×

অর্থনীতি

ফের চ্যালেঞ্জে পোশাকশিল্প

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২১, ০৯:১৭ এএম

ক্রয়াদেশ বাতিলের শঙ্কায় উদ্যোক্তারা দাম কমে যাওয়ায় লোকসান বেড়েছে

করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারিতে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে রপ্তানি আয়ের প্রধান ক্ষেত্র তৈরি পোশাক খাত। মহামারির প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কা সামলে উঠলেও দ্বিতীয় দফায় আরো নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এই শিল্প। প্রতিমাসেই রপ্তানি আয় কমছে। এরমধ্যে গত বছরের মার্চ থেকে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ক্রয়াদেশ হাতছাড়া হয়েছে। নতুন করে ক্রয়াদেশ বাতিলের শঙ্কায় রয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। ইতোমধ্যে বিশে^র বিভিন্ন দেশে নতুন করে লকডাউনে আবারো নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন রপ্তানিকারকরা। তারা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে ব্যবসায় ঘুরে দাঁড়াতে আরো বেশি সময় লাগবে। কারণ, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো ছয়-সাত মাস পরের অবস্থা কী হবে, সেই পূর্বাভাস দেখে সিদ্ধান্ত নেয়। তাই দ্রুত করোনা পরিস্থিতি উন্নতি না হলে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

জানা গেছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বৈশ্বিক পোশাক আমদানি ২৩ শতাংশ কমে যায়। দেশে দেশে করোনার লকডাউনের কারণে মানুষ পোশাক কেনা কমিয়ে দেয়। ফলে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে জমে পোশাকের স্ত‚প। এতে অনেক ব্র্যান্ড কারখানাগুলোর আগের কার্যাদেশ বাতিল করে, অনেকে দামও কমিয়ে দেয়। তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ করোনায় পোশাক খাতে একটি ক্ষতির হিসাব করেছে। তারা বলছে, গত বছরের মার্চ থেকে পরবর্তী কয়েক মাসে হাতছাড়া হয় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ক্রয়াদেশ। নতুন অর্থবছরের রপ্তানি আয় গত অর্থবছরের তুলনায় পিছিয়ে যেতে শুরু করে। এরপর গত কয়েক মাসে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি অনেকাংশেই কমে যায়। করোনাসহ বিভিন্ন কারণে প্রতি মাসেই কমছে পোশাক রপ্তানি। মাসে এখন গড়ে ৩ বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। এ হারে এগুলে অর্থবছরের বাকি চার মাসে আরো ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার যুক্ত হতে পারে। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরেও পোশাক খাতের মোট রপ্তানি দাঁড়াতে পারে তিন হাজার ৩০০ কোটি ডলার। মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে এখনো বড় ধরনের অর্ডার স্থগিত

হয়নি। তবে অর্ডার ও পোশাকের দাম দুটোই কমেছে। গত অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে গড়ে দাম কমেছে শতকরা পাঁচ ভাগ। জানুয়ারি থেকে মার্চ সময়ে পোশাকের দাম কমেছে ৪ শতাংশের মতো। যা এখন পর্যন্ত খুব একটা উন্নতি হয়নি। যদিও পোশাক রপ্তানি করে লাভ হয় গড়ে শতকরা দুই-তিন ভাগ। ফলে লাভ কমে গেছে বা লোকসান বেড়েছে বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ।

জানা যায়, বর্তমানে বিশ্বের বেশ কিছু দেশে আবারো লকডাউন দেয়ায় সেখানকার খুচরা ক্রেতারা পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। তাই বায়াররাও সতর্ক। তারা আগে যদি একসঙ্গে এক লাখ পিস অর্ডার করত এখন তা পাঁচবারে অর্ডার করছে। এখানে কারখানাগুলো সাধারণত তিন মাস আগে অর্ডার পেত। কিন্তু এখন সেই লিড টাইম পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে কারখানাগুলোকে সক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদন করতে হচ্ছে। এ বিষয়ে ফতুল্লা অ্যাপারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফজলে শামীম এহসান বলেন, দ্বিতীয় ধাক্কায় আমরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমাদের অর্ডার কমে গেছে। করোনার প্রথম ধাক্কায় কিছু অর্ডার স্থগিত হয়েছিল, কিন্তু পরে ক্রেতারা সেগুলো পুনরায় দেয়। কিন্তু সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেছে। গার্মেন্টস এমন একটা ব্যাপার, ফ্লোরে যদি কমপক্ষে ৯০ শতাংশ অর্ডার না থাকে, তাহলে লোকসানে চলতে হয়। আমাদের ফ্যাক্টরিগুলো সেপ্টেম্বরের শেষ থেকেই লোকসানে চলছে।

সম্প্রতি ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল এন্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে গত বছর করোনার সংক্রমণ ছিল অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি। সে কারণে ২০২০ সালে দেশটিতে তৈরি পোশাক আমদানি এক-চতুর্থাংশ কমে যায়। তবে করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে আবারো দেশটিতে পোশাক রপ্তানি বাড়ছে। সেই সুফল বাংলাদেশও পেয়েছে। তবে নতুন করে সংক্রমণ বাড়ায় দেশটিতে পোশাক রপ্তানি নিয়ে আবারো শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান গত বছর ৬ হাজার ৪০৭ কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করে। ২০১৯ সালের চেয়ে এই আমদানি ২৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ কম। তবে চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে বিভিন্ন দেশ থেকে ১ হাজার ৯১ কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করেছে দেশটির ব্যবসায়ীরা, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ কম। জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া এখনো শ্লথ। দেশটির ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান সব ধরনের পোশাক নিলেও পরিমাণে কম। বিপুলসংখ্যক মানুষ টিকা নিলেও দেশটিতে নতুন করে আবার সংক্রমণ বাড়ছে। আসলে করোনার নিত্যনতুন ধরনের কারণে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। ফজলুল হক আরো বলেন, করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে ব্যবসায় ঘুরে দাঁড়াতে আরো বেশি সময় লাগবে। কারণ, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো ছয়-সাত মাস পরের অবস্থা কী হবে, সেই পূর্বাভাস দেখে সিদ্ধান্ত নেয়। তাই দ্রæত করোনা পরিস্থিতি উন্নতি না হলে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যদিও ক্রেতারা সে ধরনের কোনো বার্তা এখনো দেয়নি।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) তাদের এক গবেষণায় বলেছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পোশাক শতকরা ২৩ ভাগ কম নিয়েছে আমদানিকারকরা। এই সময়ে শ্রমিকদের আয় কমেছে ৮ শতাংশ, আর তাদের ওপর চাপ বেড়েছে ৬০ শতাংশ। এদিকে দেশে চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও পোশাক কারখানা চালু রেখেছেন মালিকরা। কেউ কেউ বলছেন, করোনার কারণে কিছুটা হলেও লোকবল কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এদিকে শ্রমিক নেতারা বলছেন, পেটের তাগিদেই শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারখানার আশপাশের শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে পারলেও দূরের শ্রমিকরা ভোগান্তিতে রয়েছেন। মালিক, শ্রমিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। বিজিএমইএর নবনির্বাচিত সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, আমরা বলেছি শ্রমিকদের গড় বয়স ২৩ দশমিক ৯ বছর। এ বয়সিদের করোনা আক্রান্তের হার দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। এ কারণে শ্রমিকদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। সরকারকে এটি বুঝিয়েছি। এছাড়া কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। কারখানা ছুটি দিলে শ্রমিকরা ভোগান্তিতে পড়বে। আর কারখানার পরিবেশ শ্রমিকদের বাসার চেয়ে উন্নত। শ্রমিকদের ৯০ শতাংশ কারখানার আশপাশে থাকে। ফলে তারা গণপরিবহনেও যাতায়ত করবে না। সরকারকে এটি বুঝানোর ফলে সরকার সম্মত হয়েছে। তিনি বলেন, পোশাকসহ সব শিল্প-কারখানা লকডাউনে চালু থাকবে। বাণিজ্যিক পরিবহনও চালু থাকবে। আমরা কারখানায় আগের চেয়ে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চেষ্টা করছি। এ ব্যাপারে শ্রমিকদের আরো সচেতন করা হবে। আর ছুটি পেয়ে শ্রমিকরা গ্রামে গেলে গ্রামেও করোনা সংক্রমের আশঙ্কা বেশি ছিল। সব মিলিয়ে কারখানা খোলা থাকছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App