×

জাতীয়

লকডাউন কতটা কার্যকর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২১, ০৯:৩৬ এএম

আমলা-পুলিশনির্ভর বিধিনিষেধের পুরো সুফল পাওয়া নিয়ে সংশয়।

পুলিশ ও আমলাদের দিয়ে জনগণের চলাচল নিয়ন্ত্রণ, করোনা মোকাবিলায় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত না করা, জীবনের চেয়ে জীবিকার বেশি তাগিদ, লকডাউন দেখার জন্য অতি উৎসাহীদের ঘরের বাইরে বের হওয়া, নানা ছুতোয় এটা-ওটা কিনতে যাওয়া, বিনা কারণে ঘরের বাইরে এসে আড্ডা দেয়ার মত ঘটনার কারণে চলমান বিধিনিষেধ বা লকডাউনের পুরো সুফল পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। গত ৫ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এই বিধিনিষেধ আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে। এই সময়ের মধ্যে মানুষ ঘরে থাকার কথা থাকলেও নানা ছুতোয় বাইরে আসছে। শুধু গণপরিবহন, রেল, বিমান, লঞ্চ বন্ধ আছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, করোনার সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার জন্য সরকার পুলিশ ও আমলাদের ওপর দায়িত্ব দিয়েছে। পুলিশ ও আমলারা ‘শাস্তি’র ভয় দেখিয়ে মানুষকে ঘরে রাখতে চাইছেন। এমকি করোনা নিয়ন্ত্রণে ৬৪ জেলার সমন্বয় ও মনিটরিংয়ের জন্য যে ৬৪ জন সচিব দায়িত্ব পেয়েছেন তারা একবারো সংশ্লিষ্ট জেলায় যাননি। ঘরে বসেই ওই জেলার ডিসি, এসপি ও সিভিল সার্জনের সঙ্গে জুম মিটিং আর কয়েকটি নির্দেশনা দিয়ে দায় সেরেছেন। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা হলে তা বেশি কার্যকর হতো। কারণ জনপ্রতিনিধিদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা রয়েছে। আর নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও জানেন, কার কি প্রয়োজন অথবা কার সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে। কিন্তু কোনো পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিকে এ কাজে সম্পৃক্ত করেনি সরকার। এর ফলে আমলাদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদেরও দূরত্ব বেড়ে চলেছে। মানুষও অল্পতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছে।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সংসদ সদস্য ভোরের কাগজকে বলেন, সরকার মনে করছে আমলা ও পুলিশ দিয়েই দেশ থেকে করোনা তাড়িয়ে দেবে। ডাণ্ডার ভয় দেখিয়ে কি মানুষকে আটকানো যায়? অতি উৎসাহী কিছু আমলার কারণে আজ জনপ্রতিনিধিরাও ঠিকঠাক মর্যাদা পান না। আমরাও এসব মুখ বুঝে সহ্য করি। যেহেতু সরকার আদেশ জারি করেছে, আমরা এর উল্টো কথা বলতে পারি না। বরং সাধারণ মানুষের মতো আমরাও ঘরে থাকি, তাতে আর যাই হোক করোনা থেকে তো রেহাই পাওয়া যাবে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সাতক্ষীরা জেলার করোনা সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পেয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শেখ ইউসুফ হারুন। দায়িত্ব পেয়ে তিনি সেখানকার ডিসি, এসপি, সিভিলসার্জনসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে জুম মিটিং করে নানা নির্দেশনা দিয়েছেন। ওই জেলায় সংক্রমণ এখনো বেশি হয়নি বলে দাবি তার। তবু মানুষ লকডাউন মানছে না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, বিধিনিষেধ জারি হওয়ার পর থেকে যতজন লোক পুলিশের কাছ থেকে মুভমেন্ট পাস নিয়েছেন, ততজন লোক যদি ঘরের বাইরে আসে তাহলে লকডাউন হবে কি করে? তিনি ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যমে পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, যারা মাগুর মাছ কেনার জন্য মিরপুর থেকে শান্তিনগরে আসে তাদের দিয়ে আপনি কোন আইনে লকডাউন বলবৎ করবেন?

আমলাদের দিয়ে লকডাউন বলবৎ করার কারণেই কি মানুষ করোনার বিধিনিষেধগুলো মানতে চান না- এমন প্রশ্নের জবাবে শিল্প সচিব কে এম আলী আজম ভোরের কাগজকে বলেন, কিছু কিছু মানুষ হয়তো আছেন যারা এসব বিধিনিষেধ মানতে চান না। তারা অবলীলায় কঠোর বিধিনিষেধের অপব্যবহার করেন। তবে এখানে মত-দ্বিমতের বিষয় নয়। যে কোনো মূল্যে সরকারের ঘোষিত লকডাউন কার্যকর করতে হবে। যিনি যে জায়গায় দক্ষ হবেন তাকে সেখানে নিয়োগ দিয়ে কাজ হাসিল করতে হবে। এখন তিনি জনপ্রতিনিধি হন, আমলা হন, পুলিশ হন- সেটা বড় কথা নয়। তবে এও ঠিক শুধু কর্মকর্তাদের কাজে লাগিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। যারা যেখানে দক্ষ তাদের সেখানে কাজে লাগাতে হবে, তবেই না সুফল পাওয়া যাবে। এখন আমলা-জনপ্রতিনিধি পৃথক করার সময় নয়। মানুষকে সংক্রমণমুক্ত রাখাটাই হচ্ছে আসল কাজ। প্রসঙ্গত, শিল্প সচিব বরিশাল জেলার করোনা সংক্রমণের দায়িত্বে। তিনিও সেখানকার ডিসি-এসপিদের সঙ্গে মিটিং করে নির্দেশনা দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংক্রমণমুক্ত রাখতে গিয়ে সরকার কয়েক দফায় যে বিধিনিষেধ জারি করেছে তা দিনে দিনে ‘ঢিলেঢালা’ হয়ে পড়ছে। কিছু মানুষ এই বিধিনিষেধ মেনে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। আরেক দল মানুষ- যাদের ঘরে মন টেকে না। জরিমানার ভয়ে প্রথম দিকে কড়াকড়ি কিছুটা কার্যকর হলেও ‘সর্বাত্মক লকডাউনের’ ষষ্ঠ দিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তাঘাটে মানুষ ও যানবাহনের চলাচল বেড়েছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও সড়কে রিকশা, অটোরিকশা, ব্যক্তিগত গাড়ি চলছে দেদার। ফুটপাতেও বেড়েছে সাধারণ মানুষের চলাচল। তবে সরকারি নির্দেশনা মেনে বন্ধ রয়েছে শপিংমল-বিপণিবিতানগুলো। কাঁচাবাজার সংলগ্ন দোকানপাট ছাড়া বন্ধ রয়েছে অন্যান্য দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও।

লকডাউনের প্রথমদিন গত ১৪ এপ্রিল ঢাকা শহর বলতে গেলে এক রকম ফাঁকা ছিল। প্রথমদিন কড়াকড়ি থাকলেও দ্বিতীয় দিন থেকে ঢাকার রাস্তাঘাটের চিত্র পাল্টাতে থাকে, অল্প সংখ্যায় রিকশা রাস্তায় নামে। ষষ্ঠ দিনে এসে দেখা যাচ্ছে, এই সংখ্যা এখন অনেক বেড়েছে। কয়েকজন রিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রিকশার সংখ্যা বাড়লেও তাদের রোজগার বাড়েনি।

শান্তিনগরে রিকশাচালক রফিক বলেন, ‘পেটের জন্য সকাল ৭টায় রিকশা নিয়া নামছি। এখন বাজে ১০টা। দুটা খ্যাপ পাইছি। দেখেন স্যার, অনেক রিকশা মোড়ে মোড়ে আছে, প্যাসেঞ্জার নাই।’ লকডাউনের এমন ঢিলেঢালা পরিস্থিতিতে হতাশা প্রকাশ করেছেন নয়াপল্টনের বাসিন্দা হাফিজুর রহমান। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এই চাকুরে বলেন, যেভাবে রাস্তায় মানুষজনের উপস্থিতি বাড়ছে, রাস্তায় রিকশা-যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে- এটাকে কি লকডাউন বলা যায়? এ রকম হলে সংক্রমণ কমবে কিভাবে? তবে লকডাউনের কারণে বিপাকে থাকার কথা জানিয়েছেন সেগুনবাগিচা এলাকার কাপড়ের দোকানি তাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, কাঁচাবাজারের কাছে সব দোকানপাট সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত খোলা রাখা হয়েছে। অথচ আমরা দোকান খুললেই পুলিশ এসে বন্ধ করতে বলে। ছোট পুঁজি নিয়ে কাপড়ের দোকান দিয়েছি। এখন কোনো ব্যবসা নেই, কী খাবো, কীভাবে চলব?

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, জীবিকার তাগিদে মানুষ আবেগময় নানা কথা বললেও বিধিনিষেধ মানা না মানা নিয়ে আমলা, পুলিশদের সঙ্গে মানুষের প্রায়ই ঠোকাঠুকি লেগে যাচ্ছে। আর নিমিষেই সেই ঠোকাঠুকির কথাগুলো ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। গত রবিবার রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে সরকারি বিধিনিষেধের পঞ্চম দিনে মুভমেন্ট পাস নিয়ে বাকবিতণ্ডায় জড়ান চিকিৎসক, ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তা। এদিন দুপুরে তিন পক্ষের বাকবিতণ্ডার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেই ভাইরাল ভিডিওর পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এরপরেই প্রশ্নটি নতুন করে সামনে এসেছে- সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত।

প্রশাসনের সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন প্রশিক্ষণের সময় সরকারি কর্মকর্তাদের পরিশীলিত আচরণ নিশ্চিত করার বিষয়ে জানানো হলেও এ বিষয়ে বিধিমালা বা নিয়মকানুন তেমন কিছু নেই। যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে, তাতে দেখা যায়, কয়েকজন পুলিশ ও একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে এক চিকিৎসক চরম বিতণ্ডায় জড়িয়েছেন। তারা পরস্পর পরস্পরকে অপরিশীলিত বাক্যবাণ করছেন এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষমতা জাহির করার চেষ্টা করছেন। তিনজনই সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা।

এ ঘটনার পর ফেসবুকে অনেকে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, দায়িত্বরত পুলিশের সঙ্গে ডাক্তারের এমন ব্যবহার কতটা সমীচীন? আবার কেউ কেউ লিখেছেন, পুলিশের হয়রানি নিয়ে অনেক দিনের জমানো ক্ষোভ থেকেই হয়তো এমন প্রতিক্রিয়া! সংশ্লিষ্ট বিধিমালা ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা রয়েছে, যেখানে একজন সরকারি কর্মকর্তা নির্ধারিত কিছু বিষয়ে কিভাবে পদক্ষেপ নেবেন সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। তবে সেখানে জনগণের সঙ্গে আচরণ কেমন হবে সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ওই ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর গতকাল সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে পুলিশের অবস্থান বেশ নমনীয় দেখা গেছে। রাজধানীর কারওয়ানবাজার, বাংলামোটর, কলাবাগান, ধানমন্ডি, পান্থপথ, সায়েন্সল্যাবসহ শুক্রাবাদ এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, এসব সড়কে গত কয়েক দিনের তুলনায় গতকাল সোমবার ব্যক্তিগত গাড়ি, রিকশা, সিএনজি, মোটরসাইকেলের পরিমাণ অনেক বেশি। সঙ্গে অপ্রয়োজনে বাসা থেকে বের হওয়া মানুষের আনাগোনাও বেড়েছে। কিন্তু পুলিশ চেকপোস্টগুলোতে কড়াকড়ি কমেছে অনেকখানি।

দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, থানা থেকে সড়কে তল্লাশির ক্ষেত্রে নমনীয় অবস্থানে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ধানমন্ডির মিরপুর রোডের লেক সার্কাস চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনরত ট্রাফিক সার্জেন্ট বিকাশ হাওলাদার বলেন, করোনা পরিস্থিতি যেন ভালোর দিকে যায় সে জন্য সরকার লকডাউন দিয়েছে। সে কারণে সড়কে সড়কে তল্লাশি। দরকারে-অদরকারে লোকজন বের হচ্ছে। কিন্তু তাদের বের হওয়ার কারণ জানতে চাইলে পুলিশের দোষ হয়ে যাচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে আরেকজন পুলিশ সার্জেন্ট বলেন, আমাদের বড় স্যাররা থানা থেকে বলে দিছে দায়িত্ব পালন করার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু করার জন্য। যে যার মতো করে চলতে চায় চলুক। আমরা মানুষের ভালোর জন্য চেক করলেই দোষ। অনেকেই সেটা ভালোভাবে নিচ্ছে না। চলুক যার যেমন ইচ্ছে হয়।

গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, এখন লকডাউন চলছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে এই লকডাউন আরো এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে। ঈদে কেনাকাটা এবং ঘরমুখী মানুষের যাতায়াতের জন্য ঈদের আগে অবশ্যই লকডাউন শিথিল করা হবে জীবন ও জীবিকার জন্য। তিনি বলেন, আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। করোনার এমন পরিস্থিতিতে আমাদের জীবনই এখন হুমকির মুখোমুখি। অনেকে জীবিকার কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে পড়েছে। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষ। আমরা জানি তারা কষ্ট পাচ্ছে। তবুও মানতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App