×

জাতীয়

দ্বন্দ্ব-আতঙ্কে দিশাহারা হেফাজত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২১, ০৯:২৯ এএম

শিগগিরই নতুন কমিটি ঘোষণার তোড়জোড় শফীপন্থিদের

নানা ইস্যুতে বর্তমানে চাপে রয়েছে উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। অর্থ কেলেঙ্কারি ও রিসোর্টকাণ্ডে বিতর্কিত হেফাজতের শীর্ষ নেতা এবং নাশকতার বিভিন্ন মামলায় ধরপাকড়ের মুখে সংগঠনটি এখন কোণঠাসা। প্রশাসনের কঠোর অবস্থানে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার আতঙ্কে রয়েছেন অন্যরাও। এরই মধ্যে সংগঠনটির বিভিন্ন পর্যায়ে দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিশেষ করে সংগঠনটির বর্তমান আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর ঘনিষ্ঠজনদের বেছে বেছে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

এদিকে পদবঞ্চিত হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমেদ শফীপন্থিরা নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টায় ব্যস্ত। বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা শফী হুজুরের অনুসারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন তারা। তাদের অভিযোগ, বর্তমান নেতৃত্বের স্বেচ্ছাচারিতা ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে সংগঠনটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এজন্য লকডাউনের পর বর্তমান নেতৃত্বকে সরিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পাল্টা কমিটি ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। অন্যদিকে গ্রেপ্তার আতঙ্কে শফীবিরোধী বর্তমান কমিটির নেতাদের মধ্যেও বিভক্তি দেখা দিয়েছে। গত ২৬ থেকে ২৯ মার্চ সারাদেশে নাশকতার ঘটনায় এবং মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ডে বিব্রত অনেক নেতাই ইতিমধ্যে পদত্যাগ করছেন।

হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমদ শফীর মৃত্যুর পর গত বছর হেফাজতের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। অভিযোগ ওঠে, সংগঠনের ত্যাগি-সৎ শফীপন্থি নেতাদের সরিয়ে দিয়ে কমিটিতে স্থান করে নিয়েছে শফীবিরোধীরা। কমিটির পদবঞ্চিতরা অভিযোগ তোলেন, হেফাজত অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও একটি রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য, সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীদের কমিটিতে আনা হয়েছে। হেফাজতের নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব নেয়ার কয়েক মাস আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সেই সময় মামুনুল হক বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়ার হুমকি দেন।

এ পরিস্থিতিতে হেফাজতের তাণ্ডব ও হুমকি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছে সরকার। পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে অনেক নেতাকে। বিশেষ করে ২০১৩ সালের মে মাসে রাজধানীর শাপলা চত্বরে জড়ো হয়ে রাজধানীসহ সারাদেশে নাশকতা-তাণ্ডব সৃষ্টির মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এছাড়া স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করে চালানো তাণ্ডবে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হামলার ঘটনায় হেফাজতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সামনে আরো অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হবে।

হেফাজতে ইসলামের সাবেক আমির আহমদ শফীকে মানসিক নির্যাতন করে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগে তার পরিবার গত বছর চট্টগ্রামের আদালতে মামলা করেছিল। সেই মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গত ১২ এপ্রিল আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছে। তাতে হেফাজতের বর্তমান আমির জুনায়েদ বাবুনগরীসহ ৪৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার করা তালিকায় আহমেদ শফী হত্যার তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্ত অনেকের নাম রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর টার্গেটে রয়েছেন হেফাজতে ইসলামের আরও দুই ডজন শীর্ষ নেতা। তাদের গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এ নিয়ে সীমাহীন আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছে হেফাজত নেতারা।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত বছরের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে বিরোধিতা থেকে শুরু করে স¤প্রতি মোদিবিরোধী আন্দোলনে যেসব নেতা সক্রিয় রয়েছেন, তারাই এই তালিকায় আছেন। তালিকাভুক্ত নেতারা সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রয়েছেন। তারা যাতে কওমি মাদ্রাসার সাধারণ শিক্ষার্থীদের উসকানি দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারেন, সেজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতের কর্মীদের মাঠে নামিয়ে নাশকতা-তাÐব চালিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন সভা-সেমিনার ও ওয়াজ মাহফিলে ধর্মীয় প্রচারণার আড়ালে তারা সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে আসছিলেন। এছাড়া তারা রাস্তায় নেমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করে আসছেন। এবার আর হেফাজতের কোনো নেতাকে ছাড় দেয়া হবে না।

আহমেদ শফীপন্থি নেতা হিসেবে পরিচিত হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মাঈনুদ্দিন রুহি ভোরের কাগজকে বলেন, এখন যারা হেফাজতে ইসলামকে পরিচালিত করছেন তারা সারাদেশে সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণœœ করেছেন। নানা অনৈতিক-অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে বর্তমান নেতৃত্ব গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। মামুনুল হক একজন চিহ্নিত জামায়াতপন্থি নেতা। তার উসকানিতেই সারাদেশে নাশকতা পরিচালিত হয়েছে। তাÐব চালানো হয়েছে। হেফাজতে ইসলামকে সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। হেফাজত বর্তমানে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের সংগঠনে পরিণত হয়েছে। অথচ আল্লামা শফী হুজুর হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে।

তিনি বলেন, অরাজনৈতিক কওমি সংগঠনকে পরিকল্পিতভাবে জামায়াত-শিবির, বিএনপির হাতে তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য গঠনতন্ত্র পরিপন্থি অসাংবিধানিক কাউন্সিল করা হয়। কমিটিতে আত্মীয়স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে বেশ কিছু জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মী, অসৎ, নীতিহীন ব্যক্তিকে ঢুকানো হয়েছে। মেয়ের জামাই থেকে শুরু করে মামাতো ভাই, খালাতো ভাই সবাইকে কমিটিতে স্থান দিয়েছেন। অবৈধ এই কমিটি ভেঙে দিয়ে হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে সারাদেশের আলেম-ওলামাদের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়েছে। লকডাউন পরবর্তী সময়ে সবাইকে নিয়ে হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে।

সম্প্রতি দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে সরকার পতনের হুমকি দিয়ে দেশব্যাপী নাশকতা-তাণ্ডব চালানো শুরু করে হেফাজতে ইসলাম। এর মধ্যেই সোনারগাঁওয়ে একটি রিসোর্টে অসামাজিক-অনৈতিক কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগ ওঠে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের বিরুদ্ধে। এছাড়া সংগঠনের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে সংগঠনের বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে। অন্যদিকে বিভিন্ন নাশকতার মামলায় সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ কেন্দ্রীয় কমিটির বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে চরম কোণঠাসা অবস্থায় হেফাজত।

হেফাজতের বর্তমান নেতারাই মনে করছে, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ তাদের বড় ধরনের সংকটে ফেলেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় গত ২৬ মার্চ থেকে তিন দিন ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সহিংসতা করে হেফাজতের নেতাকর্মীরা। পুলিশের থানা আক্রমণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি অফিসে অগ্নিসংযোগসহ নাশকতার নানা ঘটনায়। মোদিবিরোধী বিক্ষোভে ব্যাপক সহিংসতার পর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে একটি রিসোর্টে একজন নারীসহ হেফাজত নেতা মামুনুল হকের অবস্থান করার ঘটনা ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে।

হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী বলেন, ঢাকায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলার পরই বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতা ছড়িয়েছে। তারা বায়তুল মোকাররমে একটা অঘটন ঘটাইছে, অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে। এটাকে কেন্দ্র করেই হাটহাজারীসহ বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতা হয়েছে। মামুনুল হকের ঘটনা হেফাজতের কর্মসূচিতে আসে না। এটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। সব মিলিয়ে এসব ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সরকার আমাদের প্রতিপক্ষ মনে করছে এবং সেটাই নানামুখী সংকট তৈরি করছে। হেফাজত ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা সিরাজুদ্দিন আহমাদ অভিযোগ করেছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হাটহাজারী এবং ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হেফাজতের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার অভিযান চলছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App