তক সাংবাদিক। তিনি সহজেই আপন করে নেন সবাইকে। পাকিস্তানের একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার মনে করে শাহরিয়ার ভাইকে বিয়ে করানোর কথা। সময়টা ১৯৯৩ সালের অক্টোবর মাস। আমি তখন পেশায় একেবারে নবীন। গিয়েছিলাম পাকিস্তানে নির্বাচন কভার করতে। শাহরিয়ার ভাই ঝানু সাংবাদিক, দীর্ঘদিন কাজ করেছেন পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকায়। শুরুটা আমাদের করাচি দিয়ে। একই ফ্লাইটে নামার পর আমাকে বললেন, ‘কোনো চিন্তা করো না, আমার সঙ্গে থাকো।’ সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শাহরিয়ার ভাইয়ের সঙ্গে ছিলাম। এক অসাধারণ মানুষ- নবীন সাংবাদিকদের জন্য অনন্য এক বন্ধু। বহু তরুণ সাংবাদিক তার পাশে ছিলেন- শাহরিয়ার ভাইয়ের এই স্নেহ নিয়ে। আমার সৌভাগ্য- বহু গুণী ব্যক্তিত্বের, বিশেষ করে সাংবাদিকতা জগতের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। এর মধ্যে এপির সাবেক ব্যুরো চিফ হাসান সাঈদ, এবিএম মূসা, জগলুল আহমেদ চৌধুরী, কামাল লোহানী এবং হাসান শাহরিয়ারসহ আরো অনেকে। তাঁরা আজ সবাই প্রয়াত। মুসা ভাই কখনো তুই করে ছাড়া সম্বোধন করতেন না। বড় স্নেহের ডাক ছিল সেটা। হাসান সাঈদ ভাই একবার আমাকে এপিতে যোগ দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। জগলুল ভাইকে একবার আমার বাসায় ব্যাচেলর থাকতে ১৯৯৪ সালে খাইয়েছিলাম, সেই গল্প ২০১৪ সালে মৃত্যুর আগেও করতেন। আর শাহরিয়ার ভাই অগ্রজের মতো আগলে রাখতেন আমাকে। পাকিস্তান থেকে ফিরতেই তিনি আমাকে ডাকলেন কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখায়। সবে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে এই সংগঠনটি গড়ার। সেই থেকে আমরা তার নেতৃত্বেই এগিয়ে নিয়েছি এই সংগঠনকে। তার কাছ থেকে শিখেছি কীভাবে সবাইকে ম্যানেজ করে সংগঠন করতে হয়। এখনো এটি একটি সংগঠন যেখানে আমরা সকল মত ও আদর্শ নিয়েও একসঙ্গে কাজ করছি। তার নেতৃত্বে কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন (সিজেএ) ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলন করেছি ঢাকায় ২০০৩ সালে। প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে উদ্বোধন, বিরোধীদলীয় নেত্রীকে দিয়ে সমাপনী অনুষ্ঠান পৃথিবীর কোনো সিজেএ সম্মেলনে এ রকম হয়নি। প্রায় ৫০টি দেশের দুই শতাধিক সাংবাদিক ঢাকা এসেছিল এই সম্মেলনে যোগ দিতে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই সম্ভবত সবচেয়ে বড় সাংবাদিক সমাবেশ। বিদেশি সাংবাদিকদের নিয়ে আমরা গিয়েছিলাম ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ফুল দিতে। কমনওয়েলথের সাংবাদিকরা একসঙ্গে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। তারপর শাহরিয়ার ভাইয়ের সাথে পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরেছি- একসঙ্গে সিজেএর নানা সম্মেলনে- যুক্তরাজ্য, মাল্টা, নাইজেরিয়া, মালয়েশিয়াসহ আরো নানা দেশে। দেশের ভেতরেও গেছি নানা শহরে। আমরা যারা কূটনৈতিক সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম- পেশার প্রথম দিকে তারা দেখেছি কীভাবে আন্তর্জাতিক বিষয়ের ওপর দক্ষতা অর্জন করতে হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির নানাদিক নিয়ে তার কাছে আমরা শিখেছি অনেক। পাকিস্তানে দেখেছি- তাকে সেখানকার সাংবাদিকরা কীভাবে শ্রদ্ধা করে। করাচি প্রেসক্লাবের জেনারেল সেক্রেটারি আবদুল হামিদ ছাপরা কেন শাহরিয়ার ভাই বলতে অজ্ঞান তা বোঝা কঠিন নয়। এমনকি ভারতের অনেক সিনিয়র সাংবাদিক মহেন্দ্র ভেদ, আশীষ চক্রবর্তী বা এন রামের মতো সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর বন্ধুত্বের। সেই সুবাদে আমাদের তুমুল আড্ডা চলতো করাচি প্রেসক্লাবে। কিন্তু সন্ধ্যা হওয়ার আগেই দেখতাম দুই হাতে লিখে বাংলা ও ইংরেজিতে কপি পাঠাচ্ছেন শাহরিয়ার ভাই। বাংলায় পাঠাচ্ছেন ইত্তেফাকে, ইংরেজিতে পাঠাচ্ছেন ভারতের প্রখ্যাত দৈনিক ডিকান হেরাল্ডে। আবার বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন নিউজ উইকের জন্য তৈরি করছেন কপি। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতাম- কিভাবে ইন্ট্রো বানাচ্ছেন, হেডিং তৈরি করছেন। আমাদের মতো নবীন সাংবাদিকদের জন্য তিনি ছিলেন এক বিস্ময়। শেষ করব ছোট একটা ঘটনা বলে। নব্বইয়ের শুরুতে শাহরিয়ার ভাই সভাপতি নির্বাচিত হলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের। আমরা তখনো জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য হইনি। কিন্তু শাহরিয়ার ভাইকে নিয়ে আমাদের উৎসাহ-উদ্দীপনার শেষ নেই। বিজয়ের পরদিন প্রেসক্লাবের লবিতে আমরা বসা। আমাদের তখনো ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই। শাহরিয়ার ভাই প্রেসক্লাবে ঢুকে প্রথমেই আমাদের নিয়ে গেলেন ক্যান্টিনে। একসঙ্গে আড্ডা, চা আর প্রেসক্লাবের ঐতিহ্যবাহী ডালপুরি। আড্ডার এক আনন্দময় যাত্রার শুরু সেই থেকে। শাহরিয়ার ভাই কোনো টেবিলে থাকলে সেটা ঢাকা ক্লাব হোক বা প্রেসক্লাব- শাহরিয়ার ভাইকে দেখে অন্য টেবিলে যাওয়া অসম্ভব ছিল। প্রতি বছর ২৫ এপ্রিল শাহরিয়ার ভাই তার জন্মদিনে একটা অনুষ্ঠান করতেন। তবে কাউকে বলেন না এটা তার জন্মদিন।  নবীন প্রবীণ বন্ধু-বান্ধবদের এক মিলনমেলা এই অনুষ্ঠান। সুদূর সিলেট থেকে প্রয়াত মন্ত্রী শাহরিয়ার ভাইয়ের বন্ধু সৈয়দ মহসিন আলী থেকে চট্টগ্রামের ওসমান গণি মনসুর- কেউ বাদ যান না অনুষ্ঠানে। আমার জন্য অবধারিত এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ আমার স্ত্রীসহ। হাতে একটা ছোট্ট উপহার তুলে দিতেই শাহরিয়ার ভাই বলবেন- নিশ্চয়ই আমার বোন (অর্থাৎ আমার স্ত্রী) একটা পাঞ্জাবি পাঠিয়েছে। প্রতি বছর সে শাহরিয়ার ভাইকে একটা পাঞ্জাবি দেবেই। কয়েকদিন আগে কথা হল। অনুরোধ করলেন তার নতুন একটি প্রকাশিত বই ‘যাকে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’ বইটির প্রচ্ছদ ছেপে দেয়ার জন্য। ছেপে দিয়ে ফোন করলাম। কথাও হল। জানালেন শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। গত ১০ এপ্রিল তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আজ শাহরিয়ার ভাই আমাদের মাঝে নেই। তাঁর চিন্তা, চেতনা ও আদর্শ আমাদের মাঝে প্রেরণা জোগাবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App