তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২১, ১২:০৬ এএম
মোহাম্মদ সাদিক
ঢাকায় পড়তে আসি সত্তরের শুরুর দিকে। তখন ঢাকায় সুনামগঞ্জের চেনাজান লোক কম ছিল। সত্তর দশকের সাংবাদিকতায় হাসান শাহরিয়ার তখন আমাদের কাছে অনেক পরিচিত নাম। ইত্তেফাকের চিফ রিপোর্টার হাসান শাহরিয়ারকে দেখার জন্য ইত্তেফাকে যাই। সুদর্শন মানুষ আরো দুয়েকজন সহকর্মী বা সাক্ষাৎপ্রার্থীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। সুনামগঞ্জের পরিচয় দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বুঝতে পারছিলাম, ব্যস্তও আছেন তিনি। মনে হলো, ইত্তেফাকে ভালোই আছেন তিনি। তখনও সাংবাদিকতায় তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবন সম্পর্কে জানা নেই। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে তিনি পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে সাংবাদিক হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি হিসেবে অনেক সুনাম কুড়িয়েছেন। এসব খুব বেশি জানা ছিল না। কিন্তু তাকে দেখে তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্বে আমরা মুগ্ধ হই। দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি, মাঝে মাঝে দেখা হতো তাঁর ভাই হোসেন তওফিক চৌধুরীর সঙ্গে, তিনিও সাংবাদিক। ঢাকায় দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় কাজ করলেও পরে তিনি আইনজীবী হিসেবে সুনামগঞ্জের বারে যোগদান করেন। একজন অসাধারণ সদালাপী মানুষ তওফিক ভাই আমাদের প্রজন্মের কাছে আইনজীবীর চেয়ে সাংবাদিক পরিচয়েই পরিচিত ছিলেন। ভাটি বাংলার এই ভ্রাতৃযুগলকে আমরা চিনতাম, কিন্তু তাঁদের পিতা মকবুল হোসেন চৌধুরীর বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে জানতাম না, পরবর্তীকালে তাঁদের সাংবাদিকতায় রাজনীতিতে আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের একটি অধ্যায় ছিলেন।
২.
লাউড় এলাকা তথা সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার বিন্নাকুলি গ্রামের সূত্র ধরে উঠে আসা এই পরিবার সুনামগঞ্জের সাংবাদিকতার জগতে এক অনন্য আলোর প্রতীক। শাহরিয়ার ভাই অকৃতদার পুরুষ, জীবনের যাবতীয় আনন্দকে আবিষ্কার করেছেন তাঁর কর্মে, তাঁর প্রাণপূর্ণ হাসি আর আকর্ষণীয় বাচনশিল্পে। তাঁর সঙ্গে সময় কাটানো যে-কারও জন্য একটি বিরল অভিজ্ঞতা। অসাধারণ অতিথি-বৎসল শাহরিয়ার ভাই বহুবার আমাদের আপ্যায়িত করেছেন আগ্রহের অসাধারণ মমতায়। যে কোনো অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি সবাইকে প্রীত করতে দেখেছি। তাঁর হিউমার সামাজিকতার সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়েছে। হিউমারকে শিল্পিত প্রকাশের বিষয়ে তাঁর মুন্সিয়ানা সবাইকে প্রীত করেছে। বয়সের ব্যবধান দিয়েছে কমিয়ে আমরা তাই তাঁর সান্নিধ্যে এক অনির্বচনীয় আনন্দে আপ্লুত হই।
৩.
সুনামগঞ্জ জুবিলি স্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি। জুবিলি স্কুলের সুনামগঞ্জের ১২৫তম বর্ষ উদযাপনের একটি অসাধারণ উদ্যোগ গ্রহণ করেন সুযোগ্য জুবিলিয়ানগণ। ঢাকায় এই অনুষ্ঠানের স্মরণিকা প্রকাশের জন্য যাদেরকে সম্পৃক্ত করা হয়, তাঁদের মধ্যে শাহরিয়ার ভাই ছিলেন, তাঁর আন্তরিকতায় দেখেছি, এ কাজটি সহজ হয়েছে। প্রেসের ছোট পরিসরে তাঁর সঙ্গে আমি নিবিড়ভাবে কাজ করার সুযোগ পাই। দূর থেকে দেখা হাসান শাহরিয়ার ভাইকে কাছে পেয়ে, একসঙ্গে কাজ করে আমাদের মুগ্ধতা বাড়ে। তার লেখা ‘অতীত অতীত নয়’, বইয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা পাঠ করে আমরা মুগ্ধ হই।
৪.
জুবিলি স্কুলের স্মরণিকা ‘জুবিলীর জানালায়’ প্রকাশের সময় তাঁর অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য আমাদের সবাইকে যেমন প্রেরণা দিয়েছে, আনন্দ দিয়েছে, ঠিক তেমনি শাহরিয়ার ভাইকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ করে দিয়েছে। এককালে সুনামগঞ্জের সাংবাদিকতার ইতিহাস উজ্জ্বল করেছিলেন তাঁর পিতা। সফল উত্তরাধিকার হিসেবে তিনি এবং তাঁর ভাই সুনামগঞ্জের সাংবাদিকতার ইতিহাস আলো করেছেন। সুনামগঞ্জের মাটিতে এখন অনেক তরুণ মেধাবী সাংবাদিকের আবির্ভাব আমাদের জন্য আনন্দ ও গৌরবের বিষয়। এদের পথিকৃৎ হিসেবে শাহরিয়ার ভাই, তওফিক ভাই এবং তাদের পিতা অনেক অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। একদিকে তার মতো ধীরস্থির স্থিতধী ব্যক্তিত্ব অন্যদিকে তাঁর প্রাণবন্ত মানবিক গুণাবলি আমাদের আপ্লুত করেছে। অগ্রজপ্রতিম এই মানুষ সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রইলো।