×

মুক্তচিন্তা

হালাল বিবি- কঠোর লকডাউন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২১, ১২:০৬ এএম

ভাষারাজ্যে ইংরেজির দখলদারিত্ব এই মহামারিতেও। করোনা নামের এই ঘাতক টেস্ট, কিট, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন, ভেন্টিলেশন, ইমিউনিটি আরো কত ইংরেজি শিখিয়ে ছেড়েছে মানুষকে। শেষমেশ ধুমছে আরেক ইংরেজি শব্দ লকডাউনের দাপট। এগুলো কোনো বই বা ডিকশনারি দেখে পড়তে বললে ক’জন মানত? হয়তো দেশে বিদ্রোহও লেগে যেতে পারত। করোনা শিখতে বাধ্য করেছে। রিকশাওয়ালাকেও শিখিয়ে ছেড়েছে। এই ইংরেজির চোট সামনের দিনগুলোতে ইংরেজির বাজার আরো বাড়িয়ে দেয় কিনা, কে জানে? নানা হিসাব বলছে, বিশে^ সবচেয়ে বেশি চর্চা হয় ইংরেজি ভাষার। বিশে^ প্রায় ৪০ কোটি মানুষের প্রধান ভাষা ইংরেজি। এর বাইরে বিভিন্ন দেশের লাখ লাখ মানুষ তাদের দেশে ব্যবহৃত না হলেও বৈদেশিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ব্যবহার করে। আধুনিক বিশে^ যোগাযোগের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হলো ইংরেজিÑ যা প্রকাশনা, ইন্টারনেট, বিজ্ঞান, শিল্প, অর্থ, খেলা, রাজনীতি, এমনকি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের তথ্য মতে, এই মুহূর্তে বিশ^জুড়ে দেড়শ কোটি মানুষ ইংরেজি শেখার চেষ্টা করছে। সামনের বছর নাগাদ সেই সংখ্যা ২০০ কোটিতে গিয়ে ঠেকতে পারে। ভাষার মধ্যে অনেক অনিয়মিত ব্যাপার আছে, কিন্তু সেটি মানুষজনকে এই ভাষার প্রতি আগ্রহ থেকে বিরত করতে পারেনি। ভাষা হিসাবে ইংরেজির কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। এটা কখনোই নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি, কেউ এর ওপর নজরদারিও করেনি। এই সুযোগে আমরাও ইংরেজি ভাষার সঙ্গে নানান বাংলা জুড়ে দিচ্ছি। লকডাউন শব্দটির দশাও কাহিল করে দিয়েছি। ঢিলেঢালা লকডাউন, আংশিক লকডাউন, কঠোর লকডাউন, পুরোপুরি লকডাউন, শতভাগ লকডাউন, সর্বোচ্চ লকডাউন, সিরিয়াস লকডাউন, অরিজিনাল লকডাউন ইত্যাদি লকডাউনের নামে শব্দটির কী দশা দাঁড়িয়েছে? লকডাউনের নানান প্রতিশব্দ আছে। শাব্দিকভাবে লকডাউনের অর্থ তালাবদ্ধ। আর প্রায়োগিক অর্থে লকডাউন একটি জরুরি প্রোটোকল যা মানুষ বা এড়ানো থেকে তথ্য রোধ করতে পারে, যা সাধারণত কমান্ডের দ্বারা কেউ অর্ডার করতে পারেন। লকডাউনের বিপরীত শব্দ লক-আপ। অভিধানে লক-আপের বিষয়ে বলা আছেÑ লক-ইন, কারাগারে আটকে রাখা বা সীমিত করা। দরজা, জানালা, ইত্যাদি লক বা নিরাপদ করাকেও লক-আপ বলা হয়। লকডাউনের অর্থও প্রায় এমনই। এর আগে দেশে ক’দিন আসল-নকল স্ত্রী নিয়ে মাতামাতি চলেছে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের রিসোর্টকাণ্ডে। সোনারগাঁওয়ে রয়েল রিসোর্টে এক নারী নিয়ে ধরা খাওয়ার পর তিনি দাবি করেছিলেন, ওই নারী তার হালাল বিবি। সঙ্গে চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, কেউ প্রমাণ করতে পারবেন না যে ওই নারী তার হালাল স্ত্রী নন। যে এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে তার ওপর আল্লাহর গজব পড়বে। কেউ মামুনুল হক মাওলানার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়নি। আবার তার বদদোয়ায় আল্লাহর গজবের ভয়ও পাননি। তবে একে একে তার আরো বিবিকাহিনী প্রকাশ পেয়েছে। কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারের রসমলাই, পাবনার ঘি, মুক্তাগাছার মণ্ডা, নাটোরের কাঁচা গোল্লা, পুরান ঢাকার হাজীর বিরিয়ানি, নান্নার বিরিয়ানি, ঘরোয়ার খিচুড়ি, মরণ চাঁদের মিষ্টি ইত্যাদি নিয়েও আসল-নকলের কায়কারবার রয়েছে। মানুষকে বিশ্বাস করাতে আদি, অরিজিনাল, আসল, খাঁটি, ১০০ শতাংশ হালালের মতো কত শব্দ যোগ করতে হয় এগুলোতে। সময়ের শ্রোতে এখন লকডাউন বা স্ত্রী নিয়েও পিউর-আসল, অরিজিনালের মতো শব্দের ওপর ভর করতে হচ্ছে। আল্লাহর কসম-ভগবানের দোহাইও দেয়া হয়। একসময়ে ঢাকায় যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো, আসন ক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী ওঠানোর বিপরীতে কিছু বিশেষ বাস নামানো হয়। ‘গেটলক’ বা ‘সিটিং সার্ভিস’ নামে পরিচিতি পায় সেগুলো। আসন ক্ষমতার বেশি যাত্রী না নেয়া, নির্দিষ্ট স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠানামা না করানোর গ্যারান্টি ছিল তাদের। এতে যাত্রীরা সাময়িক স্বস্তিও পায়। কিছুদিনের মধ্যেই চিত্র পাল্টে যায়। যাহা লাউ, তাহাই কদুতে রূপ নেয়। তখন যোগ করা হতে থাকে অরিজিনাল-রিয়েল গেটলক, শিউর সিটিং সার্ভিস ধরনের নাম। মানুষের এতে বিশ্বাস আসেনি। সার্ভিসগুলোরও উন্নতি আসেনি। তাদের চিটিং কেসই চলতে থাকে। সম্পূর্ণ গেটলক, ১০০ শতাংশ গেটলক, সত্যই গেটলক, আল্লাহর কসম গেটলক ইত্যাদি লিখেও তারা আর মানুষের মন পায়নি। তাদের প্রতারণা মানুষ ধরে ফেলেছে। তারাও সত্যি সত্যি সিটিং সার্ভিস, গেটলক সার্ভিস করতে চায় কিনা, সেই সুযোগ আর অবশিষ্ট আছে কিনা, তাও প্রশ্ন। সময়ের ব্যবধানে লকডাউনের অবস্থাও করুণ। শেষবারের মতো ‘লকডাউন’ বিশ্বাস করার আবদারও এখন আর বিশ্বাস করার অবস্থা নেই। রীতিমতো তামাশা চলছে। সরকারের দিক থেকে চেষ্টার অন্ত নেই। মানুষের মধ্যেও কেয়ার করার মানসিকতা নেই। অবস্থাটা এমন দশায় এসে ঠেকেছে সরকারেরই দায়িত্ব হয়ে গেছে লকডাউন দেয়া এবং সফল করা। সরকারের দিক থেকে বলতে হচ্ছে কঠোর লকডাউন। অথচ লকডাউন ব্যাপারটাই কঠোর বিষয়। এরসঙ্গে কোমল বা নরম কিছু নেই। শুরুতে লকডাউন কার্যকরে সরকার আইন প্রয়োগের দিকে তেমন যেতে চায়নি। সেদিকে কতটুকুই বা যাওয়া যায়? এখানে জীবনের সঙ্গে জীবিকার প্রশ্নও। করোনার প্রথম ধাক্কায় ২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে দেয়া ‘লকডাউন’ প্রায় দুই মাস চলেছে নানা বিধি-নিষেধের আওতায়। এজন্য এবার সে ধরনের পরিস্থিতি মেনে নিতে একবারেই রাজি ছিল না পরিবহন শ্রমিকরা। ফলে দুদিনের মাথায় সরকারও বাধ্য হয়েছে শর্তসাপেক্ষে বাস চলাচলে অনুমতি দিতে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন যে, মানুষের যাতে অফিসে যেতে সুবিধা হয় সে জন্য শর্তসাপেক্ষে বাস চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়েছে। গত বছরের লকডাউনেও যখন সবকিছু বন্ধ ছিল, তখন গার্মেন্টস কারখানাগুলো খোলা রাখা হয়। এবারো শুরু থেকেই গার্মেন্টসসহ শিল্প-কারখানাগুলো বিধি-নিষেধের বাইরে ছিল। এবার কথিত লকডাউনে তালগোল আরো পেকেছে। দোকানিরা বলছেন, লকডাউনের মাধ্যমে বৈষম্য করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় দোকানের কর্মচারীরা যে বিক্ষোভ করেছে সেখানে তাদের অন্যতম যুক্তি ছিল, যেখানে সব শিল্প-কারখানা খোলা আছে সেখানে শুধু মার্কেট-শপিংমল বন্ধ করে করোনা কি থামানো যাবে? তা ছাড়া গত বছর লকডাউনের কারণে ঈদ এবং পহেলা বৈশাখের কেনাকাটা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এবারো সে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তখন পরিস্থিতির অনিবার্যতায় লকডাউন শিথিল করতে হয়েছে। শিথিলতার মানে করোনা বিদায় নিয়েছে তা নয়। বরং এই সময়ে সকলকে আরো বেশি সচেতন হওয়া ও পরবর্তী লকডাউনের প্রস্তুতি নেয়া। নিয়মিত স্বাস্থ্যবিধি মানাসহ জনগণের ও সরকারের আরো কিছু করণীয় আছে যেগুলো পালনের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করে যুক্তিতে সবারই কড়া। প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক। বাস্ততা যে বড় নিষ্ঠুর সেদিকে যেতে আপত্তি প্রায় সবারই। যে যার সুবিধা মতো বোঝেন। প্রথমবারের লকডাউনের সরকারি বিধি-নিষেধের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সব সরকারি-বেসরকারি অফিস শুধু জরুরি কাজ সম্পাদনের জন্য সীমিত পরিসরে প্রয়োজনীয় জনবলকে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় অফিসে আনা-নেয়া করতে পারবে। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে বেশিরভাগ অফিসের নিজস্ব কোনো পরিবহন ব্যবস্থা নেই। একদিকে অফিস খোলা, আরেকদিকে রাস্তায় গণপরিবহন না থাকলে সমস্যা তো হবেই। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে সরকারকে ফের লকডাউনের সিদ্ধান্তে যেতে হয়েছে। আর গুরুত্ব বোঝাতে বলা হচ্ছে ‘কঠোর লকডাউন’। কেউ বলছেন, আরো দুই বছর এর প্রভাব থাকবে। কেউ বলছে আগামী পাঁচ বছর থাকবে। গত দুই দশকের সংক্রমিত কয়েকটি ভাইরাসের স্থায়িত্বকাল ও সংক্রমণের সংখ্যার সঙ্গে করোনা ভাইরাসের তুলনা খাটে না। সেগুলোর তুলনায় করোনা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। এরপরও তুলনা করলে দেখা যায়, পশ্চিম আফ্রিকার ইবোলা ভাইরাস ২০১৪-১৯ সাল, সৌদি আরবের মার্স ভাইরাস ২০১২-১৯ সাল, চীনের সার্স ভাইরাস ২০০৩-২০২০ সাল দাবড়িয়েছে। ইবোলা সংক্রমিত দেশ ৪টি ও আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩০ হাজারের মতো। মার্স ভাইরাসে সংক্রমিত দেশ ৮টি, আক্রান্ত হয়েছে আড়াই হাজার। সার্সে ভুগেছে ২৯টির মতো দেশের ৮ হাজার মানুষ। আর করোনায় ভুগছে প্রায় পুরো বিশ্ব। এ পর্যন্ত ২১৫টি দেশের প্রায় ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এ ভাইরাসে। এই ব্যাপকতার মধ্যেই ১৪ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশে লকডাউনের সেকেন্ড ধাপ। সময়টা বড় খারাপ। মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App