×

মুক্তচিন্তা

ঊনসত্তরেই রয় ফক্স বললেন পাকিস্তান ভেঙে যাবে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২১, ১২:০৮ এএম

১৯৬৯-এ ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ রয় ফক্সের বয়স ৪৯ বছর। তিনি ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় ব্রিটেনের ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন। ঢাকা থেকে বদলি হয়ে কমার্শিয়াল কাউন্সিলার পদে ৪ বছর ফিনল্যান্ডে কাটিয়েছেন, ১৯৭৪ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত হিউস্টনে ব্রিটিশ কনসাল জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সে সময় ইসলামাবাদে ব্রিটিশ হাইকমিশনার ছিলেন সিরিল স্ট্যামলি প্যাকার্ড। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত এ দায়িত্বে ছিলেন; ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত নাইজেরিয়াতে হাইকমিশনার, অবসর গ্রহণের পর বয়াল কমনওয়েলথ সোসাইটির সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি নাইটহুড লাভ করেন, ১৯৯২ সালে মারা যান। ৬ জুন ১৯৬৯ ঢাকায় একটি ডিনার পার্টিতে ব্রিটেনের ডেপুটি হাইকমিশনার রয় ফক্স আমেরিকান কনসাল জেনারেলের সঙ্গে অনেক বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন। রয় ফক্সের কথায় পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। ১. জনদাবি ঠেকাতে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ব্যর্থ হবেই। ২. পাকিস্তান ভেঙে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ৩. শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনে জয়লাভ করবেন। ৪. নির্বাচনের আট মাসের মধ্যেই বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে উঠবে। ৫. এখানে চীনা ধরনের কমিউনিজমের শেষ পর্যন্ত বিজয় হবে। ৬. পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ আসলে অন্ধকার। রয় ফক্সের ছয়টি কথার চারটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়েছে। পঞ্চমটি আদৌ ঘটেনি, বরং কমিউনিজম নিয়ে পশ্চিমের সন্ত্রস্ত কূটনৈতিকদের বাস্তবতাবর্জিত জ্ঞানের প্রকাশ ঘটেছে। স্নায়ুযুদ্ধের মার্কিন ইনডক্ট্রিনেশন পশ্চিমের বুদ্ধিজীবী, কূটনীতিবিদ, প্রশাসক এবং এমনকি সাংবাদিকদের অনেকেই অমূলক আতঙ্কে হাবুডুবু খাওয়াচ্ছিল। ষষ্ঠটি অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ দর্শনেও তিনি ভুল করেছেন। একই ভুল এমন কি একাত্তরেও করেছে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট। ৬ তারিখের ডিনার আলোচনার ওপর মার্কিন কনসাল জেনারেল ৯ জুন ১৯৬৯ ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টে একটি গোপনীয় টেলিগ্রাম পাঠান। সেই টেলিগ্রামটি দীর্ঘ। অনূদিত এই দলিলটি উপস্থাপন করা হচ্ছে। টেলিগ্রামটি কার্যক্রম গ্রহণের জন্য স্টেট ডিপার্টমেন্টে সেক্রেটারি অব স্টেট উইলিয়াম পি রজার্স এবং ইসলামাবাদের মার্কিন রাষ্ট্রদূত বেঞ্জামিন ওলার্টের কাছে পাঠানো হয়। অবগতির জন্য কলকাতা, করাচি, লাহোর ও পেশোয়ারে অবস্থিত কনসুলেট জেনারেল অফিসেও পাঠানো হয়। স্মর্তব্য, বেঞ্জামিন ওলার্ট ১৭ জুন ১৯৬৯ দায়িত্বভার ত্যাগ করেন, জোসেফ ফারল্যান্ড সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেলেন। কৌশলগত কারণে একাত্তরে তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। বিষয় : পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এখানকার ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনারের নৈরাশ্যকর অভিমত। ১. ৬ জুন একটি ডিনারে ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রয় ফক্স পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি হতাশাব্যঞ্জক কথা আমাকে শুনিয়েছেন। ফক্স কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হোম লিভে ফিরে যাচ্ছেন, পূর্ব পাকিস্তানের হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি কমনওয়েলথ ও পররাষ্ট্র সচিব মাইকেল স্টুয়ার্টের কাছে ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি তার বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রার্থনা করেছেন। ফক্স ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, পাকিস্তানের সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে এবং সে নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান জয়ী হবেন। পাকিস্তানের পূর্বাংশ অবশিষ্ট পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং চীনা ধরনের কমিউনিজমই হবে চূড়ান্ত বিজয়ী। ২. ফক্স তার একটি সাম্প্রতিক ভবিষ্যদ্বাণীর পুনরুক্তি করেন যে ১৯৭০-এর মার্চের মধ্যেই অবাধ নির্বাচন দিতে সামরিক কর্তৃপক্ষ বাধ্য হবে। ফক্স যুক্তি দেখিয়েছেন ঊনসত্তরের জানুয়ারি থেকে মার্চে পূর্ব পাকিস্তানে (সরকারবিরোধী আন্দোলনের) যে বিস্ফোরণ ঘটেছে তা এত বিশাল যে, একে আর দীর্ঘ সময় বোতলের দৈত্যের মতো ভরে রাখা যাবে না। সামরিক কর্তৃপক্ষ নির্বাচন দিতে চাইবে না, কিন্তু তা না দিলে যে ভয়ংকর বিস্তৃত বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে স্বল্প সংখ্যক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সেনাবাহিনীর পক্ষে তা সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। নিরঙ্কুশ বিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হবেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান। আর এর ফলে (সম্ভবত মুজিবের অধীনে) পূর্ব পাকিস্তান সরকার বিপুল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন লাভ করবে। আট মাসের মধ্যেই বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদ পূর্ব পাকিস্তানে একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সূচনা করবে, ফলে আবারো সামরিক আইন জারি হবে। ৩. ফক্স মনে করেন বাঙালিরা তৃতীয়বারের মতো সামরিক আইন সহ্য করবেন না (প্রথমবার ৭ অক্টোবর ১৯৫৮ আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, দ্বিতীয়বার ২৫ মার্চ ১৯৬৯ আইয়ুবের পতন ও ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন) এবং তখন গণমানুষের উত্থান ঘটবে, যা পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দমাতে পারবে না। চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থা হবে ডানকার্ক বন্দরের মতো, পার্থক্য একটিই হবে, পাকিস্তানি সৈন্য আর কখনো ফেরত আসতে পারবে না (টীকা দ্রষ্টব্য)। আর পূর্ব পাকিস্তান নিজের পায়ে দাঁড়াতেও পারবে না। পিকিংপন্থি কমিউনিস্টদের শাসনাধীনে চলে যাবে। ৪. ফক্স উচ্ছল মেজাজের মানুষ, স্বাভাবিকভাবে তিনি হতাশাবাদ প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু তিনি বললেন সাম্প্রতিককালে তিনি যত বাঙালির সঙ্গে কথা বলেছেন, প্রত্যেকের কথা তাকে ক্রমেই পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে আরো বেশি হতাশার ভবিষ্যৎ বক্তাতে পরিণত করেছে। নেজাম-ই-ইসলামী নেতা ফরিদ আহমদের সঙ্গে আলোচনায় তাকে তার মনে হয়েছে ‘সুপারচার্জড’Ñ তিনি নিশ্চিত পূর্ব পাকিস্তানে অনির্দিষ্টকালের জন্য সামরিক আইন বহাল থাকবে; তিনটি কারণে তিনি মার্শল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ওপর আস্থা হারিয়েছেন : (ক) গত নভেম্বর-ডিসেম্বরের বিক্ষোভে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ প্রদেশজুড়ে নির্বিচারে তাদের হেনস্তা করে চলেছে। (খ) আইয়ুব শাসনের শেষ দিকে যেমন দুর্নীতি দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল সামরিক শাসনামলে দ্রুত সে অবস্থাটাই ফিরে এসেছে। (গ) সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের মৌলিক অদক্ষতা, তারা প্রদেশের মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে তেমন কিছুই করছেন না। (সাম্প্রতিক আলোচনা শেখ মুজিবুর রহমান কনস্যুলেটের কর্মকর্তাদের কাছে একই ধরনের অভিযোগ করেছেনÑ সারা প্রদেশ ধরেই আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে তাদের বাধা ও হেনস্তার সম্মুখীন হতে হচ্ছে : অনেক উৎস থেকে প্রাপ্ত সংবাদ অতিরিক্ত মাত্রায় পুরনো দুর্নীতির প্যাটার্নই ফিরে আসার কথা বলছে এবং সেই সঙ্গে মার্শাল ল প্রশাসনের অদক্ষতা তো রয়েছেই।) ৫. ব্রিটেনের ডেপুটি হাইকমিশনার প্রদেশের অর্থনীতি প্রসঙ্গে বলেছেন, যতটা হতাশাব্যঞ্জক কল্পনা করা যায় বাস্তবতা একেবারে তার কাছাকাছি। তিনি অনেক অর্থনৈতিক ও জনমিতিক পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন মাথাপিছু আয় কমে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের সম্ভাব্য মূলধন ও প্রযুক্তি আনয়নের প্রশ্নে (পশ্চিম পাকিস্তানসহ) তিনি তেমন কোনো উৎসের দেখা পাচ্ছেন না, যা পরিস্থিতি পাল্টে দিতে পারে। যাদের সক্ষমতা আছে এবং সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে এমন কাউকে তিনি পাননি। ৬. মন্তব্য : ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনারের মতো এতটা হতাশাব্যঞ্জক চিত্র কনসাল জেনারেল দেখতে পাচ্ছেন না, মনে করছেন তার হিসাবটা বেশি রকম হতাশাবাদী, তবে তিনি পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত, তিনি বুদ্ধিমান এবং প্রদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্নÑ এদিকে মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। টীকা : ডানকার্ক যুদ্ধ : ফ্রান্সের ডানকার্ক বন্দর ২৬ মে থেকে ৪ জুন ১৯৪০ পর্যন্ত নাৎসি বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়। মিত্র শক্তির ৭টি দেশের সৈন্য এখানে মোতায়েন ছিল। দেশগুলো হচ্ছেÑ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, মরক্কো, বেলজিয়াম, কানাডা, নেদারল্যান্ডস এবং তাদের সঙ্গে প্রবাসী পোলিশ সৈন্য। যুদ্ধে মিত্রপক্ষে নিহত ও গুরুতর জখমপ্রাপ্ত সৈনিকের সংখ্যা ৬১ হাজার ৭৭৭ এবং জার্মান পক্ষে আনুমানিক ২০ হাজার; বেসামরিক নিহত ব্যক্তির সংখ্যাও হাজার ছাড়িয়ে। আটকেপড়া সৈন্যদের ৮৫ ভাগকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। রয় ফক্স যা বলেছেন তার মানে ডানকার্ক বন্দরে আটকেপড়া সৈন্যদের অধিকাংশই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কোনো পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। রয় ফক্সের ডানকার্ক বন্দরের উদাহরণটি যথার্থ। একাত্তরের ডিসেম্বরে যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পালানোর পথও খোলা ছিল না। প্রথমত পাকিস্তানের শত্রুদেশ ভারতের মধ্য দিয়ে ছাড়া সড়ক পথে পালানোর কিংবা স্বদেশে ফিরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। আকাশ পথে হয়তো অল্প কিছু সংখ্যক জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা পালাতে পারতেন, কিন্তু যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহেই ভারতীয় বোমাবর্ষণে এয়ারপোর্ট বিমান উড্ডয়নের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল আর যুদ্ধের শুরুতেই চট্টগ্রাম বন্দরের বাইরে সমুদ্রে পাকিস্তানি কর্তৃত্ব নিঃশেষ হয়ে যায়। পাকিস্তানি ডেস্ট্রয়ার পিএএনএস গাজী ডিসেম্বরের ৪ তারিখ নিমজ্জিত হয়ে পাকিস্তানের নৌশক্তি বহুলাংশে কমিয়ে দেয়। মূলত ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের অনুগ্রহের কারণেই তারা আত্মসমর্পণ করে প্রাণ রক্ষার সুযোগ পায়। রয় ফক্সের আশঙ্কার আরো নির্মমতম একটি বাস্তবতা হচ্ছে মার্কিন সপ্তম নৌবহর তাদের পাশে দাঁড়াবে, এই বিশ^াসটি একটি হাস্যকর ধাপ্পায় পরিণত হয়েছে। জ্যাক অ্যান্ডারসন একেই বলেছেন আমেরিকার ডিসেম্বর ব্লাফ। ১৯৭১-এর মার্চে মার্কিন কনসাল জেনারেল নিজেই স্টেট ডিপার্টমেন্টকে জানাচ্ছেন : পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ঐক্যের সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। দুই অংশের মধ্যে সমঝোতার সুযোগ স্পষ্টতই শেষ হয়ে গেছে। তখন কনস্যুলার জেনারেল ছিলেন আর্চার ব্লাড। ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App