×

মুক্তচিন্তা

করোনা ও সাম্প্রদায়িকতার দহনকাল

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২১, ১২:০৫ এএম

বাংলাদেশ নামক ঐতিহ্যবাহী ভূখণ্ডটির সৃষ্টি ও তার পথচলা কখনো মসৃণ ছিল না। এখনো নেই। মসৃণ করে, সুন্দর করে পথ পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করলেও আছে সেখানে শতেক বাধা। বাংলাদেশের বয়স ৫০ বছর পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু একটি স্বাভাবিক বাংলাদেশের রূপ পেতে আমরা বারবার হোঁচট খাচ্ছি। সমগ্র পৃথিবী করোনার করাল গ্রাসে আক্রান্ত। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। পৃথিবী থেকে এর মধ্যে বিদায় নিয়ে চলে গেছে প্রায় ৩০ লাখের কাছাকাছি মানুষ। ভেঙে পড়েছে সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সামগ্রিক অর্থে গোটা মানবজীবন। আশা করা হয়েছিল এসব করুণ মৃত্যুর দৃশ্য দেখে মানবজাতির মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করা যাবে। কিন্তু কার্যত কোনো পরিবর্তন আসেনি মানবসমাজের ভেতরে। লোভ, ক্রোধ, হিংসা, জিঘাংসা, রিপুর তাড়না ও আত্মকেন্দ্রিকতা ঠিকই বিদ্যমান আগের মতোই। পৃথিবীতে বর্তমান সময়ে মানবচরিত্রই আসলে এক বিস্ময়! শত, সহস্র মৃত্যুর ভেতর দিয়েও এরা এদের অসৎকর্মে, স্বার্থসিদ্ধিতে নিয়োজিত থাকতে পারে অবলীলায়। পৃথিবীর ক্রন্দন এদের কর্ণকুহুরে প্রবেশ করে না। পৃথিবীর অন্য দেশগুলো যেখানে করোনার ধাক্কা সামলাতে মরিয়া সেখানে বাংলাদেশকে মরিয়া হতে হচ্ছে করোনা ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সামাল দিতে। মানে সোজা কথায় গোঁদের ওপর বিষফোড়ার মতো। করোনা মহামারির প্রথম ধাক্কাটা বর্তমান সরকার ভালোভাবেই সামলে উঠেছিল। দ্বিতীয় ঢেউটা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশের পরতে পরতে। এক, দুই করে এখন একশর ওপর মানুষের মৃত্যু হচ্ছে প্রতিদিন! হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের বেডগুলো দ্রুতই ফুরিয়ে যাচ্ছে। আশার কথা সম্প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত এক হাজার শয্যার একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। যার মাধ্যমে কিছু মানুষের নিশ্বাস নেয়ার একটা জায়গা তৈরি হবে। করোনা মোকাবিলায় বহুক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা পরিদৃষ্ট হলেও নেই বাংলাদেশের মানুষের করোনা সম্পর্কিত ব্যাপক সচেতনতা। একশ্রেণির মানব সম্প্রদায় আছে যারা বিশ্বাসে আবদ্ধ; তাদের দৃষ্টিতে মাস্ক পরার কোনো প্রয়োজন নেই, নেই টিকা নেয়ারও কোনো দরকার। এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। পৃথিবীর বহু দেশে বিভিন্ন ধর্মালয় পর্যন্ত বন্ধ আছে। বাংলাদেশ একমাত্র তার ব্যতিক্রম। কারণ সরকার এটা করলে তাদের গদি রক্ষা করা দায় হয়ে পড়বে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধর্মীয় কাজগুলো পালনের নির্দেশ দিয়েছে সরকার; তার কতটুকু পালন হচ্ছে সেটার ব্যাখ্যার আর প্রয়োজন পড়ে না। এখন লকডাউন চলছে, লকডাউন বৃদ্ধি করা হয়েছে। তা নিয়েও রয়েছে নানা শ্রেণির নানা মত। হ্যাঁ, এটা তো ঠিক যে, লকডাউনের ফলে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু কঠিন হয়নি কার? সমাজের নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির সংকট আরো প্রবল। এরা তো কারো কাছে যেতে পারেন না, হাত পাততে পারেন না। এই শ্রেণিটি গুমড়ে কাঁদছে। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে লজ্জা ছেড়ে সরকারি সহায়তা গ্রহণ করুন, কেননা এটাতেও আপনাদের অধিকার রয়েছে। কিন্তু সেটা প্রকৃতপক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। কার্যক্ষেত্রে তা অনেকের কাছে এর চেয়ে মৃত্যু ভালো বলে বিবেচিত হবে। এই রকম একটা পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে তবুও বাংলাদেশ তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলছে। সরকার মনে করছে মানুষ বেঁচে থাকলে বাংলাদেশকে স্বমূর্তিতে ফিরিয়ে আনতে খুব বেশি দেরি হবে না। সেক্ষেত্রে সরকার সর্বাগ্রে মানুষের জীবন বাঁচাবার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। অবশ্য এর জন্য দরকার সুষ্ঠু পরিকল্পনা, কর্মপন্থা প্রণয়ন ও মানবজীবনমুখী চিন্তা। স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে সরকারের সহযোগিতা নিয়ে চরম এই দুঃসহ দিনে সত্যিকার ভুক্তভোগী মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে শুধু আন্তরিক হলেই চলবে। চরম ভাবাপন্ন, মুমূর্ষু স্বদেশের এসব দিনে তার ওপর জগদ্দল পাথরের ওপর চেপে বসেছে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। অবশ্য এই চিত্র তো নতুন নয়। সরকারকেও নানাভাবে এদের সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বাংলাদেশে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে এই আপ্ত বাক্যটি যারা এখন বলেন, তারা ভুল বলেন; বরং এই অপশক্তি দীর্ঘকাল ধরেই এখানে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে। এ দেশের রাজনীতিতে তাদের তো একাধিক দল শক্তি, সাহস ও অর্থ সঞ্চয় করে থাকে রাজনীতির নিয়মেই আর তাদের স্বার্থে। তার ওপর আছে আন্তর্জাতিক অর্থ সহায়তা। এগুলো সুবিদিত। সরকার যে জানে না তা তো নয়। বাংলাদেশে জামায়াতি রাজনীতিকে যখন একটি ধারায় আনার চেষ্টা চলেছে তখনই তারা রূপ পরিবর্তন করে হেফাজতিদের ঘাড়ের ওপর ভর করেছে। তারপরেও সরকার হেফাজতিদের জন্য তো কম করেনি। কওমি মাদ্রাসার সমমনা দেয়া হয়েছে, তাদের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ধরে নিলাম ইসলামি শিক্ষা বিস্তারে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। তাতে সমস্যা নেই। সমস্যা হলো, যাদের দুধ-কলা দিয়ে পোষ্য বানানোর চেষ্টা চলল, তারাই তো আবার ফণা তুলে প্রতিদিন ঠোকর মারার চেষ্টা চালায় অবিরত। সমগ্র বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগগুলোতে এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তাদের রাজনীতির কুৎসিত রূপ প্রদর্শন করে। প্রকাশ্য দিবালোকে ইসলামের নাম করে নানা জায়গায় কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য প্রদর্শন করে, মিথ্যা তথ্য প্রদান করে। আর এসব তো নতুন নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আর এসব কিছু ঘটে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সম্মুখ দিয়েই। কখনো কখনো দেখা গেছে স্থানীয় সরকারদলীয় ব্যক্তিরা, নেতারাও এই ধর্মীয় উসকানিদাতাদের দিয়ে দীর্ঘ রাত পর্যন্ত ধর্মীয় বক্তব্যের নামে বানানো বানোয়াট সব ধর্মীয় ব্যাখ্যা প্রদান করছে। অতএব এ দায় শুধু মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর নয়। বাংলাদেশের পরতে পরতে, আনাচে-কানাচে এসব দেশবিরোধী তথাকথিত ধর্মীয় গুরুদের অবাধ বিচরণ ও ধর্মীয় অপব্যাখ্যায় মানুষ শান্তির ধর্ম ইসলামের শিক্ষা গ্রহণের বিপরীতে তারা শিখছে ভুল ইসলাম ও জঙ্গিবাদী চিন্তা। এগুলো নির্মূলে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকরী পদক্ষেপের চেয়ে বরং বহুক্ষেত্রেই নমনীয়তা পরিদৃষ্ট হয়েছে। এ দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তিরা দিনের পর দিন উসকানিমূলক ধর্মীয় বক্তব্য প্রদান করে দেশের নানা প্রান্তরে নৈরাজ্য, খুন, জখম, হত্যা সংঘটিত করেছে। তার সুবিচার চায় বাংলাদেশ। একটি স্বাভাবিক বাংলাদেশ দেখতে চায় দেশের আপামর জনগোষ্ঠী। এই উগ্র জঙ্গিবাদী শ্রেণি বিভিন্ন মিডিয়ায়, চ্যানেলে বক্তব্য ধারণ করেও প্রচার করে। কারা তা করে এটা ধরা বা বোঝা খুব কঠিন কাজ নয়। দেশে একটা সময় ব্যাপকহারে মেধাবী ব্লগারদের দিনের পর দিন, একের পর এক হত্যা করা হয়েছে। তারা এখন তাদের সুবিচার ও সুশাসনের অপেক্ষায়। স্বাধীন বাংলাদেশে, প্রগতিবাদী সরকারের শাসনামলে বহু প্রগতিশীল লেখক, রাজনীতিককে হত্যা করেছে এসব মিথ্যা ধর্ম প্রচারকারী সম্প্রদায়। তাদের বিরুদ্ধে সরকার তখন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। যা ফলে আজকে দেশের এই অরাজকতায় তারা সাহস দেখিয়েছে। করোনাকালে বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। অথচ বন্ধ রাখেনি মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষত কওমি মাদ্রাসা। তারা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরীক্ষা কার্যক্রম চালিয়েছে সরকারের মুখের ওপর দিয়ে। যে সরকার তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে; সেই সরকারকে তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে হেফাজতিদের লাগামহীন দেশবিরোধী, ইসলামবিরোধী বক্তব্য প্রদান, উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান, বিভিন্ন জায়গায় নৈরাজ্য সৃষ্টি, বহু নারী কেলেঙ্কারির ঘটনায় হেফাজতের কুখ্যাত নেতা মামুনুল হককে সরকার আর উপায়ান্তর না পেয়ে আইনের মাধ্যমেই গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়েছে। বহুকাল ধরে এই হেফাজতি নেতা ইসলাম ধর্মের নাম করে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তরে তার উগ্র বক্তব্য প্রদান করে আসছিল। দিনে-রাতে হাজার হাজার নারী-পুরুষ, ছোট ছোট বাচ্চারা সেসব বক্তব্য শুনে তাকে ধর্মীয় দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত করে ফেলেছিল। সম্প্রতি নানা জায়গায় অন্যের সহধর্মিণীকে চুক্তি করে, অর্থের বিনিময়ে, ভরণপোষণের কথা বলে দেহভোগ করেছে। প্রিয় ইসলামি নেতার এহেন জঘন্য কর্মকাণ্ডে ক্ষিপ্ত হয়েছে তারই অন্ধ, কপট সমর্থকরা। মামুনুলের দল হেফাজতির বড় নেতারা তার ভয়ানক কৃতকর্মের দায় নিতে এখন নারাজ। খুব স্বাভাবিক। এতদিন তাকে ব্যবহার করা হয়েছে, তাকে দিয়ে মিথ্যাচার করানোর কাজে শতভাগ ব্যবহার করা হয়েছে, নারীদেহ ভক্ষণ করা হয়েছে তেঁতুল থিওরির মাধ্যমে; এখন আর তিনি আপনাদের আত্মীয় নন। সঙ্গীর বিপদ দেখলে কেটে পরা! দুদিন আগে তিনিই ছিলেন আপনাদের প্রধান প্রচার গুরু, আর এখন তিনি কেউ নন। এটাও রাজনীতিতে হেফাজতিদের নতুন অপকূটকৌশল। এদের নতুন করে সুযোগ খোঁজার সুযোগ নিশ্চয়ই সরকার দেবে না। বরং তাদের অতীত, বর্তমান সব কর্মকাণ্ড, বক্তব্যগুলো খতিয়ে দেখা হোক; যারা যারা এসব দেশপ্রেমবিরোধী কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যের সঙ্গে জড়িত তাদেরও গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হোক। শুধু বাংলাদেশের নয় গোটা মুমূর্ষু পৃথিবী করোনার চেয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষ কম ভয়ানক নয়। এখন পৃথিবী লড়ছে শুধু করোনার বিরুদ্ধে, বাংলাদেশকে দুনির্বার লড়ে যেতে হচ্ছে দুটির বিরুদ্ধেই। বাঙালি জাতির ইতিহাস পরাজয়ের ইতিহাস নয়। অতএব এ লড়াইয়েও জিততে হবে। ড. বাকী বিল্লাহ বিকুল : সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App