×

সাময়িকী

নির্জন অথচ দুর্বার যার কাব্যভাষা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২১, ১২:০৫ এএম

নির্জন অথচ দুর্বার যার কাব্যভাষা
রহীম শাহ প্রখ্যাত কবি শঙ্খ ঘোষও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ২১ এপ্রিল ২০২১, বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় কলকাতার নিজের বাসায় ৯০ বছর বয়সে দুই বাংলার জাগ্রত বিবেক খ্যাত এই কবি পাড়ি দিলেন পরপারের উদ্দেশে। সেই সঙ্গে বাংলা কবিতার ও বাংলা সাহিত্যের একটি যুগের অবসান হলো। কয়েক মাস ধরে শারীরিক নানা সমস্যায় কাতর ছিলেন শঙ্খ ঘোষ। গত ২১ জানুয়ারি অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালেও কাটান কয়েক দিন। বাসায় ফিরে চিকিৎসার মধ্যেই ছিলেন। এই আবহে কিছুদিন আগে জ্বর আসে শঙ্খ ঘোষের। সঙ্গে পেটের সমস্যা দেখা দেয়। এরপর তার করোনা টেস্ট করা হয়। ১৪ এপ্রিল বিকেলে রিপোর্ট এলে জানা যায়, তিনি সংক্রমিত হয়েছেন। তাই কোভিড সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ঝুঁকি না নিয়ে বাড়িতেই আইসোলেশনে ছিলেন। কিন্তু তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। ক্রমেই তাঁর অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমছিল। এক সময় তাঁকে ভেন্টিলেটরে দেয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে চলে গেলেন কবি। বাংলা কবিতার জগতে শঙ্খ ঘোষের অবদান অপরিসীম। ‘দিনগুলি রাতগুলি, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’ তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ হিসেবেও তার নামডাক ছিল। ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’ তার উল্লেখযোগ্য গবেষণা গ্রন্থ। ‘শব্দ আর সত্য, উর্বশীর হাসি, এখন সব অলীক’ উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ। তার লেখা ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ, জন্মদিনে, আড়ালে, সবিনয়ে নিবেদন, দিনগুলি রাতগুলি, বাবরের প্রার্থনা’ বছরের পর বছর দুই বাংলায় চর্চিত, জনপ্রিয়। দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে একাধিক সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন শঙ্খ ঘোষ। ১৯৭৭ সালে ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থটির জন্য তিনি দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান। ১৯৯৯ সালে কন্নড় ভাষা থেকে বাংলায় ‘রক্তকল্যাণ’ নাটকটি অনুবাদ করেও সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান তিনি। এ ছাড়া রবীন্দ্র পুরস্কার, সরস্বতী সম্মান, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৯৯ সালে বিশ্বভারতীর দ্বারা দেশিকোত্তম সম্মানে এবং ২০১১ সালে ভারত সরকারের পদ্মভূষণ সম্মানে সম্মানিত হন শঙ্খ ঘোষ। শঙ্খ ঘোষের অনেক পরিচয়Ñ কবি, গদ্যশিল্পী, সমালোচক, অধ্যাপক। অনেকেই তাকে বর্তমান বাঙালি জাতির জাগ্রত বিবেক বলেও মনে করেন। তার বহুমুখী সত্তার পরিচয়জ্ঞাপক একাধিক গ্রন্থ এবং ছোটবড় বিভিন্ন পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শঙ্খ ঘোষ দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। ফলে তার অসংখ্য গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রী রয়েছেন, যারা উত্তর জীবনে নিজেরাও কৃতী হয়েছেন। পঞ্চাশের কবিদের অন্যতম কবি শঙ্খ ঘোষ। প্রতিবাদী বিশ্বের কবি শঙ্খ ঘোষ। কবি শঙ্খ ঘোষ বাংলা সাহিত্যের বহুমুখী প্রতিভার প্রতিনিধি। তিনি কবি, তিনি প্রাবন্ধিক, তিনি কিশোর ঔপন্যাসিক, তিনি সাহিত্য সমালোচক এবং তিনি রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ। তার সময়ের কবিদের মধ্যে মানসিকতা ও জীবনদর্শনে তিনি অন্যান্য কবিদের থেকে আলাদা। তার কবিতার ভাবের সঙ্গে কারও মিল নেই ও ভাষার সঙ্গে কারো মিল নেই। শুধু তা-ই নয়, কবিতায় অনায়াস প্রতিবাদও অন্যদের চেয়ে পৃথক। ছন্দের মোহময় কারুকাজে কবিতাকে শিল্পের অনন্য উচ্চতায়। কবির বিখ্যাত ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ কবিতায় তার শৈল্পিক রূপ স্পষ্টÑ ‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি তোমার জন্য গলির কোণে ভাবি আমার মুখ দেখাব মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।’ কবিতায় সংহত আবেগের আত্মমগ্ন কবিতা রচনা করেন শঙ্খ ঘোষ। তবু তিনি প্রতিবাদী কবি হিসেবে চিহ্নিত। কবির প্রতিবাদ কখনো মৃদু, কখনো উচ্চকিত। তিনি সময়ের দগদগে ক্ষত চিহ্নিত করেই কবিতা রচনা করেন। আর ব্রতী হয়েছেন ক্ষমতাবানদের তর্জনী উৎক্ষেপণে। কোচবিহারে খাদ্য-আন্দোলনের মিছিলের ওপর পুলিশের গুলিতে কিশোরী হত্যার প্রতিবাদে শঙ্খ ঘোষকে লিখতে হয়েছিল : ‘নিভন্ত এই চুল্লিতে তবে একটু আগুন দে। হাতের শিরায় শিখার মতন মরার আনন্দে।’ কবিতাটি প্রতিবাদী কবিতাবিশ্বে আগুনের ফুলকি হিসেবে আবির্ভূত হয়। তৃণমূল মানুষের যন্ত্রণা, শাসক ও শোষকের আস্ফালন কবির হৃদয়ে নিদারুণ ক্ষতের সৃষ্টি করায় কবির প্রতিবাদী সত্তা জেগে ওঠে। ‘যমুনাবতী’ কবিতায় একদিকে উঠে এসেছে ব্যর্থ শাসক-শোষকের প্রতি কবির তীব্র ঘৃণা। আবার প্রাণ জাগানো প্রতিবাদও লক্ষণীয়। প্রাবন্ধিক ড. শিশির দাশের মতে, ‘একটি ব্যক্তিমুখী, এর নির্জনতা সন্ধানী ব্যক্তিসত্তার আত্মকথা, সংকেতময় ভাষায় ও প্রতিমায়, মৃদুকোমল ছন্দস্পর্শে অনুত্তেজিত কণ্ঠস্বরে এই কাব্যধারা বিশিষ্ট; অন্যধারাটি চারপাশের জগতের অসঙ্গতি, সমাজের বৈষম্য ও অমানবিকতার প্রতিক্রিয়ায় বিচলিত ও ক্রুদ্ধ এক ব্যক্তিমনের প্রতিবাদের ধারা, তা মূলত বিদ্রুপে ও ব্যঙ্গে, কখনো স্পষ্ট ও তীব্র, কখনো বেদনায় ও যন্ত্রণায় গভীর। শঙ্খ ঘোষের কবিতা শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্র, পুলিশ-প্রশাসনিক ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরব এমনটা নয়, ক্ষমতার অন্যান্য কেন্দ্রকেও তিনি তীক্ষè বাক্যশরে বিদ্ধ করেন। ‘চিরকালই যে প্রান্তিক মানুষ অত্যাচারিত হয়, তাদের রক্তে রচিত হয় নিত্যনতুন জালিয়ানওয়ালাবাগ।’ Ñএ সত্যই বারবার কবির কবিতায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রতিবাদী চেতনার আন্তরিক প্রকাশ কবি শঙ্খ ঘোষকে স্বতন্ত্র করেছে। তিনি ক্ষমতার কাছে কখনো আত্মসমর্পণ করেননি। ক্ষমতাতন্ত্রবিরোধিতাই প্রকৃত কবির কর্তব্যÑ তিনি তা বারবার অজস্র কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। পৃথক পর্যবেক্ষণ শক্তি, সংবেদনশীল মানস এবং অনুভবভেদ্য দৃষ্টিলোক থেকে কবি শঙ্খ ঘোষ জীবন ও সমাজ-সংসার পর্যবেক্ষণ করেছেন। যে কারণে তার কবিতা জীবনঘনিষ্ঠ এবং একই সঙ্গে প্রবহমান সময় ঘনিষ্ঠও বটে। শঙ্খ ঘোষ তার অর্জিত অভিজ্ঞতা ও অনুভব নানা আঙ্গিকে কবিতায় প্রকাশ করেছেন। অপরদিকে চিত্রকল্প, প্রতীক, ছন্দ-অলংকার এবং মিথ-পুরাণের ব্যবহারে কবিতাকে করে তুলেছেন শিল্পসমৃদ্ধ। কখনো পুরনো বা প্রচলিত শব্দ দিয়েও তিনি নতুন আস্বাদের কবিতা সৃষ্টি করেন। নতুন শব্দ তৈরি না করলেও তিনি নতুন বোধ নির্মাণ করেন। ফলে তার কবিতা সাধারণ শব্দের মাধ্যমে অসাধারণ ভাব প্রকাশের বাহক হয়ে ওঠে। কবির ভাষায়, ‘নতুন শব্দের সৃষ্টি নয়, শব্দের নতুন সৃষ্টিই কবির অভিপ্রায়।’ কবিতায় অলংকারের সফল প্রয়োগ, ছন্দের সুষম বন্ধনকে আরো প্রাণস্পর্শী করে তোলে অলংকারশৈলী। অলংকারের ব্যবহার কবিতাকে সুখপাঠ্য করার পাশাপাশি কবিতাকে করে তোলে ব্যঞ্জনাময়। কবি শঙ্খ ঘোষ কবিতায় অলংকার প্রয়োগে মুনশিয়ানাও চোখে পড়ার মতো। শঙ্খ ঘোষের ভাষারীতি কথ্য হলেও কবিতার বোধ নানা মাত্রিক। কবিতার ভাষা সরল হলেও ভাবটা জটিল এবং বহুরৈখিক। কী নির্জন, অথচ কী দুর্বার ও শক্তিমান তার কাব্যভাষা। এখানেই তাকে একেবারে স্বতন্ত্র মনে হয় জীবনানন্দ দাশ পরবর্তী অগ্রগণ্য কবিকুলের মাঝে। মূলত সহজ শব্দের প্রয়োগনৈপুণ্যে তার কবিতা স্বতন্ত্র ভাষারীতি নির্ভর করে। শঙ্খ ঘোষের কবিতা পাঠককুলকে জানিয়ে দেয়, বিদ্রোহ মানেই অশালীন দাহন নয়, প্রতিবাদ মানেই নিষ্ঠুর আক্রমণ নয়। তার বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, প্রশ্ন জড়িয়ে থাকে ভালোবাসায়। এই ভালোবাসা ব্যক্তিকে জগতের সঙ্গে যুক্ত করে। ব্যক্তি যে বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব নয়, এই অমোঘ সত্য সহজে ভুলে যাওয়া গোষ্ঠীর মধ্যে থেকে এই কবি কেবলই স্মরণ করিয়ে চলেছেন। এখানেই প্রেম হয়ে ওঠে ভালোবাসা। প্রেমের তুমি-আমি, প্রেমের আত্মপ্রতিকৃতি সকলের স্রোতে মিশে ভালোবাসা আখ্যা পায়। শঙ্খ ঘোষের মতে, ‘সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়। দৈনন্দিন কথাবার্তার চাল, তার শ্বাস-প্রশ্বাস, যথাসম্ভব তার কাছাকাছি থেকে বলা। এসবকে বলেছিলাম সহজ। কিন্তু তার থেকে যে অনুভূতিটা পৌঁছায় তাতে হয়তো অনেক জট-জটিলতা থাকতে পারে। আসলে, ভাষার বা কথার নানা রকমের তল তৈরি হতে থাকে তখন। একদিকে সহজ সীমায় সময়টাকে ধরে রাখতে পারে যে ভাষা, সে কিন্তু অন্যদিকে আবার গড়িয়ে যেতে পারে অনেক দূরে।’ শঙ্খ ঘোষের আসল নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। তার বাবা মণীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং মা অমলা ঘোষ। ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বর্তমান চাঁদপুর জেলায় তার জন্ম। বংশানুক্রমিকভাবে পৈতৃক বাড়ি বরিশালের বানারীপাড়ায়। তবে শঙ্খ ঘোষ বড় হয়েছেন পাবনায়। বাবার কর্মস্থল হওয়ায় তিনি বেশ কয়েক বছর পাবনায় অবস্থান করেন এবং সেখানকার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫১ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে শঙ্খ ঘোষ যাদবপুর ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৯২ সালে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে নানা ভূমিকায় দেখা গেছে কবিকে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্বভারতীর মতো প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনাও করেছেন। ইউনিভার্সিটি অব আইওয়ায় ‘রাইটার্স ওয়ার্কশপ’-এও শামিল হন। তার সাহিত্য সাধনা এবং জীবনযাপনের মধ্যে বারবার প্রকাশ পেয়েছে তার রাজনৈতিক সত্তা। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে বারবার তাকে কলম ধরতে দেখা গেছে। প্রতিবাদ জানিয়েছেন নিজের মতো করে। ‘মাটি’ নামের একটি কবিতায় নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App